একটি
জাতির শক্তি শুধু তার জনসংখ্যায় কিংবা অর্থনীতিতে নয়; বরং জাতির প্রকৃত
শক্তি লুকিয়ে থাকে তার ভেতরের সংহতির রূপরেখায়। যে জাতি একে অপরের কাঁধে
কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতে পারে, পাহাড়সম সংকটও তাদের সামনে ছোট হয়ে যায়। আর যখন
সেই কাঁধগুলো আলাদা হয়ে যায়, তখন সামান্য ধাক্কায়ই ভেঙে পড়ে রাষ্ট্র, সমাজ ও
সভ্যতা। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে তার পরতে পরতে দেখা যায়, যে জাতি ঐক্য
হারিয়েছে, সে জাতি শুধু ক্ষমতাই হারায়নি; হারিয়েছে মর্যাদা, নিরাপত্তা ও
ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের স্বপ্নও।
ইসলাম ঐক্যকে কোনো ঐচ্ছিক নৈতিকতা হিসেবে
দেখেনি; বরং একে ঈমানি ফরজের মূল্যায়ন করেছে। কারণ আল্লাহ ভালো করেই জানেন,
ভাঙা জাতি কখনো আল্লাহর আমানত রক্ষা করতে পারে না।
কোরআনের সরাসরি
নির্দেশে ঐক্য পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেন,
‘তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং পরস্পর বিভক্ত হয়ো না।’
(সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০৩)
এই আয়াতে ‘আল্লাহর রজ্জু’ বলতে কোরআন, দ্বিন ও সম্মিলিত আনুগত্যকে বোঝানো হয়েছে, যা মানুষকে এক সুতায় বেঁধে রাখে।
ঐক্য
এখানে শুধু সামাজিক প্রয়োজন নয়; এটি সরাসরি আল্লাহর নির্দেশ। ফলে বিভক্তি
শুধু রাজনৈতিক দুর্বলতা নয়; এটি দ্বিনি অবাধ্যতারও শামিল।
বিভক্তি জাতিকে কিভাবে দুর্বল করে কোরআনের বিশ্লেষণ
আল্লাহ
তাআলা সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করো এবং
পরস্পর ঝগড়া করো না, তাহলে তোমরা সাহসহারা হয়ে যাবে এবং তোমাদের শক্তি
নিঃশেষ হয়ে যাবে।’ (সুরা : আল-আনফাল, আয়াত : ৪৬)
এই আয়াত জাতির পতনের
একটি সুস্পষ্ট সূত্র তুলে ধরে পরস্পর বিবাদ থেকে জাতির মধ্যে দুর্বলতা তৈরি
হয়, যা একসময় তাদের সব শক্তির বিলুপ্তি ঘটায়।
এখানে ‘শক্তি’ বলতে শুধু
সামরিক বা রাজনৈতিক ক্ষমতা নয়; বরং আত্মবিশ্বাস, নৈতিক দৃঢ়তা এবং আল্লাহর
সাহায্য সবই এর অন্তর্ভুক্ত। যখন অন্তরে বিদ্বেষ জন্মায়, তখন আল্লাহর
নুসরাত সরে যায়; আর সেটিই সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।সুন্নাহর আলোকে ঐক্যহীনতার
ভয়াবহতা
রাসুলুল্লাহ (সা.) উম্মাহর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সতর্ক করে বলেছেন,
‘তোমরা পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ কোরো না, সম্পর্ক ছিন্ন কোরো
না...আল্লাহর বান্দা হিসেবে ভাই ভাই হয়ে থাকো।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৫৬৩)
অন্য
এক হাদিসে তিনি বলেন, ‘মুমিনগণ পরস্পরের জন্য একটি দেহের ন্যায়; দেহের
একটি অঙ্গ ব্যথিত হলে পুরো দেহ জ্বরে আক্রান্ত হয়।’ (বুখারি, হাদিস : ৬০১১)
এই হাদিসগুলো দেখায় যে, উম্মাহর ভেতরের সম্পর্ক যদি দেহের মতো সংহত না থাকে, তাহলে সামান্য আঘাতেই পুরো জাতি অসুস্থ হয়ে পড়ে।
বিভক্তিতে পতন ও ঐতিহাসিক করুণ পরিণতি
ইসলামের
ইতিহাসে আন্দালুস বা মুসলিম স্পেন ছিল জ্ঞান, সভ্যতা ও ক্ষমতার এক উজ্জ্বল
দৃষ্টান্ত। কিন্তু যখন সেখানে গোত্র, ক্ষমতা ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব প্রকট
হলো, তখন মুসলিমরা একে একে ছোট রাজ্যে বিভক্ত হয়ে গেল। তখনই একটি একটি করে
শহরের পতন হলো আর শেষ পর্যন্ত পুরো আন্দালুস হাতছাড়া হলো।
একই চিত্র
দেখা যায় আব্বাসীয় যুগের শেষ ভাগে। অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ক্ষমতার লড়াই ও
পারস্পরিক বিশ্বাসঘাতকতা বাগদাদের পতন ত্বরান্বিত করেছিল। ইতিহাস এখানে
একটাই শিক্ষা দেয়, বাইরের শত্রু শেষ আঘাত করেছে, কিন্তু ভেতরের বিভক্তিই
দরজা খুলে দিয়েছিল।
পবিত্র কোরআন বলে, ‘নিশ্চয়ই শয়তান চায় তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে।’ (সুরা : আল-মায়িদা, আয়াত : ৯১)
যখন
সমাজ বিভক্ত থাকে, তখন শত্রুর আর অস্ত্র লাগে না; গুজব, সন্দেহ ও উসকানিই
যথেষ্ট। একে অপরকে অবিশ্বাস করা জাতি কখনো দীর্ঘদিন স্বাধীন থাকতে পারে না।
কারণ বিভক্ত জাতি নিজেরাই নিজেদের শক্তি ক্ষয় করে ফেলে।
কাজেই ধৈর্য ও
নৈতিক সংযমের মাধ্যমে ঐক্য রক্ষা করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই
আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা : আল-বাকারাহ, আয়াত : ১৫৩)
ঐক্য
মানে এমন নয় যে মতভেদ থাকবে না; বরং ঐক্য মানে হলো মতভেদের পরও সম্পর্ক,
ন্যায়বোধ ও দায়িত্ববোধ অটুট রাখা। এটি সহজ নয়; এ জন্য দরকার সবর, আত্মসংযম ও
আল্লাহভীতি। কিন্তু এই কঠিন পথই জাতিকে টিকিয়ে রাখে।
ঐক্যই দেশপ্রেমের সবচেয়ে বড় প্রমাণ
সুজলা-সুফলা
এই দেশ আমাদের শুধু জন্মভূমি নয়; এটি মহান রবের দেওয়া একটি আমানত। এই
মাটিতে মিশে আছে আমাদের ইতিহাস ও লাখো শহীদের রক্ত, জড়িয়ে আছে ভবিষ্যৎ
প্রজন্মের স্বপ্ন। যদি আমরা নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থে বিভক্ত হই, তাহলে
ক্ষতিটা কিন্তু হবে এই দেশেরই।
এই প্রিয় ভূখণ্ডের জন্য আমাদের আবেদন
একটাই—হে আল্লাহ, আমাদের অন্তরগুলোকে এক করুন। আমাদের মতভেদকে শত্রুতায় রূপ
নিতে দেবেন না। আমরা এই দেশকে ভালোবাসি বলেই বিভক্ত হতে চাই না। কারণ ঐক্য
হারালে জাতি দুর্বল হয়, অতএব ঐক্য রক্ষা করাই হলো দেশের প্রতি সবচেয়ে
নিঃস্বার্থ ভালোবাসা।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে দেশের প্রয়োজনে ভিন্ন মত ভিন্ন পথ নিয়েও জাতীয় স্বার্থে এক হয়ে কাজ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
