
কবি বলেছেন–
কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও
তারই রথ নিত্যই উধাও।
প্রশ্নটি
সংগত; কালের যাত্রাপথেই মানুষের নিত্যদিনের গতিবিধি। ভাবলে খুব মজা লাগে,
মানুষ পৃথিবীতে আসে অতি অল্প দিনের জন্য পঞ্চাশ-ষাট, বড়োজোর সত্তর-আশি বছর
তার মেয়াদ। কিন্তু ওইটুকু সময়ের মধ্যেই সে তার চতুষ্পার্শ্বে তুমুল
তোলপাড়ের সৃষ্টি করে। সামান্যটুকু করতে গিয়েও নানা ঝঞ্ঝাট বাধায়। লক্ষ করার
বিষয় যে মানুষের গতিবিধি, ক্রিয়াকলাপ সমস্তই অতি মাত্রায় সশব্দ।
আস্তে-ধীরে, আলগোছে কিছুই করতে পারে না। পানিস্রোতের মধ্যে যেমন একটা কলকল
রব, জনস্রোতের মুখেও সর্বক্ষণ তেমনি একটা কলকণ্ঠ কলরব কিন্তু ওই যে নিরবধি
কাল বিশ্বসৃষ্টির প্রথমাবধি নিরন্তর চলে আসছে তার মুখে টুঁ শব্দটি নেই।
স্বল্পায়ু মনুষ্য নামক জীবটির লম্ফঝম্ফ, তাজ্জব কর্মকাণ্ড দেখে অমিতায়ু
মহাকালে নিশ্চয় মনে মনে হাসেন। এই ক্ষণে বলছি মহাকাল বা অন্তহীনকাল তার
সঙ্গে মানুষের কোনো যোগ নেই। অনন্তকালের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ বা টুকরো
নিয়ে তার কারবার। সময়ের পরিমাপ করতে গিয়ে মানুষ তাকে দিন, মাস, বৎসর
ইত্যাদি অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে ভাগ করেছে। সবচাইতে বড়ো খণ্ডটির নাম
শতাব্দী দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারে, দীর্ঘতম কাল বলতে একমাত্র এই বিংশ
শতাব্দীটির সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতম পরিচয়। মানুষের জ্ঞাত ইতিহাস তাও খুব
বেশিদিনের নয়, হাজার পাঁচ-ছয় বছরের বেশি নয়– পরীক্ষা করে দেখলে দেখা যাবে,
এমন একটি শতাব্দী যায়নি যখন যুদ্ধবিগ্রহ, অশান্তি, উপদ্রব ঘটেনি। মানুষের
উদ্দাম উদ্ধত ব্যবহারের দর নেই, কালস্রোত ক্ষণে ক্ষণে উত্তাল হয়ে মানব
সমাজের ওপরে আছড়ে পড়েছে। মানুষের আগ্রাসী মনোভাব তাকে শান্তিতে, সোয়াস্তিতে
থাকতে দেয় না। সর্বক্ষণ বিষম উত্তেজিত, বলতে গেলে উন্মত্ত। এরই ফলে সমাজের
শান্তি বিঘ্নিত, দেশ-কাল বিপদগ্রস্ত, বিপর্যস্ত।
স্বল্পস্থায়ী
স্বল্পপরিসর খণ্ডিত কালের টুকরোটুকু নিয়ে ব্যতিব্যস্ত বলে অন্তহীন নিরবধি
কালের কথা মানুষ জানেও না, ভাবেও না। অস্থিরমতি মানুষের হাতে পড়ে কালের
গতিতে কী দুর্গতি ঘটেছে। তা আমরা চোখের সুমুখেই দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে,
কালই যেন কালগ্রাসে পড়েছে। শক্তি প্রকাশ যথেচ্ছ ব্যবহারে নয়। যথার্থ শক্তির
পরিচয় শক্তি সংবরণে। আস্ফালন শক্তিমানকে মানায় না। সূর্য অপরিমেয় শক্তির
উৎস। অগ্নিতাপে পৃথিবীকে ভস্মীভূত করতে পারে; কিন্তু প্রয়োজনবোধে ক্ষণে
ক্ষণে নিজেকে স্তিমিত করে যাতে জীবজন্তু, পণ্ড-পক্ষী, কীটপতঙ্গ, বৃক্ষ-লতা
সকলেই জীবনধারণ করতে পারে। যা বৃহৎ এবং মহৎ তা সবসময়েই শান্ত-বিনীত। যা
সুন্দর তারও স্বভাবটি মৃদু এবং বিনয়-নম্র। ফুল ফোটে নিঃশব্দে, পটকা ফোটে
সশব্দে। রবীন্দ্রনাথ অতি সুন্দর করে বলেছিলেন সংসারের পরম আশ্চার্য
ব্যাপারগুলো পরম নিঃশব্দে ঘটে। সূর্যালোক- চন্দ্রলোক– দুই আসে নীরবে,
নিঃশব্দে। অযাচিত দান দিয়ে যাচ্ছে দরাজ হস্তে বিনা মূল্যে। মানুষের নিজ
হাতের সৃষ্টি বৈদ্যুতিক আলো কিনতে হয় মূল্য দিয়ে আর তার উৎপাদন পর্ব কী
জবরজং ব্যাপার! কর্ণভেদী তার শব্দ ব্যবহারে তিলমাত্র অসাবধান হলে
প্রাণসংশয়। তার উপরে আবার বিদ্যুৎ সরবরাহে বিভ্রাট লেগেই থাকে। তথাপি
স্বীকার করতেই হবে মানুষ বুদ্ধি বলে নানা অসাধ্য সাধন করেছে। দৈনন্দিন
জীবনযাত্রাকে নানাভাবে সুগম করে নিয়েছে। প্রশংসনীয় উদ্যম বলতে হবে। কিন্তু
মানুষের এক ব্যাধি সুবুদ্ধির কাজ দুর্বুদ্ধিতে নষ্ট হয়। আণবিক শক্তি
মানুষের প্রাণসংহারে। দু-দুটি নগর বিধ্বস্ত লক্ষাধিক প্রাণ বিনষ্ট। এখন
দেশে দেশে তার ব্যবহার চরছে মারণাস্ত্র নির্মাণে। এমনকি অনুগত দেশসমূহে
যেখানে মানুষের অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, বাসগৃহ নেই, শিক্ষা নেই, স্বাস্থ্য
নেই সেখানেও শাসকগোষ্ঠী উঠেপড়ে লেগেছেন নিউক্লিয়ার বোমা নির্মাণে। এর কারণ
কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না, প্রত্যেক দেশ অপর দেশকে শত্রুজ্ঞান করে।
ব্রহ্মাস্ত্রটি হাতে থাকলে নিশ্চিত তো বটেই অপর দেশকেও শাসিয়ে বেড়াতে
পারবে। বলা বাহুল্য, এসব সভ্য মানুষের লক্ষণ নয়।
শক্তির অপব্যবহারের
নামই দস্যুবৃত্তি। দৈত্য-দানব বলে আলাদা কোনো জীব নেই। বিজ্ঞান মানুষের
হাতে যে শক্তি এনে দিয়েছে তার অপব্যবহারই মানবকে দানবে পরিণত করেছে।
শক্তিমদে মত্ত হয়ে মানুষ আপন স্বভাব ভুলতে বসেছে। মানুষের সবকয়টি রিপু দিনে
দিনে অতিমাত্রায় উগ্র হয়ে উঠছে, মানুষ মনুষ্যোচিত ব্যবহার ভুলে যাচ্ছে।
দেখেশুনে মনে হয় প্রাণিজগতের শ্রেষ্ঠ জীবটি এখন ঠিক প্রকৃতিস্থ অবস্থায়
নেই। পঞ্চাশ বছর পূর্বে রবীন্দ্রনাথ সভ্যতার সংকট সম্পর্কে সাবধান বাণী
উচ্চারণ করেছিলেন। আজ সেই সংকট অনেক বেশি গুরুতর আকারে ধারণ করেছে। কোনো
যাঁরা সমাজপতি হয়ে বসে আছেন তারাই অ্যান্টি সোশ্যাল বা সমাজবিরোধী যাঁরা
শাসন ক্ষমতার অধিকারী তাঁরা নিজেরাই দুঃশাসন। শুধু অনুন্নত দেশেই নয় উন্নত
দেশসমূহেও সমাজের বাঁধন শিথিল। আচার-আচরণ ঠিক সভ্যজনোচিত নয়। আজ যাকে
সভ্যতা বলা হচ্ছে সেটা বিজ্ঞানের তৈরি একটা চক্চকে মোড়কে ঢাকা। ভেতরে পচন
ধরছে। মানুষই সভ্যতার বাহন সে মানুষ আজ সুস্থ নয়। উচ্চশিক্ষিত বিদ্বান
বিদগ্ধ মানুষের অভাব ঘটেছে এমন নয়। কিন্তু সুসভ্য সমাজে একদিন তাঁরা যে
প্রভাব বিস্তার করেছেন, আজকের সমাজে তাঁর সে প্রভাব নেই। আজকে প্রভাব–
প্রতিপত্তি সমস্তই রাজনীতির করায়ত্ত। সে রাজনীতি আবার নীতিবিহীন
দুর্নীতিগ্রস্ত। আরেকটি মজার কথা হলো : ফরাসি বিপ্লব ও রুশ বিপ্লব দুটিই
গেল ভেস্তে কিন্তু বিপ্লব ছড়িয়ে পড়েছে সারা দুনিয়ায় বিশেষ করে দরিদ্র
দেশসমূহে। প্রাকবিপ্লব যুগে দরিদ্রদের করেছে ধনীরা করেছে শোষণ তাদের অসহায়
অবস্থার সুযোগ নিয়ে। আখেরে তাদের করছেন রাজনৈতিক নেতারা, সংখ্যাগুরু
সর্বহারাদের ভোটের লোভে। সর্বহারাদের সর্বেসর্বা করার লোভ দেখানো হচ্ছে
প্রচুর; কিন্তু তাদের অবস্থার খুব একটা উন্নতি হচ্ছে তেমন লক্ষণ লক্ষ্যগোচর
নয়।
একে বলে বিপ্লব সধফব বধংু। মারামারি-হানাহানি আর খুবখারাবির নাম
হয়েছে বিপ্লব। বড়ো জিনিসকে সস্তা করে দিলে শেষ পর্যন্ত সে বহুগুণ তার মূল্য
আদায় করে নেয়। সারা দুনিয়া জুড়ে আজ লন্ডভন্ড কাণ্ড চলছে। এ সমস্তই
বিপ্লবের বিকারগ্রস্ত রূপ। রোয়ান্ডায় মাত্র দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে দশ লক্ষ
লোকের নিধনযজ্ঞ সম্পন্ন হলো। ইরাক যুদ্ধে অমানবিকভাবে নির্বিচারে নারী ও
শিশু হত্যা করা হলো। এছাড়া ঘরবাড়ি ছেড়ে প্রাণভয়ে পলায়মান হাজার হাজার লোক
আশ্রয় নিয়েছে নিরাশ্রিতের শিবিরে। পশুদের জন্য যেমন অভয়ারণ্য তৈরি হয়েছে
আজকের যত সব রিফিউজি ক্যাম্প হয়েছে, অসহায় মানুষের অভয়ারণ্য অর্থ মানুষকে
পশুর পর্যায়ে নামানো হয়েছে। কাম্বোডিয়ায় খেমারুজ গরিলা বাহিনীর অধিনায়ক
পলপট ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৭৯– এই পাঁচটি বছরে দশ লক্ষ লোক হত্যা করেছেন।
মানুষের মুক্তির নামে এবং বিধনরমেধ যজ্ঞ চলছে পৃথিবীর নানা দেশে। মানুষের
জীবনকে যারা কানাকড়ির মূল্য দেয় না তারাই হয়েছে মানুষের মুক্তিযোদ্ধা। যে
কবি বলেছিলেন সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই তাঁর চাইতে বড়ো বিপ্লবী
আর কে? আজকের বিপ্লবীদের হাতে সে মানুষের কী দশাই হয়েছে।
বিপ্লবের
স্বভাবের মধ্যেই একটা লোক দেখানো আতিশয্য আছে। ফরাসি বিপ্লব ও রুশ বিপ্লব
দুটিরই অত্যন্ত করতে গিয়ে জীবন্ত ঘটেছে। ফরাসি বিপ্লব এত বেশি বাড়াবাড়ি
করেছে যে, আজ যিনি নেতৃত্বের শীর্ষে, কাল তাঁর শিরñেদ হয়েছে। দশটি বছরও
যায়নি দেশবাসী অতিষ্ঠ হয়ে বিপ্লবের উপরে আস্থা হারান সম্পূর্ণরূপে।
দেশব্যাপী বিশৃঙ্খলা দমনের জন্য শাসনভার অর্পণ করা হলো তিন কনসাল-এর হাতে।
একজন সুদক্ষ সেনাধ্যক্ষ হিসেবে নেপোলিয়ান হলেন ফার্স্ট বা প্রধান কন্সাল
(১৭৮৯)। কিন্তু অত্যন্ত কাল পরেই কন্সাল ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে নেপোলিয়ান শাসন
ক্ষমতা পুরোপুরি নিজের হাতে নিয়ে নিলেন। এবং এর মাত্র পাঁচ বছর পরে (১৮০৪)
নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করে ফ্রান্সের সিংহাসনে আরোহণ করলেন। কৌতুকের কথা
বলতে হবে ১৭৮৯-এ বিপ্লবের শুরু মাত্র পনেরোটি বছরের ব্যবধানে দেশে একচ্ছত্র
অধিপতির অধিষ্ঠান। মনে হয় অদৃষ্টের পরিহাসের চাইতেও বিপ্লবের পরিহাস
অধিকতর চমকপ্রদ। আপাতদৃষ্টিতে বিপ্লব বিফল হলেও এর লভ্যাংশ পুরোপুরি খোয়া
যায়নি। ফরাসি বিপ্লবের সাম্য-মৈত্রী ও স্বাধীনতার বাণী এক সময়ে সমগ্র
জগৎকেই অনুপ্রাণিত করেছে। সে কৃতিত্ব তাকে দিতে হবে। স্বল্পস্থায়ী সে
বিপ্লব ফরাসি জীবনেও ব্যর্থ হয়নি। আজ দুশো বছর পরেও ফরাসি মনে তার রেশ থেকে
গিয়েছে। ফরাসি শিক্ষা-সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্যকে বর্ণাঢ্য করে রেখেছে।
রুশ
বিপ্লব ফরাসি বিপ্লবের অনুরূপ। ফ্রান্সে বুরবোঁ রাজত্বের অবসান, রাশিয়ায়
জারবংশের বিনাশ। মানুষের কল্যাণ মূর্তি হওয়াই বাঞ্ছনীয় কিন্তু বিপ্লবের
মেজাজটাই তিরিক্ষি। পাছে বিন্দুমাত্র বিরোধ-বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় সেজন্য রুশ
বিপ্লব প্রথমাবধিই রক্তচক্ষু রুক্ষভাষী, উদ্যত মুষ্টি। মুখে বললে কি হবে
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হউক। বহু নিরপরাধ ব্যক্তির রক্তপাতে কলঙ্কিত বলে সে
অভিশাপগ্রস্ত। কারণ দুটি বিপ্লবের একটি দীর্ঘজীবী হতে পারেনি। মাঝপথেই ঊরু
ভঙ্গ হয়েছে গন্তব্যস্থলে গিয়ে পৌঁছতে পারেনি। একটি বিপআলবের ও পূর্ণ পরিণত
রূপটি দেখার সৌভাগ্য কারও হয়নি। মানুষের মনে নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত করে
দিয়েছে, সে আপন পাওনা দাবি করতে শিখেছে এবং সে দাবি পূরণের জন্য সংগ্রাম
করতেও প্রস্তুত হয়েছে। মনস্কাম সিদ্ধ না হলেও মনকে যে জাগিয়েছে এটাই একটা
মস্ত বড়ো লাভ। জাগ্রত মন কীভাবে কাজ করছে তাই দিয়ে বিচার করতে হবে বিপ্লবের
সার্থকতা বা ব্যর্থতা। ফরাসি বিপ্লবের পরে দুশো বছর কেটে গিয়েছে কিন্তু
তার প্রভাব বহুকাল মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। পঞ্চদশ শতকের রেনেসার্স-এর
ন্যায় ফরাসি বিপ্লবও একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক রেনেসার্স-এর কাজ করেছে।
অনুন্নত দেশসমূহেও লোকের চিন্তায় কর্মে একটা উদার দৃষ্টিভঙ্গি এনে দিয়েছিল।
এ দুটি রেনেসার্স অর্থাৎ একটির সাহিত্য দর্শন শিল্পরস অপরটির সামাজিক–
রাজনৈতিক চেতনার সঙ্গে অষ্টাদশ শতকের শিল্পবিপ্লবকে যুক্ত করলেই আধুনিক
সভ্যতার পূর্ণ রূপটি ফুটে উঠবে।
রুশ বিপ্লবের আরম্ভটা যেমন আড়ম্বর করে
হয়েছিল তেমনি আড়ম্বর করেই সে নিজের হাতেই নিজের বিলোপ সাধন করল। মনে হয়
সমস্ত জিনিসটাই তার পক্ষে দুর্বহ হয়ে উঠেছিল। শোকাবহ ব্যাপার বলতে হবে। তবে
সান্ত্বনার কথা এই যে এত বড়ো একটি সৃষ্টি সম্পূর্ণ লোপ পেতে যথেষ্ট সময়
লাগে। ফরাসি বিপ্লব সম্পর্কে যে কথা বলেছি, রুশ বিপ্লব সম্পর্কেও সে কথা
প্রযোজ্য। অম্বু মধ্যমস্থ ক্ষীরটুকু যাঁরা গ্রহণ করতে জানেন তাঁরাই বুঝবেন
যে আপাতদৃষ্টিতে মৃত্যুবরণ করলেও রুশ বিপ্লব আরও বহুকাল মানবসমাজে বড়ো
রকমের প্রভাব বিস্তার করবে। সমাজ জীবনকে সম্পূর্ণ নতুন করে ঢেলে সাজানোর
জন্য যে পরিকল্পনা গ্রহণ যথেষ্ট নয়। পরিকল্পনাটি এতই বৃহৎ, এতই জটিলতাপূর্ণ
এবং কষ্টসাধ্য যে পূর্ণ পরিণতি লাভের সময় এবং সুযোগ সে পায়নি। বরং
তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ভুল– ভ্রান্তি ঘটেছে। প্লেটোর রফবধষরংঃরপ রাষ্ট্রচিন্তা
এবং মার্কস– এর সধঃবৎর-ধষরংঃরপ সমাজ দর্শনে সময়ের ব্যবধান আড়াই হাজার
বছরের। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবধান সে তুলনায় বহুগুণে বেশি। পুরাতন সমাজের
গঠন এবং সমাজ ব্যবস্থাকে আমূল উৎপাদিত করে সম্পূর্ণ নতুন এক মানবসমাজ
গঠনের কল্পনা রচনা করেছিলেন, তাকে যথাযথভাবে রূপ দিতে পারলে সারা পৃথিবীতে
সত্যই যুগান্তর ঘটতে পারত। মননশীলতা, দূরদৃষ্টি এবং আদর্শনিষ্ঠার মিলনে
পরিকল্পনাটি একটি অত্যাশ্চর্য জিনিস। এই প্রথম একটি আদর্শ রাষ্ট্র এবং
সমাজের সুস্পষ্ট পরিকল্পনা পৃথিবীর জনগণের সম্মুখে তুলে ধরা হলো। প্রতিটি
সংকল্পই বৈপ্লবিক। প্রথম পদক্ষেপেই দেখা গেল রুশ নেতৃবর্গ আপন দেশের নামটি
বর্জন করে সোভিয়েত দেশ নাম গ্রহণ করেছেন। নিঃসন্দেহে একটি অতি দূরদর্শী
আদর্শবাদী সংকল্প। সোভিয়েত অর্থাৎ খেটে খাওয়া মজদুর এবং সৈনিক কর্মীদের
দ্বারা গঠিত কাউন্সিল পরিচালিত যে দেশ শাসিত তারই নাম সোভিয়েত দেশ। অপর
যেকোনো দেশ এই শাসনব্যবস্থায় বিশ্বাসী তারা এসে যোগ দিয়ে সোভিয়েত দেশের
অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে। ভিন্ন ভিন্ন দেশ থাকবে না, ভিন্ন ভিন্ন জাতি থাকবে
না। একে একে সকল দেশ এসে যোগ দিলে সমস্ত পৃথিবীব্যাপী একটি মাত্র দেশ এবং
একটি মাত্র জাতি গড়ে উঠবে। কবি জনোচিত কল্পনা নিয়ে যাঁরা ড়হব ড়িৎষফ– এর
স্বপ্ন দেখে আসছিলেন এটি তার প্রথম বাস্তব পদক্ষেপ। রুশ বিপ্লবের বেশ কিছু
কাল আগে রবীন্দ্রনাথ যখন নৈবেদ্যর কবিতায় বলেছিলেন যেথা গ্রহের প্রাচীর আপন
প্রাঙ্গন তলে দিবস শর্বরী/বসুদারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি তখন মনে হয়
কবি কল্পনায় তিনি এই সোভিয়েত দেশের কথাই ভেবেছিলেন। বিশ্বভারতীর পরিকল্পনা
কালে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন আমাদের একটি মাত্র দেশ সে দেশের নাম বসুন্ধরা
একটি মাত্র জাতি সে জাতির নাম মনুষ্য জাতি।
লক্ষ করার বিষয় যে কয়টি দেশ
স্বেচ্ছায় এসে সোভিয়েত দেশে যোগ দিয়েছিল তারা কেউ স্বদেশের নাম এবং
স্বজাতির পরিচয়টি বর্জন করেনি। প্রত্যেকেই নিজ নিজ পৃথক অস্তিত্ব বজায়
রেখেছে। মিলটা ঠিক দানা বাঁধেনি। গোড়াতেই গোঁজামিল দেখা দিয়েছে এবং
গ্রন্থি শিথিল থেকে গিয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আশা করা গিয়েছিল প্রতিটি
অঙ্গরাজ্যের অভ্যন্তরীণ শাসনকার্য চলবে জেলা সোভিয়েত দেশসমূহের পরিচালনায়।
কিন্তু সম্মিলিত রাজ্যসমূহ সমেত সমগ্র সোভিয়েত ভূমির যাবতীয় বিধিবিধান ও
শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হবে মস্কোস্থিত কেন্দ্রীয় শাসনগোষ্ঠীর দ্বারা।
স্বভাবতই ধরে নিতে হবে যে, অঙ্গভূত প্রতিটি দেশের প্রতিনিধি কেন্দ্রীয়
মন্ত্রিসভায় এবং সোভিয়েত পালার্মেন্টের সদস্য হিসেবে যুক্ত থাকবেন। সেটি
যথোচিতভাবে হয়েছিল কি? মস্কোর আত্যন্তিক ডিক্টেটরি শাসনের উত্তাপে কোথাও
কোথাও উষ্মার সঞ্চার হয়েছে, মাঝে মাঝে সংবাদপত্রে তার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে।
যা
হোক, রাষ্ট্র পরিচালনায় অন্যান্য বিধিবিধান যা রচিত হয়েছিল তা যেমন অভিনব
তেমনি ন্যায়সংগত। ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে কিছু থাকবে না। দেশের সমস্ত
সম্পত্তির স্বত্বাধিকারী হবে রাষ্ট্র অর্থাৎ ওই সম্পত্তির বিলি ব্যবস্থা
করবে সোভিয়েত কাউন্সিলসমূহ। ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ সাধনই একটা মস্ত বড়ো
বিপ্লব। বহুকাল যাবৎ সঞ্চিত ধন বঞ্চিতের প্রতি যে অন্যায়-অবিচার করে
এসেছে, এই প্রথম তার মূলে আঘাত করা হলো। সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে এটি
এক দুঃসাহসিক পদক্ষেপ। সকল শুভ কর্মেরই উদ্দেশ্য লোকহিতায়। লোকহিতের পথ
উন্মুক্ত হলো। দেশের ধন এখন দশের ভোগে লাগবে। প্রত্যেকটি পরিবারের প্রয়োজন
অনুযায়ী অন্ন-বস্ত্র ও বাসগৃহের ব্যবস্থা হবে। প্রতিটি মানুষকে খেটে খেতে
হবে। বিদ্যা-বুদ্ধি সামর্থ্য অনুযায়ী প্রত্যেককে যথাযোগ্য কাজে নিয়োজিত করা
হবে। কেউ বেকার বসে থাকবে না। জনশিক্ষা দেশব্যাপী হবে, নিরক্ষর কেউ থাকবে
না। শিক্ষার দায়িত্বও সরকারের। বিনা চিকিৎসায় কারও প্রাণ যাবে না।
দরিদ্রের
দুর্বলের অক্ষমের অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে বিবেকহীন সমাজ যুগ যুগ ধরে যে
অন্যায়কে পোষণ করে এসেছে তার অবসান হতে চলল। প্রতিটি মানুষের মুনুষ্যেচিত
জীবনযাপনের এমন সুচিন্তিত ও সুবিস্তীর্ণ আয়োজন সাধারণ মানুষ আগে সৃষ্টি
করেছিল। কবির ভাষায় তিমির বিদার উদার অভ্যুদয় এর আভাস দেখা দিয়েছিল প্রতিটি
পদক্ষেপই সুদূরপ্রসারী শুভ সম্ভাবনাময়। ধনী-দরিদ্র ভেদ থাকবে না, উচ্চ-
নীচ ব্যবধান থাকবে না। সকলের সমান অবস্থা বলে একে অন্যের বিরুদ্ধে
ঈর্ষা-বিদ্বেষ পোষণ করবে না। সকলেই মেহনতি মানুষ, খেটে খাবে, কাজেই
ছোটো-বড়ো ভেদও থাকবে না। হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-অহংকার ইত্যাদি দুষ্ট রিপু
থেকে মুক্ত হয়ে নতুন যুগের আবির্ভাব হবে, এরূপ আশা করা কিছু অস্বাভাবিক ছিল
না। রুশ বিপ্লবের অপর একটি কাজ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অশিক্ষিত,
কুসংস্কারাচ্ছন্ন দরিদ্র জনগণকে নানাভাবে শোষণ এবং শাসন করার জন্য সমাজের
অর্থবান, স্বার্থপর ও ধুরন্ধর সম্প্রদায় নানাবিধ উপায় উদ্ভাবন করেছিল। ধর্ম
ছিল এদের হাতে একটি প্রধান হাতিয়ার। ধর্মের দোহাই দিয়ে উৎপীড়ন বঞ্চিতদের
বোঝানো হতো কী করবে বাপু, আগের জন্মে বোধ করি কোনো পাপ করেছিল, এ জন্মে
কষ্ট ভোগ করে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে। কিচ্ছু ভেবো না, পাপের মোচন হয়ে
গেলে পরজন্মে পরম সুখে থাকবে। সরল প্রাণ ধর্মান্ধরা ওই আশ্বাসের বিশ্বাসেই
সকল দুর্ভোগ সয়ে যেত। বিপ্লবের সবচাইতে বড়ো শত্রু ধর্মকে সোভিয়েত ভূমি
থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। বিপ্লবী কার্যক্রমের মধ্যে এটিই সবচাইতে
বিপ্লবাত্মক পদক্ষেপ। শোষণের এবং বঞ্চনার সবচাইতে বড়ো হাতিয়ারটিকে
নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়েছে। এর চাইতেও বড়ো কথা রুশ বিপ্লব এই মহাসত্যটি
প্রচার করেছে যে, মানুষের পরিচয় একমাত্র মানুষ হিসেবেই হিন্দু- মুসলমান,
বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান হিসেবে নয়। বিশেষ কোনো ধর্মাবলম্বী হওয়া অতি সহজ কিন্তু
মানুষ-হওয়া বড়ো কঠিন। হিন্দু, মুসলমান বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সংখ্যায় অগণিত
কিন্তু প্রচারের জিনিস নয় আচরণের জিনিস। দৈনন্দিন জীবনে চিন্তায়, কর্মে ও
আচরণে সত্যিকারের ধার্মিক মানুষ কয়জন? যথার্থ ধর্মবোধ যদি থাকত তাহলে
পৃথিবীময় নিত্যদিন এত অসৎ কর্ম চুরি-জোচ্চুরি, ডাকাতি, খুনখারাবি চলছে কী
করে? মানুষ ধর্মের নামে যে মিথ্যা মুখোশটি পরে আছে রুশ বিপ্লব সে মুখোশটি
খুলে দিয়েছিল। মস্ত বড়ো কাজ বলতে হবে কোনো সংসারে ধর্মের নামে যত অধর্মের
কাজ ঘটে এমন আর কিছুতে নয়। এখন আবার ৎবষরমরড়ঁং ভঁহফধসবহঃধষরংস নামে এক
বিচিত্র আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছে। বিপ্লব সভ্যতার যে পথ নির্দেশ করেছিল, এই
আন্দোলনটি প্রশ্রয় পেলে মানুষের ইতিহাস আবার বর্বরতার দিতে মোড় নেবে। বহু
যুগ লালিত অযৌক্তিক অভ্যাস-বিশ্বাসের বিলোপ সাধনই যথার্থ বিপ্লব। রুশ
বিপ্লব অনেক দিন থেকেই মানুষের চোখ ফুটিয়ে দিয়েছিল। এই যে দেশ-জাতি ধর্মের
বিভেদবিহীন পৃথিবীব্যাপী এক সম্মিলিত মনুষ্য জাতির পরিকল্পনা হয়েছিল তা
কোথায় গেল তলিয়ে! সিদ্ধান্তগুলো সবই ছিল ঠিক তথাপি সিদ্ধি লাভ হয়নি।
সর্বজনের সন্তোষবিধায়ক যে সব পেয়েছিল দেশকে এত করে আবাহন করা হয়েছিল মনে হয়
তাকে দোরগোড়া থেকে বিদায় করে দেওয়া হলো। পৃথিবী জুড়ে কোটি কোটি মানুষের
মনে যে আশার আলোটি জ্বলে উঠেছিল সেটি নিভে গেল। রুশ নেতৃবর্গ ভুল করেছিলেন।
ভুল পথনির্দেশ নয়, ভুল পদ-যাত্রায় পথ চলতে গিয়ে। বোধের ঢ়ৎরড়ৎরঃু অভাবে
আগের কাজ আগে না করে শেষের কাজে হাত দিয়েছেন অসময়ে। দরিদ্র দেশ নিত্য
ব্যবহার্য অতি সাধারণ জিনিসও ফাউন্টেন পেনটা রিস্ট ওয়াচটা বহু জনের কাছেই
বিলাস দ্রব্য হিসেবে গণ্য তাদের নাগালের বাইরে। সে দেশে অভাবক্লিষ্ট জনগণের
কথা ভেবে অভ্যন্তরীণ আর্থিক অবস্থাটাকে সুদৃঢ় করে দেওয়াই ছিল সর্বপ্রথম
কর্তব্য। কিন্তু ওই যে বলেছি বিপ্লবের স্বভাবেই আছে আচমকা পিলে চমকে দেওয়ার
সস্তা দোষ। আপন ঘর-গেরস্তালির চিন্তা ছেড়ে গেল মহাশূন্য পরিক্রমায়।
ইতোমধ্যে আণবিক বোমার ফরমুলাটি হস্তগত করে হাত দিয়েছে এ যুগের ব্রহ্মাস্ত্র
অ্যাটম বোমা তৈরিতে। কোটি কোটি টাকা যা দরিদ্র জনগণের অভাব মোচনে ব্যয় হতে
পারত তা এখন বিলাসব্যসনে ব্যয় হতে লাগল। বিপ্লবী দেশের পক্ষে এটাকে
বিলাসিতাই বলব। আসল কথা ততদিনে রুশ বিপ্লবের বিপ্লবী চরিত্রটিই খোয়া
গিয়েছে। বাস্তবিকপক্ষে তার সত্তর বছরের শেষ পঁচিশ বছর সে প্রধানত
সর্বক্ষেত্রে খোয়া গিয়েছে। বাস্তবিকপক্ষে তার সত্তর বছরের শেষ পঁচিশ বছর সে
প্রধানত সর্বক্ষেত্রে আমেরিকার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। অভীষ্ট
সিদ্ধ হয়েছে। আমেরিকা এবং রাশিয়া উভয়েই সমকক্ষ সুপার পাওয়ার হিসেবে গণ্য
হয়েছে। ফরাসি বিপ্লবের বেলায় যেমন রাজবংশ নিপাতের অনতিকাল পরেই আবার
একচ্ছত্র সম্রাটের অভ্যুত্থানকে বলেছি ইতিহাসের পরিহাস বিপ্লবী রাশিয়ার
সুপার পাওয়ারে পরিণতিও তেমনি ইতিহাসের এক নিষ্ঠুর পরিহাস। নিষ্ঠাচ্যুত হয়ে
বিপ্লবীরাই বিপ্লবকে বিনষ্ট করে। দুটি বিপ্লবকেই আত্মঘাতী বলা চলে।
সবাইকে ২০২৬ শুভ নববর্ষ
