
১৯৭১ সাল। ১৬
ডিসেম্বর। সে দিন যারা বিজয় দেখেছে, তাদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, জীবনের
শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত কী। নিশ্চিতভাবে বলবে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়। এই মানুষগুলো
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৌভাগ্যবান। তারা একটি জাতির বিজয় দেখেছে। আবার তাদেরই আছে
সীমাহীন বেদনা। কারণ তাদেরই দেখতে হয়েছে পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম গণহত্যা। বর্বর
বাহিনীর নৃশংসতা দেখে তারা যদি মানব জাতির ওপর বিশ্বাস হারাত তাহলেও অবাক
হওয়ার কিছু ছিল না। তবে কখনো কখনো বিভীষিকা ঢাকা পড়ে আনন্দের স্মৃতিতে।
আবার
দুঃসময়ও চিরদিন থাকে না। ডিসেম্বর থেকে পাল্টে যেতে থাকে যুদ্ধের গতি।
দখলদার বাহিনীর পরাজয়ের খবর আসতে থাকে। আকাশে যুদ্ধবিমানের ডগফাইট। রাস্তায়
যৌথ বাহিনীর কনভয়। পিচঢালা পথে ট্যাংক। কামানের গর্জন। স্থানীয় রেডিওতে
বারবার পাকিস্তান বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হচ্ছে। আকাশ থেকে ফেলা
হচ্ছে লিফলেট।
মানুষ বুঝতে পারল যুদ্ধ মানে শুধু গোলাগুলি নয়। নির্মম
হত্যাকাণ্ড নয়। এটা একটা প্রচণ্ড মানসিক চাপও। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর
পাকিস্তান বাহিনী, যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
১৬
ডিসেম্বর বাঙালি জাতির জন্য মৃত্যুঞ্জয়ী একটি দিন। হানাদার বাহিনীর কাছে
থেকে বিজয় ছিনিয়ে আনার দিন। লাখো শহিদের রক্ত দিয়ে অর্জিত এ বিজয়। এর মূল্য
অসীম। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ হয়। তারপর আসে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর। সৃষ্টি হয়
ইতিহাস। পৃথিবীতে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের।
জানি
না, সে দিন সেই শীতের অপরাহ্নের আকাশ, রেসকোর্স ময়দান, প্রকৃতি কেমন ছিল।
পাওয়া ও না পাওয়ার আনন্দ-বেদনায় কি করছিল মানুষেরা। এ দিন বিকেলে মাথা নিচু
করে হাজার হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছিল। লে. জেনারেল আমীর
আবদুল্লাহ খান নিয়াজি আত্মসমর্পণ দলিলে সই করতে চায়নি। তাকে সই করতে বাধ্য
করা হয়েছিল।
অথচ যুদ্ধের শরুতে পাকিস্তান মিথ্যাচার করত। তারা বলত যে
বাংলাদেশ নামে কিছু নেই। সবই অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র। সে সময় অস্থায়ী সরকার
ছিল প্রবাসী সরকার। তারা মিথ্যাচারের জবাব দিতে বাংলাদেশের মাটিতে শপথ
গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। কুষ্টিয়া জেলার বৈদ্যনাথ তলার আম বাগানে ১৭ এপ্রিল
শপথ গ্রহণ করে।
বিজয় সব সময় আনন্দের। তবে কোনো কোনো বিজয়ের সঙ্গে থাকে
গভীর বিষাদ। বড় বেশি মূল্য দিতে হয়েছিল আমাদের বিজয়ের জন্য! বাংলার মাটিতে
চালানো হয় পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম গণহত্যা। মা-বোনের সম্ভ্রম হারাতে হয়। নির্মম
হত্যা কাণ্ডের শিকার হয় বুদ্ধিজীবীরা। এখানেই শেষ না। বঙ্গবন্ধু তখনো
পাকিস্তানের কারাগারে। কেউ জানে না প্রহসনের বিচারে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে
না বেঁচে আছেন। একাত্তরের ১০ এপ্রিল যেসব নেতা মুজিবনগর অস্থায়ী সরকার গঠন
করেছিলেন, ২২ ডিসেম্বর তারা কলকাতা থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরেন। সে দিনই
সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশের বিজয় এখনো অসম্পূর্ণ। বঙ্গবন্ধু ফিরে
না আসা পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে।’
গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, সামাজিক
মূল্যবোধ, মানবাধিকার অন্য দেশ এসব পেয়েছে সভ্যতার স্বাভাবিক অর্জন হিসেবে।
আর আমরা পেয়েছি লাখো মানুষের আত্মনিবেদনের মধ্য দিয়ে। কোটি মানুষের
স্বপ্নে, ত্যাগে, বীরত্বে রচিত হয়ছে বিজয়ের ইতিহাস। ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি
জাতির গৌরবের দিন। বিশ্বমানচিত্রে লাল-সবুজ পতাকার জন্মের দিন। বাঙালির
হাজার বছরের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ অর্জন। এ অর্জন এনে দিয়েছে জাতিসত্তা,
সংবিধান, মানচিত্র ও লাল-সবুজ পতাকা।
এই বিজয়ের জন্য ছিল দীর্ঘ রক্তমাখা অভিযাত্রা। এ দেশের মানুষ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছে। এবার বিজয়ের ৫৪তম বছর।
আজকের
বাংলাদেশের মানুষ কি সেই কাঙ্ক্ষিত বিজয়ের সুফল পেয়েছে? আমাদের বিজয়ের
দুটি লক্ষ্য ছিল– এক বিজয়, আরেকটি মুক্তি। বিজয় পেলেও আজও দেশের মানুষের
জীবনে মুক্তি আসেনি। মুক্তির জন্য হয়তো আরও বহু বছর সংগ্রাম চালিয়ে যেতে
হবে।
মহাকালের কাছে সময়ের হিসাব নেই। কিন্তু ব্যক্তি জীবনে আছে। একটি
জাতির অন্তর দর্শন ও তা নির্মাণের জন্য ৫৪ বছর যথেষ্ট সময় নয় কী? আমরা
কোথায় যাচ্ছি? কী আমাদের মূল্যবোধ কিছুই ঠিক হচ্ছে না। একজন মানুষের যেমন
একটি ব্যক্তিগত জীবন থাকে তেমনি একটি সামাজিক জীবন থাকে। এর প্রতিটি
ক্ষেত্রে দায়িত্ব, মূল্যবোধ, নিয়ম, অনুশাসন চর্চা করতে হয়। এসব উপাদান
জীবনকে মানবিক করে। মনে রাখা দরকার যে বস্তুগত দারিদ্র্যের প্রতিকার আছে।
কিন্তু আত্মার দারিদ্র্যের মুক্তি নেই। সমাজ থেকে আজ নৈতিকতা, মূল্যবোধ চলে
যাচ্ছে।
সত্যিকার দেশপ্রেমিক কখনো নিজের জন্য সুবিধা চায় না। তারা
দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করেন। দেশপ্রেমের একটা চিরন্তন অনিবার্যতা
আছে। এটা সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। নুর হোসেন, আসাদ, আবু সাঈদরা
কোনো সুবিধা চায়নি। আবার দুর্নীতিবাজ, ঠক ও প্রতারকের কাছে দেশপ্রেম হলো
শেষ অবলম্বন। এরা সুযোগ বুঝে দেশপ্রেমিক হয়ে রাষ্ট্রের ক্ষতি করে।
দুর্নীতি, অনিয়ম আর লুটপাট করে অঢেল সম্পদের পাহাড় গড়ে। আর মুখে দেশপ্রেমের
কথা বলে। এদের কঠিন শাস্তি দিতে হবে।
অথচ দেশপ্রেমই জাপানিদের জাতীয়
অহংকার। তারা উন্নত পণ্য তৈরি করে। সব ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল আচরণ করে। এর
মাধ্যমে তাদের দেশপ্রেম প্রকাশ পায়।
একটি দেশ মায়ের মতো। তাকে শ্রদ্ধা
করতে হয়। ভালোবাসতে হয়। সে মা এত কষ্টে থাকলে সামনে এগোনো যায় না। মায়ের এত
দুর্বলতা নিয়ে শক্তিশালী হওয়া যায় না। একতা ও বন্ধন জাতির অস্তিত্বের
অপরিহার্য দিক। একতা না থাকলে জাতি জনগণের গুচ্ছমাত্র। একসময়ে তারা
বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। আমাদের বিজয়ে কোন বন্ধন কাজ করেছিল? পরাধীনতা থেকে
মুক্তির আকাঙ্ক্ষাই ছিল একতা ও বন্ধনের শেকড়।
অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান
রাষ্ট্রের স্বার্থকে উপেক্ষা করে সম্পদের পাহাড় গড়েছে। তারা ভুলে যায়
রাষ্ট্র ভালো না থাকলে একদিন তাদেরও অস্তিত্ব থাকবে না। সবার সম্মিলিত
কাজের মধ্য দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র এগিয়ে যায়। আমরা দূরদর্শিতা, শক্তি ও
সাহসের অভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারছি না। প্রতিনিয়ত অন্যের ওপর দোষ
চাপানোর প্রবণতা তৈরি হয়েছে। এভাবে নিজের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য নিজের সঙ্গে
প্রতারণা করছি।
অধিকাংশ সময় অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারছি না। প্রায় সব
ক্ষেত্রে নীরব থাকি। এমন নীরবতার জন্য এক শ্রেণির মানুষ অন্যায়, অত্যাচার,
সন্ত্রাস করছে। সবচেয়ে নির্মম বাস্তবতা হলো যারা আইন মানেন না তারাই আইনের
রক্ষক। শুধু তাই নয়, আইন ভঙ্গকারী সব জায়গায় মর্যাদা আদায় করে। এ জন্য
খারাপ ও অসৎ মানুষ নেতৃত্বে আসছে।
অথচ মানুষ এখানেই আলাদা যে তারা
পরিস্থিতি বুঝতে পারে। প্রতিকূলতা আয়ত্তে আনতে পারে। দুর্ভাগ্য হলো আমরা
পরিস্থিতি বুঝতে পারছি না। আয়ত্তে আনতে পারছি না। কেবলই পিছিয়ে পড়ছি।
উটপাখি
বিপদ দেখে না। বিপদে বালুর মধ্যে মুখ লুকায়। আমরা অনেকেই উটপাখির মতো বিপদ
দেখি না। আর বিপদ না দেখলে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। স্বার্থপরের মতো সবকিছু
অগ্রাহ্য করতে থাকি। এ অবস্থার পরিবর্তন হতে হবে। সময়ের প্রয়োজনে কাউকে না
কাউকে এগিয়ে আসতে হবে। সেই কেউ হতে পারে এ দেশের তরুণরা। ৫২ থেকে ২৪
পর্যন্ত জাতির নানা সংকটে তারা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। তারুণ্যই হতে
পারে পরিবর্তনের প্রতিচ্ছবি। ‘২৪-এর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে তারা জীবন দিয়ে
পরিবর্তন এনেছে।
আমরা পরাজয়ের অংশ হতে চাই না। এখন সময় এসেছে চ্যালেঞ্জ
গ্রহণের। সবকিছু সাহসের সঙ্গে মোকাবিলার। যেকোনো মূল্যে দুর্বৃত্তদের রুখে
দিতে হবে। তাদের পরাজয় নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই আমরা বিজয়ের লক্ষ্য অর্জন
করতে পারব।
নিশ্চয়ই ভাবিষ্যতে আমাদের বিজয় আরও অর্থবাহ হবে। কোনো এক
সকালে ঘুম থেকে উঠেই হয়তো একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দেখব না। কিন্তু একদিন এই
বাংলাদেশ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরতম দেশ হবে। সেই স্বপ্ন দেখিৃ।
লেখক: কবি, সংগঠক ও সাংবাদিক
