ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে কুমিল্লা ছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র। এখানকার ইংরেজ কর্মকর্তা, ইউরোপীয় পরিবার এবং স্থানীয় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির সক্রিয় অংশগ্রহণে খেলাধুলা হয়ে উঠেছিল সমাজজীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই গবেষণায় আমরা সমসাময়িক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোর মাধ্যমে কুমিল্লার ক্রীড়া সংস্কৃতির স্বরূপ উন্মোচনের চেষ্টা করেছি। এসব প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড় থেকে ঈদগাহ পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাটি ছিল এক বিশাল খেলার মাঠ। এই বিশাল মাঠে পোলো ও গলফ খেলা হতো। পোলো মৌসুমের সমাপ্তি ঘটলে এই একই মাঠে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলার আয়োজন করা হতো। কুমিল্লার রেসকোর্স ছিল আরেকটি সুবিশাল ক্ষেত্র, যেখানে ঘোড়দৌড় অনুষ্ঠিত হতো। এই ঘোড়দৌড়গুলো কখনও 'জিমখানা রেস' নামে পরিচিত ছিল, আবার কখনও বিশেষ উৎসবের অংশ হিসেবে আয়োজিত হতো।
অভিজাতদের পোলো ও গলফ:পোলো খেলাটি মূলত ইউরোপীয় অভিজাতদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে পোলো খেলার প্রবণতা কমে আসত। লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত 'দ্য ইংলিশম্যান ওভারল্যান্ড' পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ থেকে জানা যায়, কুমিল্লা স্টেশন সংলগ্ন ক্লাবঘরের খেলার মাঠে (যা এখন কুমিল্লা স্টেডিয়াম, ঈদগাহ নামে পরিচিত) পোলো ও গলফ খেলা হতো। পত্রিকাটিতে এই দুটি খেলার প্রতিযোগিতা আয়োজনের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৯১১ সালের ২০ এপ্রিল 'কুমিল্লা প্রতিধ্বনি' শিরোনামে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়—এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে "পোলো খেলার মৌসুম শেষ হয়েছে, এবং এখন শুধুমাত্র সকালের অর্ধেক সময়ে যারা খেলার মতো পরিশ্রমী, তারাই খেলায় অংশ নিচ্ছেন। সকাল আটটার পর থেকে আবহাওয়া এতটাই গরম হয়ে পড়ে যে খেলা অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিকাল বেলায় মাঠ ছেড়ে দেওয়া হয় ক্রিকেট এবং ফুটবল খেলার জন্য।"
ঘোড়দৌড়:
'দ্য ইংলিশম্যান ওভারল্যান্ড' পত্রিকার আরেকটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কুমিল্লা শহরের রেসকোর্স মাঠ ছিল ইউরোপীয় অভিজাতদের ক্রীড়ার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। এখানে আয়োজিত হতো ঘোড়দৌড়, যা কখনও জিমখানা রেস, আবার কখনও বিশেষ উৎসব উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হতো। ১৯১১ সালের ডিসেম্বরে রাজা পঞ্চম জর্জের ভারত আগমনের স্মরণে যে ঘোড়দৌড় অনুষ্ঠিত হয়, তাতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শহরের উচ্চবিত্ত শ্রেণি অংশ নেয়। ঘোড়দৌড়কে ঘোড়ার জাত, মালিকানার শ্রেণি ও রেসের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হতো। এই পুরো আয়োজন পরিচালিত হতো ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট ও সাহেবদের তত্ত্বাবধানে। শামিয়ানা, চন্দ্রমল্লিকা ফুলের মনোরম সজ্জা, চা পরিবেশনের সুব্যবস্থা এবং বিশেষ পুরস্কার বিতরণ—সবকিছুই প্রমাণ করে যে এটি ছিল এক ধরনের সামাজিক আভিজাত্য প্রদর্শনের ক্ষেত্র।
১৯১১ সালের ২১ ডিসেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়—"রাজা জর্জের ভারত আগমন উপলক্ষ্যে কুমিল্লা গত কিছুদিন ধরে অনেক উৎসাহের সঙ্গে উদযাপন করছে। ৯ই ডিসেম্বর বিকেলে রেসকোর্সে জিমখানা রেস অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বিপুলসংখ্যক দর্শক সমবেত হয়েছিলেন। রেসের সমান্তরাল সড়কের পাশে অনেকগুলো পর্দানশীন মহিলাদের গাড়ি দাঁড় করানো ছিল। গোটা শহর যেন ঘোড়দৌড়ের প্রতি এক গভীর আকর্ষণ অনুভব করছিল। মিসেস লাফম্যান একটি চমৎকারভাবে সাজানো শামিয়ানা তৈরি করেছিলেন, যা দৃষ্টিনন্দনভাবে সাজানো হয়েছিল। সেখানে প্রচুর চন্দ্রমল্লিকা ফুল দিয়ে চা-সার্ভ করার স্থান সাজানো হয়েছিল, যেগুলো দর্শকদের খুবই পছন্দ হয়েছিল। এই ফুলগুলো তার নিজের বাগানে চাষ করা হয়েছিল এবং সেগুলো দারুণভাবে সফল হয়েছে। হলুদ, গোলাপি এবং গাঢ় খয়েরি ও সাদা রঙে ফুটন্ত ফুলগুলো সত্যিই মনকাড়া ছিল। অন্য সাজসজ্জার মধ্যে একটি লাল, সাদা ও নীল রঙের স্ক্রলে সোনালী অক্ষরে রাজকীয় কোট অফ আর্মস আঁকা ছিল।"
ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় যেসব বিষয় ছিল: ১. সকল সি. বি. ঘোড়া ও টাট্টু ঘোড়ার দৌড়, দূরত্ব এক মাইল। ২. স্থানীয় অভিজাতদের ঘোড়া ও টাট্টু ঘোড়ার দৌড়, দূরত্ব এক মাইল। ৩. টাঙ্গার টাট্টু ঘোড়ার দৌড়, দূরত্ব আধা মাইল। ৪. সব ধরনের ঘোড়া ও টাট্টু ঘোড়া, দূরত্ব এক মাইল। ৫. সকল সি. বি. টাট্টু ঘোড়ার দৌড়, দূরত্ব আধা মাইল। ৬. সকল ধরনের ঘোড়া ও টাট্টু, দূরত্ব আধা মাইল।
এই প্রতিযোগিতায় মি. এইচ. জি. ফ্রান্সিস এবং মি. লাফম্যান যথাক্রমে স্টার্টার এবং বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন, আর মি. পি. জে. ডিল্যান্স সম্মানসূচক সচিবের দায়িত্বে ছিলেন। কুমিল্লার জনপ্রিয় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. ওয়েবস্টার (যিনি কুমিল্লা গেজেট লিখেছিলেন) একটি জোড়া জাপানি ফুলদানি "মহিলা পুরস্কার" হিসেবে উপহার দেন, যা চতুর্থ রেসে বিজয়ী হন মিস চ্যামিয়ার। বিজয়ী ঘোড়ার নাম একটি টিকিট থেকে ড্র করা হয়।
১০ ও ১১ ডিসেম্বর ময়দানে আরও কিছু খেলাধুলার আয়োজন করা হয়, যার মধ্যে একটি সাঁতার প্রতিযোগিতা ছিল। এটি একটি কাছাকাছি পুকুরে অনুষ্ঠিত হয়। এই প্রতিযোগিতায় ছয়জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে দুজন খুব কাছাকাছি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, আর বাকি চারজন পানিতে ভেসে আরাম করে সাঁতার কেটে সময় কাটান, যা দর্শকদের কাছে বেশ উপভোগ্য ছিল। ১২ তারিখটি ছিল খুবই ব্যস্ত; সবাই খুব সকালে জেগে উঠেছিল। পুরো শহরটি সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছিল এবং বিভিন্ন বালক বিদ্যালয়ের শোভাযাত্রা শহরজুড়ে প্রদক্ষিণ করছিল, হাতে ছিল পতাকা ও ব্যানার, আর তারা দেশাত্মবোধক গান গাইছিল। আরও কিছু শোভাযাত্রা ছিল, যেগুলো প্রতীকী প্রতিচ্ছবির মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল একটি বিশাল মুকুট, যেটি চারজন ভাল্লুক দিয়ে বহন করানো হয়েছিল। অসাধারণ সাজসজ্জার হাতিরাও পুরো দৃশ্যটিকে আরও চিত্তাকর্ষক করে তোলে।
সকালে ফয়েনশাই স্কুলের মেয়েদের এবং পর্দানশীন নারীদের মাঝে রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে মেডেল বিতরণ করা হয়। এই মেডেল বিতরণের কাজটি করেন মিসেস জে. এন. রায়, যাকে সহায়তা করেন স্কুল পরিদর্শকের সহকারী মিস চ্যামিয়ার। সকাল ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত দরিদ্রদের মধ্যে খাদ্য ও বস্ত্র বিতরণ করা হয় এবং সোয়া বারোটার সময় "সাহিব লোকেরা" টাউন হলের কাছে ক্রস রোডে একত্রিত হয়ে রাজ্য ঘোষণা শোনার উদ্দেশ্যে মিছিল করে টাউন হলে আসেন। টাউন হলের সাজসজ্জা ছিল অতুলনীয় এবং কুমিল্লায় পূর্বে এমন কিছু দেখা যায়নি। প্রচুর মানুষ জড়ো হয়েছিলেন এবং পুরো দৃশ্যটি ছিল প্রাণবন্ত ও রঙিন। রাজ্য ঘোষণাটি প্রথমে ইংরেজিতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা পাঠ করা হয় এবং এরপর বাংলায় পাঠ করেন ফার্স্ট মুনসিফ। ১০১টি বন্দুকের গর্জনে অনুষ্ঠানটি শুরু হয়, সাথে ছিল জনগণের উল্লাসধ্বনি। একজন প্রধান ভারতীয় ভদ্রলোকের পক্ষ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেওয়া হয়, যেখানে উপস্থিত সবাইকে স্বাগত জানানো হয়। স্যার সৈয়দ হোচ্ছাম হায়দার চৌধুরী নবাব উপাধিতে ভূষিত হন, এবং বাবু অন্নমোহন মোহননাথ, রায়বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত হন। এই ভদ্রলোকগণ তৎকালীন দিল্লির ইস্টার্ন বেঙ্গল ও আসাম ক্যাম্পে অতিথি হিসেবে অবস্থান করছিলেন। এরপর একটি বড় সংখ্যক সার্টিফিকেট ও পুরস্কার বিতরণ করা হয়, যাদের মধ্যে পঞ্চাশজন গ্রাম চৌকিদার ছিলেন, যাদের প্রত্যেকের চাকরির মেয়াদ ছিল বিশ বছরের বেশি। অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে একটি চমৎকার গ্রামোফোন রেকর্ড বাজিয়ে, যেখানে ম্যাডাম ক্লারা বাট “God Save the King” গানটি পরিবেশন করেন। এর পরপরই টাউন ব্যান্ড “জাতীয় সংগীত”-এর আরেকটি পরিবেশনা করে, যা সকলের প্রশংসা অর্জন করে।
দুপুরে স্কুল স্পোর্টসের ফাইনাল ইভেন্টগুলো ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়। পুরস্কার বিতরণ করেন মিসেস কামিং, যিনি পরে তার স্নিগ্ধ বাগানে চা-পর্বে সমগ্র স্টেশনের মানুষদের আমন্ত্রণ জানান। সন্ধ্যার পর, সবাই স্টেশনের চারপাশে আলোকসজ্জা দেখতে বের হন, যা সর্বসম্মতভাবে "অসাধারণভাবে মনোমুগ্ধকর" বলে বিবেচিত হয়। সমস্ত সরকারি ভবন ও স্কুলগুলো ছিল উজ্জ্বল আলোয় ভাসমান, যার মধ্যে সবচেয়ে প্রশংসিত ছিল নতুন সিভিল কোর্ট এবং জেলা স্কুল। বহু ব্যক্তিগত বাড়ি ও বাগানও "ফেরিল্যান্ড"-এর মতো রূপ ধারণ করে। এই মনোরম পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বিশেষ ধন্যবাদ জানানো হয় মিসেস লুফম্যানকে। ক্লাবে প্রায় এক হাজার বাতি ও চীনা লণ্ঠনের আলোয় এক রূপকথার আবহ তৈরি হয়। সেই রাতে ডিনারে বিশ্বস্ত অতিথিদের উপস্থিতিতে মি. ওয়েবস্টার কর্তৃক একটি টোস্ট প্রদান করা হয়। তিনি অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে বিশেষ ভূমিকা রাখায় তাকে কৃতজ্ঞতা জানানো হয়। মিসেস কামিং এক সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় উপস্থিত সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং মি. ফ্রান্সিসের সুস্বাস্থ্যের কামনা করেন। সমগ্র সজ্জা, আলোকসজ্জা এবং যানবাহন পরিচালনার জন্য পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকাও অত্যন্ত প্রশংসনীয় ছিল।
ফুটবল: ইউরোপীয় ও স্থানীয়দের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র
কুমিল্লায় ফুটবল ছিল একমাত্র খেলা যেখানে ইউরোপীয় ও স্থানীয় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে এক ধরনের স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা গড়ে ওঠে। ১৯১১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর 'দ্য ইংলিশম্যান ওভারল্যান্ড' পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়—"ফুটবল ছিল একমাত্র খেলা যেখানে ইউরোপীয় ও স্থানীয় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে প্রতিযোগিতার এক ধরন গড়ে ওঠে।" ১৯১১ সালের ফুটবল কাপ প্রতিযোগিতায় ভিক্টোরিয়া কলেজ ও স্টেশনের দলের মধ্যে একটি শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বিতা লক্ষ্য করা যায়। কাপ দাতা, প্রধান ঠিকাদার এ. সি. রায়, স্থানীয় পৃষ্ঠপোষকতায় খেলাধুলার গুরুত্বকে তুলে ধরেন। ম্যাচ শেষে চা-পর্ব এবং সামান্য উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তগুলো সমগ্র অনুষ্ঠানকে একটি পারিবারিক ও মিশ্র সামাজিকতায় রূপ দেয়।
ঔপনিবেশিক আমলে কুমিল্লায় পোলো, গলফ, ঘোড়দৌড়, ফুটবল, ক্রিকেট ছাড়াও বিলিয়ার্ড, অকশন ব্রিজ এবং সাঁতার-এর মতো খেলাগুলো বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল। কুমিল্লার সে সময়ের সমাজজীবন ছিল অনেকটাই ক্লাবভিত্তিক এবং জমকালো।
তথ্য সূত্র: ১. দ্য ইংলিশম্যান ওভারল্যান্ড, ১৮ সেপ্টেম্বর ১৮৯৬
২. দ্য ইংলিশম্যান ওভারল্যান্ড, ২০ এপ্রিল ১৯১১
৩. দ্য ইংলিশম্যান ওভারল্যান্ড, ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯১১
৪. দ্য ইংলিশম্যান ওভারল্যান্ড, ২১ ডিসেম্বর ১৯১১