বৃহস্পতিবার ১১ ডিসেম্বর ২০২৫
২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
শিক্ষাতত্ত্ব ও শিক্ষাচিন্তা
জুলফিকার নিউটন
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১:০৩ এএম আপডেট: ১১.১২.২০২৫ ১:৫৫ এএম |

 শিক্ষাতত্ত্ব ও শিক্ষাচিন্তা
শিক্ষার কিছু তত্ত্ব চিরকালের, আর কিছু সমস্যা সমকালের। সমকালীন অথচ শুধুই সমকালের নয়, এইরকম সমস্যা নিয়ে কয়েকটি কথা বলাই আমার প্রধান উদ্দেশ্য। সমস্যার অবতারণার আগে প্রাচীন ও আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার একটি মূল পার্থক্যের উল্লেখ করে নিলে পরবর্তী আলোচনার কিছুটা সুবিধা হতে পারে। প্রাচীন সমাজের বৃত্তিপ্রশিক্ষণের স্থান ছিল প্রধানত পরিবারে, আর উচ্চশিক্ষার স্থান গুরুগৃহে। কয়েকজন শিষ্যকে নিয়ে সেই গুরুগৃহ, গুরু সেখানে পিতৃতুল্য। আধুনিক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় আকারে অনেক বৃহৎ। এখানে এক একটি বিষয় পড়াবার জন্য আছেন এক একজন অধ্যাপক, এমনকি একই বিষয় খন্ড খন্ড করে একাধিক অধ্যাপকের ভিতর ভাগ করে দেওয়া হয়। ওস্তাদ কারিগর একটি সম্পূর্ণ মূর্তি অথবা শিল্পবস্তু নিজে প্রস্তুত করেন, তিনি শিল্পী। বৃহৎ শিক্ষপ্রতিষ্ঠানের সমগ্র কাজ বহু খন্ডে বিভক্ত; শ্রমিক ও বিশেষজ্ঞদের ভিতরে সেই কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়। প্রাচীন ব্যবস্থায় ছাত্রের সমগ্র শিক্ষার ভার এবং তাকে মানুষ করে তুলবার দায়িত্ব ছিল গুরুর হাতে। এযুগে অনিবার্য কারণে এক রকমের যান্ত্রিক কর্মবিভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রবেশ লাভ করেছে। আজকে অধ্যাপক গুরু নন, বরং বিশেষজ্ঞ। এ সব কথার কিছু ব্যতিক্রম দেখানো অসম্ভব নয়, কিন্তু সেটা ব্যতিক্রমই। মূল ঝোঁকটা বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা চলে বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। পুরনো ব্যবস্থায় আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। পটভূমিকার এই পার্থক্য মনে রাখলে আজকের দিনের একাধিক সমস্যার অর্থ আরো গভীরভাবে উপলদ্ধি করা যায়। 
সমাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান সন্বন্ধে কোনো সরল চিত্রই আজ আর সম্পূর্ণ সত্য নয়। শিক্ষাবিষয়ক আলোচনায় কখনও কখনও শোনা যায় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ হল বিদ্যা নামক একটি দ্রব্যের উৎপাদন, মান নির্ধারণ এবং পরিবেশন। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় একটা বিশেষ ধরনের বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তুল্য। পরন্তু এটা এমন এক প্রতিষ্ঠান যাতে সরকারী অনুদানের পরিমাণ বেশ বড়। এর পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, যে-প্রতিষ্ঠানের জনসাধারণের অর্থের একটা বিরাট পরিমাণ এইভাবে নিয়োগ করা হয়েছে তাতে অর্থের অপচয় বন্ধ করবার দায়িত্ব কি সরকারের নেই? অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের যেমন উৎপানের মান রক্ষার জন্য নানা রকম আইনকানুন হয়, উৎপাদনকর্মে যাঁরা নিযুক্ত তাঁদের জন্য নানা রকম আচরণবিধি প্রণয়ন করা হয়, জনসাধারণ যাতে বেআইনীভাবে বঞ্চিত না হয় সেজন্য সাবধানী ব্যবস্থা গৃহীত হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় সন্বন্ধে কি সেই রকম ব্যবস্থার প্রয়োজন নেই?
প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে, শুধু হ্যাঁ অথবা না বলে এই সব প্রশ্নের যথেষ্ট উত্তর হয় না। একথা বলাই যথেষ্ট নয় যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাধারণ ব্যবসায়কেন্দ্র নয়, বিদ্যা পণ্যদ্রব্য মাত্র নয়, ছাত্র ও অধ্যাপকের ভিতর এমন একটা সম্পর্ক থাকে যার সঙ্গে তুলনীয় কিছুই শিল্পপ্রতিষ্ঠানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এসব কথাই ঠিক; তবু জনসাধারণ এটাও জানে যে, শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে এযুগে অনেকটা ব্যবসায়কেন্দ্রের মতো ব্যবহার করা হয়েছে, আজকের শিক্ষকেরা ব্যবসায়বুদ্ধি থেকে মুক্ত নন এবং তার কারণও আছে। 
এর পরও বলা হবে যে, শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নিয়ম বা আচরণবিধি যদিও প্রয়োজন তবু সেই সব বিধি অধ্যাপকেরা নিজেরা প্রণয়ন করলে তবেই সেটা ভালো। বিধিপ্রণয়নের এটাই গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। এতেও কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় না। গণতন্ত্রের নিয়ম এই যে, কোনো বিষয়ের সঙ্গে যাঁদের স্বার্থ জড়িত তাঁদের সবাইকে যথাসম্ভব সেই বিষয়ে সিদ্ধান্তের সঙ্গে যুক্ত করে নেওয়া হবে। বিশ্বাবিদ্যালয় যে কাজে নিযুক্ত তার সঙ্গে অধ্যাপক, ছাত্র, কর্মী, অভিভাবক সকলেরই স্বার্থ নিবিড়ভাবে জড়িত। কাজেই ঐ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অথবা রীতিনীতি প্রণয়নের ব্যাপারে এঁদের সবাইকে যুক্ত করে নিতে পারলেই পদ্ধতিটা গণতান্ত্রিক বলা যায়। তবু প্রশ্ন থেকে যায়। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকেও কিছু সীমারেখার ভিতর কার্যকরী করা আবশ্যক হয়। অধ্যক্ষ অথবা অধ্যাপক যদি ছাত্রের দ্বারা নির্বাচিত হন তবেই কি শিক্ষার ধর্মরক্ষা হবে। এ প্রশ্নের কোনো সরল উত্তর নেই। আরও একটা কথা আছে। শিক্ষায়তনে সিদ্ধান্ত গ্রহনের উপায়টা এমন হওয়া দরকার যাতে পদ্ধতির জটিলতায় ও দীর্ঘসূত্রতায় অথবা দলীয় কলহে সব কাজ বার বার আটকে না যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে আচরণবিধি কী রকম হবে এই মৌল সিদ্ধান্তের সঙ্গে অভিভাবক অথবা জনসাধারণের শিক্ষিত প্রতিনিধিদের যুক্ত না করবার কোনো গণতান্ত্রিক কারণ নেই। তবে সেই সব বিধির দিনানুদৈনিক প্রয়োগের পদ্ধতিটা অপেক্ষাকৃত সরল হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিছু দায়িত্ব আছে যা বিশেষ ব্যক্তির হাতে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ছেড়ে না দিলে কোনো কাজই এগোয় না। 
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনায় অধ্যাপক ও কর্মচারীদের যুক্ত করবার দাবি যত জোরের সঙ্গে ও বারেবারে শোনা যায় অভিভাবকদের সমভাবে যুক্ত করবার দাবি তেমন শোনা যায় না, এর একটা সহজ কারণ আছে। সেই কারণের সঙ্গে শিক্ষার প্রকৃতির ততটা সম্পর্ক নেই যতটা আছে সংগঠনশক্তির। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত কর্মচারীদের সহজে সংগঠন করা যায়, অধ্যাপকদের তো বটেই। অভিভাবকেরা ছড়িয়ে থাকেন নানা স্থানে নিজ নিজ জীবিকার প্রয়োজনে, তাঁদের একত্র করা কঠিন। অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভালোমন্দের তাঁরাও ভুক্তভোগী। অধ্যাপকেরা সমাজের জন্য যে-সেবার কাজ করেন তারই ভিত্তিতে সমাজের কাছ থেকে তাঁরা কিছু প্রতিদান চাইতে পারেন, সেটাই তাঁদের সমস্ত দাবির নৈতিক ভিত্তি। অভিভাবকদের বাদ দিয়ে কিন্তু এই সেবার যথার্থ বিচার ও মূল্যায়ন সম্ভব নয়। অভিনয়ের বিচারক অভিনেতা একা নন, দর্শকও বটে। পাঠককে বাদ দিয়ে লেখকের বিচার সম্পূর্ণ হয় না। শিক্ষাদান করেন যদিও শিক্ষক, তার বিচারক শিক্ষক একা হতে পারেন না; ছাত্র অভিভাবক ও সাধারণভাবে শিক্ষিতসমাজের অভিমত তুচ্ছ করবার মতো নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্বশাসনের নামে অধ্যাপক ও কর্মচারীরা যদি এমন অধিকার দাবি করেন যে, তাঁদের দোষগুণের বিচারক হবেন শুধু তাঁরাই, তবে সেটাকে অন্যায় দাবি বলা ছাড়া উপায় তাকবে না। শিক্ষা ও শিক্ষকের মূল্য নির্ধারণে বৃহত্তর সমাজের একটা ন্যায্য স্থান অস্বীকার করা যায় না। 
বিদ্যার একটা ব্যবহারিক দিক আছে। আবার যথার্থ জ্ঞানের লক্ষণ এই যে, সে ভয় থেকে মুক্তি দেয়। সার্থক শিক্ষায় জীবনের ব্যবহারিক প্রয়োজনকে কোনো এক স্তরে স্বীকার করেও অন্য এক স্তরে তাকে অতিক্রম করে যেতে হয়। এই স্বীকৃতি ও অতিক্রম, সতর্ক অথচ গ্রহিষ্ণু বুদ্ধির সঙ্গে দুইয়ের বিচার বিবেচনা আবশ্যক। 
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা সম্বন্ধে কয়েকটি কথা দিযে আলোচনার এই অধ্যায়টি শুরু করা যাক। বিজ্ঞান আমাদের আজও ভয় থেকে মুক্তি দেয়নি। বিজ্ঞানের শক্তি আমরা কিছু কিছু চারপাশে দেখি বটে। বিজ্ঞানের বলে কত কিছু ঘটছে, পাহাড় কেটে পথ তৈরি হচ্ছে, মরুভূমির মাঝখানে নগরের দর্শন পাওয়া যাচ্ছে, মানুষের বুকের মাঝে নতুন হৃৎপিন্ড বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে অথবা মানুষ চাঁদের পথে যাত্রা করছে, এই সব আমরা দেখছি এবং শুনছি। আমরা বিজ্ঞান পাঠ করছি স্কুলে কলেজে, কাজ চলছে গবেষণাগারে। তবু বিজ্ঞানের ওপর আমাদের আস্থা দুর্বল। পরিবেশ সম্বন্ধে আমাদের মনের গভীর একটা অন্ধ ভয় এখনও প্রবল। এর অনেক কারণের ভিতর একটা নিশ্চয়ই এই যে, এদেশের জীবনে বিজ্ঞানের ব্যবহারিক ক্তি এখনও ব্যাপক হয়ে প্রবেশ করেনি, বরং অনেকটা ওপর তলায় আবদ্ধ আছে। এদেশের যে অগণিত মানুষ দরিদ্র এবং গ্রামবাসী, তাদের অভাব দূর করবার কাজে বিজ্ঞানের ব্যবহার সীমাবদ্ধ। 
শিল্পোন্নত দেশ থেকে যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা আমরা আহরণ করি দেশের উপযোগী করে তার প্রয়োজন কিছুই যে হয় না এমন নয়, কিন্তু যতটুকু হয় সেটা মোটেই যথেষ্ট নয়। এদেশের যে প্রাচীন চিকিৎসাপদ্ধতি ছিল আধুনিক দৃষ্টিতে তার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি হয়তো দুর্বল; কিন্তু দেশের মাটির সঙ্গে তার একটা ঘনিষ্ঠতা ছিল। হাতের কাছে যে সব বনৌষধি এবং অন্যান্য উপাদান ছড়িয়ে আছে সেই সব ব্যবহার করে গ্রাম ও শহরের সাধারণ মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা তাতে হত। আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রের সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানের যোগ অনেক বেশী ঘনিষ্ঠ। আমাদের কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই চিকিৎসাবিদ্যালয়ই ব্যবস্থা হয়েছে। এই চিকিৎসকেরা বিশ্ববিদ্যার সঙ্গে অনেকখানি পরিচিত। কিন্তু যে সব যন্ত্রপাতি ব্যবহারে তাঁরা নিপুণ, বড় হাসপাতালের বাইরে সে সব সহজে পাওয়া যায় না; যে সব ঔষধের ওপর তাঁরা নির্ভরশীল সে সব অনেকটাই দুম্প্রাপ্য বড় শহরের বাইরে। ফলে এদেশের আধুনিক ডাক্তারেরা বিদেশে আদৃত, কিন্তু এদেশের গ্রামে তাঁরা অসহায়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এখনও বিজ্ঞান ও বিশ্ববিদ্যালয়কে এদেশের উপযোগী করে তুলবার কাজে বেশী দূর অগ্রসর হতে পারেনি। 
বিজ্ঞানকে পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত করা আজ আমাদের বিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষায় একটা প্রধান কর্তব্য। পরিবেশ বলতে যে শুধু নাগরিক পরিপার্শ্ব বোঝায় না, বরং পল্লীই আমাদের অধিকাংশ দেশবাসীর স্বাভাবিক পরিবেশ, একথাটা সহজ সত্য হলেও আমাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে এখনও তার স্বীকৃতি পরিস্ফুট নয়। অথচ বিশ শতকের প্রথম দিকেই পল্লী উন্নয়নের উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিবেশের যোগসাধনের কথা মর্মস্পর্শী ভাবে বলে গেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। সরকারী নীতিতে ও গবেষণা পরিকল্পনায় পরিবেশ বিজ্ঞানের উল্লেখ বাড়ছে। বোঝা যাচ্ছে যে, ভবিষ্যতে এর গুরুত্ব আরও বেশী করে স্বীকৃত হবে। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে কিন্তু পরিবেশ বিজ্ঞানের প্রবেশ এখনও কুণ্ঠিত। সেখানে শিক্ষা ও পরীক্ষার উদ্দেশ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানকে আমরা বিভিন্ন প্রকোষ্ঠে ভাগ করেছি, দেয়াল গেঁথে এদের স্বতন্ত্র করা হয়েছে। প্রাণতত্ত্ব ও পরিবেশ বিজ্ঞানকে নিয়ে যখন জ্ঞানের ধারাকে নবদিগন্তের সন্ধানে প্রসারিত করবার দিন এসেছে তখন ঐ পুরোনো দেয়াগুলি নতুন প্রচেষ্টার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

উচ্চশিক্ষাকে রোজগার অথবা জীবিকার উপযোগী করে তুলবার একটা দাবি আজকাল প্রায়ই শোনা যায়। জীবিকার প্রয়োজন প্রশ্নাতীত এবং অত্যন্ত জরুরী। কোনো এক কালে সনাতন সমাজব্যবস্থায় পুত্র স্বাভাবিকভাবে পিতার কাছ থেকে পারিবারিক বৃত্তিতে দীক্ষিত হত। এখনও অনেক কৃষকের ছেলে এমনি ভাবেই কৃষিবিদ্যা শিক্ষা করে, যেমন মায়ের কাছ থেকে মেয়েরা গৃহকর্মে নৈপূণ্য লাভ করে। কিন্তু অবস্থার দ্রুত পরিবর্তনের ফলে সেই সনাতন ব্যবস্থা আর কালোপযোগী নয়। গৃহ যদিও সন্তানের শিক্ষার অন্যতম ক্ষেত্র তবু গৃহ এবং শিক্ষায়তনের ভিতর দুরুত্ব ক্রমেই বেড়ে চলেছে। নতুন বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা এদেশে এখনও দুর্বল, এজন্য আরো সুনিশ্চিত ও ব্যাপক আয়োজন আবশ্যক। অষ্টম শ্রেণীর পর থেকেই কিছু ছাত্রছাত্রীর জন্য এই ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হয়। 
একথাটা মেনে নেওয়াই ভালো যে, নিছক বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ অথবা জীবিকার জন্য শিক্ষা এক বস্তু, বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চা ভিন্ন বস্তু। এ দুয়ের লক্ষ্য এক নয়, একের দ্বারা অন্যের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না। দুয়ের ভিতর একটা সম্পর্ক আছে বটে; কিন্তু দুটোকে এক করতে গেলে অনেক  সময় দুয়েরই ক্ষতির সম্ভাবনা। অধ্যাপক ও গবেষকের কাজের জন্য বিশেষভাবে যে ধরনের অভ্যাস ও নৈপূণ্য প্রয়োজন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর শিক্ষার সঙ্গে তারই সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও অবশ্য আছে যাকে বলা যেতে পারে আধা-বিশ্ববিদ্যালয় আধা-প্রশিক্ষণভবন। প্রশিক্ষনের উচ্চনীচ বিভিন্ন স্তর আছে। উচ্চতর প্রশিক্ষণের গৌরব কম নয়। তবু বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে যে-ভাবটি রক্ষা করা আবশ্যক সেটি স্বতন্ত্র। নিছক বৃত্তিমূলক কাজের জন্য যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন তার যোগ্যতম স্থান বিশ্ববিদ্যালয় নয়। সৈনিক তৈরি করার জন্য আলাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। কারিগর কর্মচারী অথবা প্রশাসক তৈরি করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে সুপকিল্পিত ও স্বতন্ত্র ব্যবস্থা রাখা সম্ভব এমনকি বাঞ্চনীয়। সরকারী ও বেসরকারী নিয়োগনীতিতে একথাটা পরিস্কার করে দিতে পারলেই ভালো হয় যে, এসব কাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় ডিগ্রীর কোনো প্রয়োজন নেই। তবে অন্য কাজে যাঁরা নিযুক্ত থাকবেন তাঁরাও পরে কখনও তাঁদের সময়, সুবিধা ও রুচি অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যাতে আবার যোগসাধন করতে পারেন, সেই পথ খোলা থাক বাঞ্ছনীয়। জীবনের বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত আমাদের নাগরিকেরা যেন তাঁদের অভিজ্ঞতা ও পরিণত বুদ্ধি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে নানাভাবে ফিরে আসতে পারেন সেই সুযোগ যথাসম্ভব বাড়াতে হবে। কিন্তু এই প্রত্যাবর্তন ঘটা উচিত সরকারী অথবা বেসরকারী কাজে পদোন্নতির আকাক্সক্ষায় নয়, বরং মূলত বিশ্ববিদ্যার সঙ্গে সংযোগ সাধনেরই আগ্রহে। 
প্রাচীন শিক্ষব্যবস্থায় বিদ্যাকে খণ্ড খণ্ড করে দেখা হয়নি, যেমন হয়েছে আধুনিককালে। যদিও এর কারণ আছে তবুও এই যান্ত্রিক ব্যবস্থার ত্রুটি গুরুতর। এরই বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন যে, বিদ্যালাভের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের শুধু চরিত্রগঠন হবে তাই নয়, তারা এই বিশ্ব থেকে আনন্দ সংগ্রহ করতে শিখবে। এরই ভিতর দিয়ে ঘটবে মনুষ্যত্বের বর্ধন। জ্ঞানবিজ্ঞানের অস্বেষণ এবং আত্মপ্রকাশের শক্তি মনুষ্যত্বের পূর্ণতায় সহায়ক বলে মুল্যবান। আমাদের বহু খণ্ডে খণ্ডিত উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থার বাজারমূল্য যাই হোক না কেন, এর সঙ্গে মনুষ্যত্বের যোগ দুর্বল। এই দিক থেকে এর পুনর্বিচার প্রয়োজন। 
আমাদের পাঠক্রমে নীতিশিকার স্থান নেই। এই রকম একটা অভিযোগ কখনও কখনও শোনা যায়। প্রাচীনকালে এই অভাবটা পূর্ণ হত ধর্মশিক্ষার ভিতর দিয়ে। এখন সেটা হয় না। কোনো কোনো দেশে ধর্মের স্থান নিয়েছে আইডিওলজি। কিছুদিন আগে চীনে গিয়েছিলাম। ওখানে পাঠক্রমে অনেকটা স্থান অধিকার করে আছে মার্কসবাদ-মাওবাদ। এরই ভিতর দিয়ে ওদেশের ছাত্রছাত্রীরা শুধু একটা বিশ্বদর্শন লাভ করে তাই নয়, দেশপ্রেমে, কর্তব্যনিষ্ঠা এইসব শিক্ষাও একই সঙ্গে হয়। তবু চীনের দেশপ্রেম একটা সংকীর্ণতা আর। চিন্তার স্বাধীনতা ওদেশে শৃঙ্খলিত। আমাদের রাষ্ট্র ঐ রকম ধরাবাঁধা মতবাদে বিশ্বাসী নয়। আমাদের সাধারণ বিদ্যালয়ে ধর্মশিক্ষা বা মতাদর্শ কোনোটিরই স্থান নেই। অনেকেই মনে করেন যে, আমাদের স্কুলে কলেজে নীতিশিক্ষার কোনো ব্যবস্থা রাখা আদৌ সম্ভব নয়। ছাত্রছাত্রীরা নীতির নামে কোনো উপদেশ শুনতেও চাইবে না। তবু প্রশ্ন থেকে যায়। ছাত্রছাত্রীদের ব্যক্তিগত জীবনে নানা নৈতিক সমস্যার সম্মূখীন হতে হয় অনিবার্যভাবে। জীবনেরই প্রয়োজনেই চরিত্রেরও প্রয়োজন। 
অতএব নীতিশিক্ষা আবশ্যক। জীবন থেকে আহৃত নানা বাস্তব পরিচিস্থিতির সঙ্গে যোগ করে নৈতিক সমস্যার আলোচনায় ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহ থাকবে কিনা সেটা পরীক্ষা করে দেখবার যোগ্য বিষয়। 
আসলে বাধাটা অন্যত্র। মামুলী নীতিশিক্ষার বিশেষ ফল নেই। আমরা অনেকেই নীতিশিক্ষা দেবার অধিকারী নই। সেই অধিকার অর্জন করা সহজ নয়। তবু একটা কথা না বললে শিক্ষা নিয়ে আলোচনা নিতান্ত অসম্পূর্ণ থাকে মাতৃত্বের যেমন বিদ্যালয়েরও তেমনি একটা আদর্শ রূপ আছে। শিক্ষকের সমস্ত অক্ষমতা নিয়েও সেই কথাটা বারবার স্মরণ করা কর্তব্য। যে-দুটি প্রধান উপাদানে বিদ্যালয়ের আদর্শ গঠিত তার একটির নাম অনুশীলন, অন্যটি আনন্দ। বিদ্যালয়ে শিশুর ব্যক্তিত্বের  ভিত্তি স্থাপিত হয়। এক অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও বিদ্যালয়ের শিক্ষার গুরুত্ব বেশি। 
অনুশীলনের সঙ্গে বিনয়ের একটা বিশেষ সম্পর্ক আছে। বিনয়কে বলা হয়েছে বিদ্যার ভূষণ। সেই উদ্ধৃতিটির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত যেখানে সর্বকালের এক শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক বলছেন যে, জ্ঞানসমুদ্রের ধারে তিনি শুধু নুড়ি কুড়োচ্ছেন। আমাদের আহৃত জ্ঞানের তুলনায় অনাবিস্কৃত রহস্যময় বিশ্ব যে কত বড় তারই আভাস দেওয়া হয়েছে ঐ উপমার ভিতর দিয়ে। তবু উপমাটি যেন বড় স্থাণু বড় চিত্রার্পিত। নিউটনের বক্তব্যের গভীরে নিহিত একটা গতিময়তা আছে যেটা স্পষ্ট করা দরকার। মানুষের জ্ঞান স্বল্প কিন্তু সে দাঁড়িয়ে নেই, সে চলমান। জ্ঞান যে মানুষের কাছে লভ্য এই ধারণা থেকে আমাদের আত্মবিশ্বাস আসে। আবার আমাদের জ্ঞান যে অত্যন্ত অসম্পূর্ণ, তার যে নিরন্তর সংশোধনের প্রয়োজন আছে, এই বোধের ভিতর দিয়ে আসে বিনয়। বিদ্যার্থীর পক্ষে এই আত্মবিশ্বাস ও বিনয় দুই-ই আবশ্যক। বিনয় ছাড়া আহৃত বিদ্যার সংশোধন সম্ভব নয়। 
এই বিনয়ের সঙ্গে দৃঢ়তার কোনো বিরোধ নেই। যে-মানুষ কোনো কিছুতেই বিশ্বাস স্থাপন করতে জানে না, সুযোগের সন্ধানে অথবা স্তাবকতার বশে সর্বত্র মাথা নত করে, তাকে বিনয়ী বলা যায় না। বিনয় যদি বিদ্যার ভূষণ হয় তবে তার মূলে সত্যের প্রতি একটা সদাগ্রহ থাকে। বিজ্ঞানের সত্য সর্বক্ষণই নতুন তথ্য ও যুক্তির আলোতে নিজেকে সংশোধন করতে আগ্রহী। এই সত্যাগ্রহই বিদ্যার ক্ষেত্রে বিনয়ের রূপে দেখা দেয়। কোনো মতাদর্শ যখন এই বিনয় থেকে ভ্রষ্ট হয় তখনই সেটা সেত্যর পথে একটা বিষম বাধা হয়ে দেখা দেয়। 
আধুনিক জগতে বিজ্ঞান বলে যে-জিনিসটাকে আমরা জানি সেটা যে ক্রমাগতই বিবর্তিত হয়ে চলেছে, শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিকেরও আজকের আবিস্কার যে কাল অংশত ভ্রান্ত প্রমাণিত হবেই, এ কথাটা বিশেষত গত কয়েক শ’ বছরের ভিতর দিয়ে এমনই স্পষ্ট প্রমাণিত যে কোনো পণ্ডিত যদি আজ তাঁর মতবাদ সম্বন্ধে অভ্রান্ততা দাবি করেন তবে বিনা দ্বিধায় তাঁকে আমরা অবৈজ্ঞানিক বলে চিনে নিতে পারি। আধ্যাত্মিক সত্য সম্বন্ধে এই কথাটা আরো একভাবে সত্য রবীন্দ্রনাথ যখন বলেছিলেন যে সত্যকে বারবার আবিস্কার করতে হয়, তখন সেই সূক্ষ্ম বোধের কথাই তার উক্তির মূলে ছিল। আমাদের জীবনের মহত্তম বোধও মৃত শীতল শব্দমাত্রে পরিণত হয়, যদি-না জগতের নিত্য নূতন পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত করে বহু ব্যর্থতার ভিতর দিয়ে বারবার হারিয়ে তাকে আমরা নতুন করে ফিরে ফিরে পাই। বিনয় আমাদের শেখায় যে, সত্যকে একটা স্থায়ী সম্পত্তির মতো লাভ করা যায় না। 
বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যাচর্চার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত তাঁদের আরো একটা কথা মনে রাখা আবশ্যক। বিদ্যা ও সংস্কৃতির অনেকখানিই বিশ্ববিদ্যালয়ের চার দেয়ালের বাইরে উন্মুক্ত সমাজের ফসল। সাহিত্য ও শিল্প সৃষ্টি হচ্ছে সেখানে; অধ্যাপকেরা প্রধানত ভাষ্যকার মাত্র। প্রযুক্তিবিদ্যার অনেকখানিই উদ্ভাবিত হচ্ছে, জীবন নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা এবং নতুন সত্যোপলদ্ধি হচ্ছে, মানুষের ইতিহাস সৃষ্টি হয়ে চলেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণের বইরে বৃহত্তর সমাজে। কোনো পুরনো সত্য আমরা আদর্শকে বাইরে সংস্পর্শ থেকে বাঁচিয়ে যথাপূর্ব রক্ষা করতে যে-বিদ্যাতয়ন অথবা প্রতিষ্ঠান একান্তভাবে নিযুক্ত সে নিজের সত্যকে দিনে দিনে নির্জীব করে তোলে, ইতিহাসের পক্ষে সেটা ক্রমে বর্জনীয় হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অনুশীলনের সঙ্গে সেই বিনয়ের যোগ রক্ষা করা আবশ্যক যাতে বাইরের থেকে শিক্ষা গ্রহণের ধারায় ছেদ না পড়ে। এই যোগ যখন ছিন্ন হয় তখন অনুশীলন তার চরিত্র হারায়, সেখানে অধিষ্টিত হয় অহংকার। 
আত্মসমালোচনার মধ্যে যে বিনয় আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংঘবদ্ধ জীবনে তারও প্রয়োজন আছেই। এই দোষে ভরা বেদনাহত সমাজেও শিশুরা জন্মগ্রহণ করছে, চোখে নতুন আলো নিয়ে। তারা বেড়ে উঠছে ভবিষ্যতের পৃথিবীর জন্য। তাদেরও দাবি আছে, অধিকার আছে শিক্ষকদের কাছ থেকে কিছু আদর্শের কথা শুনবার, কিছু আদর্শনিষ্ঠার সঙ্গে পরিচিত হবার। সেই অধিকারকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করে নিয়ে সমস্ত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে যাঁরা যথাসাধ্য কাজ করতে সম্মত তাঁরাই তো শিক্ষক হবার যোগ্য। এ যদি না হয় তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যারও কোনো সমাধান আশা করা যাবে না।

সমাজ এখন তিন ভাগে বিভক্ত বলা যায়। উচ্চ বিত্ত, মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র। এটা নানাভাবে বোঝা যায়, টের পাওয়া যায় শিক্ষার দিকে তাকালেও। শিক্ষা এখন সমাজের মতোই খাড়াখাড়ি তিনভাগ হয়ে গেছে ইংরেজি মাধ্যম, বাংলা মাধ্যম ও মাদ্রাসা। ইংরেজি মাধ্যম বিত্তবানদের জন্য, মধ্যবিত্তদের জন্য রয়েছে বাংলা মাধ্যম আর গরিব মানুষের ভরসা হচ্ছে মাদ্রাসা। শিক্ষার সঙ্গে সমাজের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তো থাকবেই। শিক্ষা সমাজের ওপর ভর করেই দাড়িয়ে থাকে এবং সামজের যে বাস্তবতা, তাকেই প্রতিফলিত করে। কিন্তু সত্য তো এটাই যে, শিক্ষা সমাজকে বদলে দেবে  এটাই আমরা আশা করি। নইলে শিক্ষা শিক্ষা বলে অত করে আওয়াজ তোলা কেন? আমাদের প্রত্যাশা থাকে, শিক্ষা জাতি গঠনের সাহায্য করবে। তার অর্থ তো শিক্ষা সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করবে। কিন্তু বাস্তবে যা করছে সেটা তো দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণ উল্টা ব্যাপার । ভিন্ন নয়, একেবারে উল্টা। সমাজের ভেতর যে শ্রেশিবিভাজন শিক্ষা তাকে বাড়িয়ে তুলছে। শিক্ষার ৩ ধারা সমাজের ৩ ভাগকে পরস্পর থেকে আলাদা করে দিচ্ছে। শিক্ষা যত বাড়ছে, বিভাজন তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা একাধারে করুণ ও হাস্যকর।
উচ্চবিত্তদের ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা আর মাদ্রাসা শিক্ষার মধ্যে মিল থাকার কোনো ব্যাপারই আশা করা যায় না। দুটি দুই ধরনের। ইংরেজি মাধ্যমে সবকিছুই চলে ইংরেজি ভাষায় আর মাদ্রাসায় ইংরেজি যা পড়ানো হয়, তা খুবই সামান্য। কওমি মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণি থেকে ওপরের দিকে শিক্ষার মাধ্যমে হচ্ছে আরবি, ফার্সি ও উদু। কিন্তু ওই যে মাতৃভাষার জন্য উপযুক্ত স্থান নেই, এ ব্যাপারে বড়লোকের ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা ও গরিবের মাদ্রাসা শিক্ষা চমৎকার ভাবে কাছাকাছি চলে আসে। এর ফল যা দাড়াচ্ছে তা হলো উভয় ধারার শিক্ষার্থীই উৎপাটিত হচ্ছে মাতৃভুমির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির জ্ঞান থেকে। তাদের কৃত্রিম মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। মাতৃভাষাই হচ্ছে শিক্ষার সহজ, স্বাভাবিক ও কার্যকর মাধ্যম। অন্য ভাষায় যে শিক্ষা তা সব সময়ই কঠিন, কৃত্রিম ও অফলপ্রসূ হচ্ছে। মাতৃভাষার মাধ্যমে উচ্চপর্যায়ের শিক্ষাদান ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়েছে। আর বড় লোক ও গরিবদের স্কুলে মাতৃভাষার স্থান তো খুবই সংকুচিত, অথচ কথাছিল দেশ স্বাধীন হলে সর্বস্তরের শিক্ষাই হবে মাতৃভাষায়। তিন ধরনের শিক্ষা তো থাকবেই না, তিনে মিলে এক ও অভিন্ন হয়ে যাবে এবং মাতৃভাষাই হবে তার মাধ্যম। ঠিক এর উল্টাটাই ঘটেছে। মাতৃভাষাই পারত তিন ধারাকে এক করতে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আগে ইংরেজি মাধ্যমে স্কুল ছিল একেবারেই নগণ্য সংখ্যক। কিন্তু তার পরও হৈচৈ করে একেবারে চক্রবৃদ্ধি হারে ইংরেজি স্কুলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন রাজধানী বা প্রধান শহরগুলোতেই শুধু নয়, মফস্বলেও তারা ছড়িয়ে গেছে। তাদের চাহিদা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে মাদ্রাসা শিক্ষার চলও আগের সব রেকর্ড ইতিমধ্যে ভেঙে ফেলেছে। রাষ্ট্র ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। সেখানে রাষ্ট্র পরিচালিত ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকার কোনো কথাই ছিল না। কিন্তু সংবিধান থেকে যে দ্রুততার ধর্মনিরপেক্ষতাকে মুছে ফেলা হয়েছে, ততোধিক ত্বরিতগতিতে মাদ্রাসার শিক্ষার প্রসার ঘটেছে। কাজটা সরকার করেছে, কাজটা বেসরকারিভাবেও করা হয়েছে। সরকারি বেসরকারি মাদ্রাসার মধ্যেও পাথর্ক্য রয়েছে। আমাদের এই সোনার বাংলায় এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে বৈষম্যের কোনো প্রকার অভাব দেখা যাবে। মাদ্রাসা শিক্ষার বেলায়ও তাই। 
মাদ্রাসা শিক্ষা, বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসার ব্যাপারে বদনাতার কোনো অভাব দেখা যায় না, অথচ প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্কুল খোলার জন্য টাকা চাইলে পাওয়া যায় না। কারণ এই যে, মাদ্রাসা শিক্ষাকে উৎসাহিত করলে একদিকে যেমন পুন্য সঞ্চয় হবে ও সামগ্রিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে তেমনি গরিব মানুষের শান্ত, সন্তুষ্ট এবং প্রতিযোগিতার বলয়ে প্রবেম থেকে বিরত রাখা সম্ভব হবে। তাছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষার ভেতরে বাণিজ্যিক সুবিধাও রয়েছে। বই ও গাইড বই থেকে শুরু করে চাঁদা সংগ্রহ, সরকারি অনুদানের অপব্যবহার সবকিছুই চলে। শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্যের আরেকটি ক্ষেত্র রয়েছে প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ^বিদ্যালয় এলাকায়। পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ই যে আসল বিশ^বিদ্যালয় তা নিয়ে কোনো তর্ক নেই। প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয় চলে পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের কারণেই। প্রথম কথা, প্রয়োজনের তুলনায় পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের সংখ্যা অল্প। এর সংখ্যা বৃদ্ধি করা অত্যাবশ্যক। সেখানে ভর্তি হতে ব্যর্থ হয়েই ছেলেমেয়েরা প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়ের দিকে ছোটে। দ্বিতীয় সত্য এই যে, প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আগমন পাবলিক বিশ^বিদ্যালয় থেকেই, তা তারা খন্ডাকালীন, পূর্বকালীন, ছুটি নিয়ে আসা যে ধরনের নিয়োগই পান না কেন। 
প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিকই বটে। হাতেগোনা কয়েকটি বাদ দিয়ে অধিকাংশ প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষাদান, পাঠ্যসূচি ও পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। সর্বোপরি বিশ^বিদ্যালয় বলতে যে ধরনের পরিপূর্ণ ব্যবস্থা থাকা চাই, সে ধরনের গ্রন্থাগার, ল্যাবরেটরি, যাতায়াত সুবিধা,স্থানের প্রশস্ততা কোনো প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়ের পক্ষেই তার আয়োজন করা সম্ভব নয়। পাবলিক বিশ^বিদ্যালয় মানেই খারাপ, আর প্রাইভেট মানেই ভালো এ ধারণা এ ক্ষেত্রে চলে না। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষার্থীদের তুলনায় অনাবাসিক শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করছে এটাও কিন্তু বৈষম্যেরই ফল। ঢাকায় যাদের থাকার মতো বাসা আছে, অর্থনৈতিক ভাবে তারা আবাসিক ছাত্ররা নানা রকম অসুবিধায় থাকে। খাদ্যের মান নিম্ন, বসবাসের জায়গায় ঠাসাঠাসি, নিরুপদ্রবে পড়াশোনার সুযোগ অপেক্ষাকৃত সীমিত এসব তো আছেই, খরচ চালানোর জন্য কাউকে কাউকে গৃহশিক্ষকতাও করতে হয়। আবার টাকাও খরচ করতে হয় হিসাব করে। এসব অসুবিধা থেকে অনাবাসিকরা তুলনামূলকভাবে মুক্ত। শিক্ষার ক্ষেত্রে যে অনগ্রসরতা, এর কারণ সমাজের ভেতরেই রয়েছে। সেখানে যে বৈষম্য ও বিভাজন বিদ্যমান শিক্ষার ব্যাপারেও র্তাই প্রতিফলন ও প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই। আরও আছে রাজনীতি। কোনো কিছুই রাজনীতির বাইরে নয়। আমরা তুমুল রাজনৈতিক আন্দোলন করেছি, দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু সমাজ বদলায়নি এবং সমাজের পাহারাদার যে রাষ্ট্র সেও আগের মতোই মানুষের পশ্চাৎপদতাকে উৎসাহিত করে এবং চায় সমাজের শ্রেণিবিভাজন আরও গভীর হোক, যাতে শাসকশ্রেণির পক্ষে রাষ্ট্রক্ষমতাকে নিজেদের পক্ষে রাখা সহজ হয়। শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কার চাই, কিন্তু তার জন্য জরুরী হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রে মৌলিক পরিবর্তন আনা, যাতে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়। যে গণতন্ত্রের ভিত্তিই হচ্ছে মানুষে মানুষে অধিকার ও সুযোগের সাম্য গড়ে তোলা।

মানুষের স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তির একটা বৈশিষ্ট্য এই, কাছের জিনিসকে মনে হয় বড়, দূরেরটা ছোট; কাছের জিনিস স্পষ্ট, দূরেরটাঅস্পষ্ট। সংসারী মানুষ যাকে বলে বাস্তববুদ্ধি, তার সঙ্গে যুক্তিনিষ্ঠ আদর্শবোধের পার্থক্য অনেকটা এই রকমেরই। বাস্তববুদ্ধি উপস্থিত প্রয়োজনটাকে বড় করে দেখে, আদর্শবোধের বিচারে কিন্তু দূরের প্রয়োজনটাও গুরুত্ব পায়। আদর্শবোধ নিশ্চিতভাবে বাস্তববিরোধী নয়। বাস্তবতার পরিধির ভিতর কোন জিনিস কতটা স্থান পাবার অধিকারী- এ-নিয়ে বিচারে পার্থক্য ঘটে যুক্তি ও অনুভবের বিভিন্ন স্তরে।
সহানুভূতি ও দূরদৃষ্টির মিশ্রণে গঠিত হয় আদর্শবোধ। বাস্তবের এটা এক বিশেষ স্তর। সহানুভূতি পরকেও আপন করে নেয়; দূরদৃষ্টি কল্পনার সেই শক্তি, যার বলে নিকট ও দূরের ভিতর চেতনার আলো স্বচ্ছন্দে বিচরণ করে। চেতনার সম্প্রসারণে সহায়তা করা শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য। মনে রাখতে হবে, উপস্থিত । প্রয়োজনকে অবহেলা করা ভুল। কিন্তু অংশ যখনসমগ্রকে আচ্ছন্ন করে দাঁড়ায়, বর্তমানের সঙ্গে অতিসংলগ্নতায় যখন আমরা ভবিষ্যৎকে অগ্রাহ্য করি, তখন আমাদের সত্যের উপলব্ধি নিতান্তই অসম্পূর্ণ হয়ে পড়ে। এই বোধ যার ভিতর জাগ্রত হয়নি তাঁকে সুশিক্ষিত অথবা সুবিবেচক বলে মান্য করা যায় না। অর্থাৎ, বিচারে ত্রুটি থাকতে পারে দুই প্রান্তেই, অংশ নিয়ে মত্ততার ফলে পূর্ণেরপ্রতি উপেক্ষায়, পূর্ণের পুজোর ছলে অংশের অবহেলায়। কথাটাকে এরপর তত্ত্বের শিখর থেকে উদাহরণের সমতলভূমিতে নামিয়ে আনা যাক।
মানুষের ভিতর আছে যে-মহত্ব পূর্ণ মনুষ্যত্বের যেটা অন্য নাম-তাকে বিকশিত করাই শিক্ষার উদ্দেশ্য, এই রকমের একটা কথা আমরা শুনেছি মহাজনদের মুখ থেকে। আজকের দিনে অনেকে অধৈর্য বোধ করবেন এই জাতীয় বাক্যে। তারা বলবেন, আমাদের বাস্তববাদী হতে হবে; বেকার যুবক-যুবতীদের কথা ভাবুন; ছাত্রছাত্রীদের সেই শিক্ষা দেওয়া হোক, যাতে তারা জীবিকার সুযোগ লাভ করে। কথাটা যুক্তিসংগত, অন্তত আপাতদৃষ্টিতে। তবে এই সমালোচনায় সমস্যাটাকে সমগ্রভাবে দেখা হয়নি। বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকেই সুবিবেচক কিছু শিক্ষাবিদ আপত্তি তুলতে পারেন। আর সেই আপত্তিরধাক্কায় ধাক্কায় বাস্তবের সীমানাটাই ধীরে ধীরে সরে সরে যেতে পারে। কর্মসংস্থানের অভাব যে আমাদের এক নিদারুণ সমস্যা, এ-কথা মানতেই হবে। কিন্তু শিক্ষাকে চাকরিমুখী করলেই দেশে চাকরির সংখ্যা বাড়বে, বেকারের সংখ্যা কমবে, এই চিন্তায় দূরদৃষ্টির অভাব আছে। এরপর প্রশ্ন, সমস্যার মূল কোথায়? শিক্ষার সংস্কার বলতে কী বুঝতে হবে?
মূলের অনুসন্ধানে গবেষকেরা ফিরে যান ব্রিটিশ আমলের শিক্ষাব্যবস্থার পর্যালোচনায়। বিদেশী শাসকেরা চেয়েছিলেন শিক্ষার এমন এক ব্যবস্থা যাতে তৈরি হবে শাসনযন্ত্রের অধস্তন পদে কাজ করবার মতো দেশীয় কর্মচারী। সমালোচকদের বক্র ভাষায় এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহকে বলা হয়েছে কেরানি তৈরি করবার কারখানা। এইভাবে সৃষ্টি হয়েছে এক মধ্যবিত্ত এলিট’-জাতীয় মানুষ, কলম-পেষাই যাদের পেশা। এই ব্যবস্থার কয়েকটি ত্রুটির উল্লেখ করা যেতে পারে সহজেই। কায়িক শ্রম আর কলম পেষার ভিতর একটা ভেদ স্থাপিত হয়ে গেছে এলিট 'শ্রেণির চেতনার গভীরে। জাতিভেদের সঙ্গে মিলেমিশে এইভাবে আমরা পেয়েছি এক মিথ্যা মর্যাদাবোধের সামাজিক বিভাজন। এখানে মর্যাদার ব্যাপারটা একই সঙ্গে দুঃখজনক ও হাস্যকর একটা বিশেষ কারণে। কেরানি যেহেতু অধস্তন কর্মচারী, অতএব তার পেশাগত প্রয়োজন। আজ্ঞাবহতা, স্বাধীন চিন্তা নয়। অনিবার্যভাবে আমাদের বিদ্যাপ্রতিষ্ঠানে উৎসাহ পায়নি স্বাধীন চিন্তার সাধনা, নির্দেশ-অনুযায়ী কাজ করা ও ফাইল সাজানোর অভ্যাসই প্রধান হয়ে উঠেছে। এই ত্রুটি থেকে গেছে আমাদের উচ্চশিক্ষাতেও। খেয়াল করতে হবে, বশংবদতা আর সহযোগিতা এক বস্তু নয়। এলিট-শ্রেণির ভিতর সহযোগিতা দুর্বল, রেষারেষি প্রবল।












http://www.comillarkagoj.com/ad/1752266977.jpg
সর্বশেষ সংবাদ
পদত্যাগ করেছেন উপদেষ্টা আসিফ ও মাহফুজ
কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের সব অফিস তামাকমুক্ত ঘোষণার দাবিতে মতবিনিময় সভা
গোমতীর উত্তরের জনপদকে নগরায়নে রূপ দেওয়া হবে
‘প্রতিযোগিতা’ করে সড়ক বিভাজকের গাছে ফেস্টুন
১২৫ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করল এনসিপি, কারা পেলেন মনোনয়ন
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
বিস্ফোরক-অস্ত্রের হটরুটকুমিল্লা সীমান্ত
কুমিল্লা-২ আসনে বিএনপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে মনোনয়ন বঞ্চিতদের ঐক্যের ঘোষণা
দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে একসাথে কাজ করতে হবে: জেলা প্রশাসক
বিএমএ কুমিল্লার সাবেক সভাপতি ডা. শহীদুল্লাহর ইন্তেকাল
স্কুলে ভর্তির লটারি কাল
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২