মস্কোর
ক্রেমলিনের ভূগর্ভস্থ ওয়াররুমে তখনো তেমনভাবে কোনো আলো জ্বলে ওঠেনি।
চারদিকে সুনসান নীরবতা। অথচ একুশ শতকের আধুনিক রণকৌশলে তখন সম্পূর্ণ
সফলভাবে এক নতুন ধারার সূচনা হয়েছে। রাশিয়ার দূর সাইবেরিয়া অঞ্চলের
বিমানঘাঁটিসহ পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা স্থাপনায় ইউক্রেন প্রায়
একযোগে হামলা চালিয়েছে।
তাতে রাশিয়ার শক্তিশালী যুদ্ধবিমানসহ অনেক
সরঞ্জামের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর আসা শুরু হয়েছে। চলতি মাসের প্রথম রবিবার
রেডস্কয়ারসহ মস্কোতে সেদিন কোনো তুষারপাতের মতো ঘটনা ঘটেনি। পরিষ্কার আকাশ
অথচ চারদিকে একটা অসম্ভব থমথমে ভাব। এ যেন এক আসন্ন কালবৈশাখী শুরু হওয়ার
পূর্বাভাস।
কী ঘটে গেল রাশিয়ার দূরবর্তী সামরিক বিমানঘাঁটিগুলোতে? অবাক
প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, হতবাক রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী অন্দ্রে
বেলোশভ। পরের দিন তুরস্কের কৃষ্ণ সাগরসংলগ্ন ইস্তাম্বুল নগরীতে অনুষ্ঠেয়
রাশিয়া-ইউক্রেন শান্তি বৈঠকের আলোচ্যসূচি নিয়ে ব্যস্ত দেশের প্রাজ্ঞ প্রবীণ
পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ।
ক্রমে ক্রমে সাইবেরিয়াসহ রাশিয়ার
দূরবর্তী বিমানঘাঁটিগুলোতে ঘটে যাওয়া ড্রোন হামলার ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত
বিবরণ আসছে। যুদ্ধংদেহী ও মারকুটে পুতিন তখনো বুঝতে পারছিলেন না কী করে এ
ধরনের একটি পরিকল্পিত এবং অভিনব ড্রোন প্রযুক্তির হামলা সম্ভব হয়েছে।
ইউক্রেনের
সীমান্ত থেকে বিশাল বিশাল লরি নিয়ে রাশিয়ার ভূখণ্ডের প্রায় চার হাজার
কিলোমিটার পথ পেরিয়ে কী করে বিমানঘাঁটিগুলোতে আক্রমণ চালানো সম্ভব হলো? সে
দীর্ঘ দুর্গম পথে কেউ কিছু তল্লাশি করল না, কোনো নিরাপত্তাসংক্রান্ত
জিজ্ঞাসাবাদও ছিল না সেদিন কোথাও। এটাও কি রাশিয়ার মতো নিরাপত্তা সচেতন
একটি দেশে সম্ভব? তখন থেকে বিশ্বব্যাপী এই বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় চললেও
সম্পূর্ণ নীরব ছিলেন ইস্পাত কঠিন প্রেসিডেন্ট পুতিন। প্রায় আট বিলিয়ন ডলার
সমমূল্যের ৪১টির মতো বিভিন্ন উচ্চ ক্ষমতার যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়েছে। তাতে
ছিল এ-৫০ নজরদারি প্লেন, সুপারসনিক টিইউ-১৬০ এবং টিইউ ২২ বোম্বারসহ
অন্যান্য। সে অভিযানে ১১৭টি ড্রোন বহুদূর থেকে রিমোট কন্ট্রোলে পরিচালনা
করা হয়েছে।
স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে গেছে লম্বা লম্বা লরির ছাদ এবং একে একে ধারাবাহিকভাবে বেরিয়ে গিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে ছোট ছোট ড্রোনগুলো।
দূরপাল্লার
কোনো ক্ষেপণাস্ত্র কিংবা শব্দের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি গতিসম্পন্ন
যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫ কিংবা রাশিয়ার এসইউ-৫৭ পঞ্চম প্রজন্মের স্টিলথ
জঙ্গিবিমান নয়, আবাবিল পাখির মতো ছোট ছোট ড্রোনের হামলায় নাস্তানাবুদ হয়েছে
বিশ্বের একটি অন্যতম প্রধান সামরিক পরাশক্তি রাশিয়া। তাই পুতিনের মতো
যুদ্ধবাজ লৌহমানব সে ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ ও বিমূঢ়। কিন্তু সামরিক
শক্তিতে খর্বকায় ইউক্রেনের মরণকামড় সেখানেই শেষ হয়নি। ৩ জুন কৃষ্ণ সাগরের
তলদেশ দিয়ে সবার অজান্তে তারা তাদের হারানো বন্দর ক্রিমিয়ায় গিয়ে হামলা
চালিয়েছে রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার একমাত্র শক্তিশালী সেতুতে। এই
অপ্রত্যাশিত ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই সেতুর দুই পারে জরুরি অবস্থা জারি করেছে
রাশিয়া। এসব ঘটনায় সার্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে ইউক্রেন।
উল্লেখ্য, কয়েক সপ্তাহ আগেও হোয়াইট হাউসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির
জেলেনস্কির সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড
ট্রাম্প তাঁকে (জেলেনস্কি) বলেছিলেন, ‘এই যুদ্ধজয়ের কোনো সম্ভাবনা এখন
তোমার নেই। তোমার হাতে খেলার মতো আর কোনো কার্ড অবশিষ্ট নেই। এখন
যুদ্ধবিরতি করে রাশিয়ার সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরই তোমার জন্য
আত্মরক্ষার একমাত্র পথ হতে পারে। কারণ এই যুদ্ধে তুমি এরই মধ্যে হেরে বসে
আছ।’ কিন্তু কে জানত আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর রণকৌশলের বৈশিষ্ট্য কিংবা
তাৎপর্য?
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর নিজ
স্বার্থে এই যুদ্ধে এখন ইউক্রেনের পেছন থেকে সরে গেলেও জার্মানি, ফ্রান্স
কিংবা ব্রিটেন কৌশলগতভাবে কিংবা ইউরোপের বৃহত্তর স্বার্থের প্রশ্নে এখনো
মুখ ঘুরিয়ে নেয়নি। এ এক নিদারুণ খেলা। রাশিয়ার দুর্ভেদ্য সামরিক
ঘাঁটিগুলোতে ইউক্রেনের সাম্প্রতিক ড্রোন হামলা পরিচালনার সঙ্গে তথ্যাভিজ্ঞ
মহল লেবাননে হিজবুল্লাহর গোপন ঘাঁটিগুলোতে ইসরায়েলের আকস্মিক ড্রোন হামলার
যথেষ্ট মিল খুঁজে পেয়েছেন। সে পরিকল্পিত ড্রোন হামলায় ইসরায়েল হিজবুল্লাহর
বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের সম্ভার ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে। রাশিয়ায় সাম্প্রতিক
ড্রোন হামলা পরিচালনার পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি জানিয়েছেন,
তাঁরা গত ১৮ মাস যাবৎ সে হামলার পরিকল্পনা করেছেন অত্যন্ত ভিন্ন এক কৌশলে।
সে সময় কৌশলে কোনো সর্বাধুনিক ক্ষেণাপস্ত্র, যুদ্ধবিমান কিংবা আকাশ
প্রতিরক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন হয়নি। সমর বিশ্লেষক কিংবা তথ্যাভিজ্ঞ মহল মনে
করে, আধুনিক ড্রোন প্রযুক্তি এবং তার যথাযথ ব্যবহার বিশ্বের বিভিন্ন
শক্তিধর দেশগুলোর সমর কৌশলে যথেষ্ট পরিবর্তন বয়ে আনতে পারে।
এ কথা ঠিক
যে রাশিয়ার সামরিক বিমানঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে কিংবা ক্রিমিয়ার সঙ্গে
রাশিয়ার যোগাযোগ সেতুতে নাশকতা চালিয়ে ইউক্রেন তাদের ব্যাপক ক্ষতি সাধন
করেছে। তবে যে উদ্দেশ্য নিয়ে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়া ইউক্রেনের
বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়েছে, তা অনেকখানিই অর্জিত হয়েছে। কারণ বিগত ৩৯
মাস স্থায়ী যুদ্ধে রাশিয়া ইউক্রেনের যে চারটি প্রদেশ দখল করেছে তা তারা
ছাড়বে না। রুশভাষী ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ লোহানস্ক, দোনেৎস্ক, খারকিব কিংবা
এমনকি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর এলাকা ক্রিমিয়াকে তারা কোনোমতেই তাদের (রুশ)
নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে দেবে না। তাতে ইউক্রেন যতই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার
আগ্রহ দেখাক না কেন। ক্রমে ক্রমে তারা তাদের সে সক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। এর
মূল কারণ দুটি-প্রথমটি হচ্ছে সামরিক এবং দ্বিতীয়টি অর্থনৈতিক। বিগত প্রায়
সোয়া তিন বছরের যুদ্ধে রাশিয়া যে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, তা হয়তো
দ্রুতই কাটিয়ে উঠতে পারবে, কিন্তু ইউক্রেনের পক্ষে তা মোটেও সম্ভব হবে না।
ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ইউক্রেন তার কাছ থেকে মোটেও কোনো নির্ভরযোগ্য
সাহায্য-সহযোগিতা পাবে না। বরং যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া সম্মিলিতভাবে
ইউক্রেনের সব সম্পদ ভাগ-বাটোয়ারা করে নেবে যত দ্রুত সম্ভব। তাতে অরক্ষিত
ইউরোপ অর্থাৎ জার্মানি, ফ্রান্স ও ব্রিটেনসহ অন্যরা ইউক্রেনকে যতটা সম্ভব
সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিক না কেন, সেটা ব্যক্তিগতভাবে জেলেনস্কিকেই
রক্ষা করতে পারবে না।
যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে যত দ্রুত একটি সাধারণ
নির্বাচনের আয়োজন করা যায়, তত দ্রুতই জেলেনস্কির ক্ষমতা হারানোর পথ প্রশস্ত
হবে। এরই মধ্যে ন্যাটোর অবস্থান আরো দুর্বল হতে হতে এক পর্যায়ে ভেঙে
যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। তাতে ইউরোপকে তার নিজস্ব প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে
তুলতে গিয়ে অর্থনৈতিকভাবে আরো সচ্ছল হতে হবে। এবং তাদের জ্বালানি সংকট
মোকাবেলার দিকে অত্যন্ত মনোযোগী হতে হবে। তাতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে
যুক্তরাষ্ট্র এবং জ্বালানির ক্ষেত্রে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা বাড়বে বৈ
কমবে না। এখন থেকে সময়োপযোগী ব্যবস্থা নিতে সক্ষম না হলে জার্মানি,
ফ্রান্স, ব্রিটেন, ইতালি ও পোল্যাল্ড তাদের শিল্পোৎপাদন ধরে রাখতে পারবে
না। এ ক্ষেত্রে ইউরোপের নিরাপত্তার প্রশ্ন বিলম্বিত হতে পারে।
রাশিয়ার
সামরিক বিমানঘাঁটিগুলোতে ইউক্রেনের সাম্প্রতিক পরিকল্পিত ড্রোন হামলা
অর্থাৎ ‘অপারেশন স্পাইডার ওয়েবের’ পর এখন তাদের অবশ্যই নজর দিতে হবে
ইস্তাম্বুল শান্তি আলোচনার দিকে। আর এর মধ্যে ইউক্রেনের সাম্প্রতিক হামলার
সমুচিত জবাব দিতে রাশিয়া যেসব হামলা চালাবে, তাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হতে
পারে ব্যাপক। পুতিন ইউক্রেনের হামলার কথা ভুলে যাবে এটি চিন্তা করাও
অস্বাভাবিক। অনেকের মতে পুতিনের পক্ষে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ কিংবা তার
বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায়
ইস্তাম্বুল শান্তি আলোচনাকে কেন্দ্র করে জেলেনস্কি দাবি করেছেন বিগত দিনের
যুদ্ধে রাশিয়া ইউক্রেনের যেসব অঞ্চল দখল করেছে তা ফিরিয়ে দিতে হবে।
অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে সব বন্দিকে ফিরিয়ে দিতে হবে। প্রথমে ৩০ দিন
যুদ্ধবিরতি ঘোষণা এবং ধাপে ধাপে সব বিধি-নিষেধ তুলে নিতে হবে। তা ছাড়া
তাদের মতে চাপিয়ে দেওয়া সে যুদ্ধের জন্য রাশিয়াকে যথাযথভাবে ক্ষতিপূরণ দিতে
হবে। এ ক্ষেত্রে জেলেনস্কির তালিকা অনেক দীর্ঘ।
অন্যদিকে যুদ্ধবিরতির
পর মূল সমস্যা সমাধানের বৃহত্তর লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন,
ক্রিমিয়াসহ চারটি দখল করা অঞ্চলকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
তা ছাড়া ইউক্রেন কোনো সামরিক জোটে যোগ দিতে এবং পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী
হতে পারবে না। আজব বাহিনীর মতো ইউক্রেনের জাতীয়তাবাদী গ্রুপগুলো ভেঙে দিতে
হবে, রুশ ভাষাকে ইউক্রেনের একটি মূল ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। তা
ছাড়া ইউক্রেনের ধর্মীয় অর্থোডক্স চার্চগুলোর ওপর থেকে বিধি-নিষেধ তুলে
দিতে হবে।
যুদ্ধবিরতি ছাড়াও এই দুই পক্ষের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তিতে
পৌঁছতে এক লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে বলেই অনেকে মনে করেন। ইউক্রেনে অনেক
পরিবর্তন আসতে পারে। এ কথা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে যুক্তরাষ্ট্র ও
রাশিয়া উভয়েই মনে করে শান্তিচুক্তি সম্পাদনের আগে ইউক্রেনে একটি সাধারণ
নির্বাচন অনুষ্ঠান করা প্রয়োজন। সে প্রস্তাবিত নির্বাচনে জেলেনস্কি অংশ
নিলে তাতে তাঁর পরাজয় নিশ্চিত বলেই অনেকে মনে করেন। সর্বোপরি
রাশিয়া-ইউক্রেন শান্তিচুক্তি জেলেনস্কিকে ক্ষমতায় রেখে মোটেও সম্ভব কি না
তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক