শুক্রবার ১২ ডিসেম্বর ২০২৫
২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
পরিশীলিত সমাজ গড়ে তুলবে কে?
শিহাব শাহরিয়ার
প্রকাশ: শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১২:১৬ এএম আপডেট: ১২.১২.২০২৫ ১:০৯ এএম |

পরিশীলিত সমাজ গড়ে তুলবে কে? ছোটবেলায় আমার স্কুলশিক্ষক বাবা বলেছিলেন, ‘ব্যক্তি সুন্দর হলে পরিবার সুন্দর হয়, পরিবার সুন্দর হলে সমাজ সুন্দর হয় আর সমাজ সুন্দর হলেই রাষ্ট্র বা দেশ বা জাতি সুন্দর ও পরিশীলিত হয়’। ওই সময়ে পুরোটা না বুঝলেও, এখন বুঝি বাবা কেন ব্যক্তি মানুষের পরিশুদ্ধির কথা বলেছিলেন? বাবার উপদেশে তখন একটা বিষয় বুঝেছিলাম, তা হলো- একটা চেইন বা ট্রেনের বগির মতো জোড়া লাগানো একটা সুতা বা পরস্পর অথবা পরম্পরা, একজন ব্যক্তি থেকে দেশ। এটিকে একটা দীর্ঘ পথও বলা যায়। প্রথমেই আসি- পরিশীলিত সমাজ কী? সবাই জানি, পরিশীলিত সমাজ হলো সেই সমাজ, যেখানে থাকে নৈতিকতা, ন্যায়বিচার, স্বচ্ছ-সুন্দর পরিবেশ। যেখানে থাকে জনগণের সুসংহত স্বার্থরক্ষা অর্থাৎ যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো, যেমন- খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিৎসার সুসম বণ্টন। এর সঙ্গে বোধহয় আরেকটি মৌলিক বিষয় এখন যুক্ত করা দরকার, তাহলো, ‘নিরাপত্তা’। এসব বিষয় নিয়ে এখন কী দাঁড়াল? দাঁড়াল আপনার বা আমার সমাজের বা বৃহত্তর অর্থে রাষ্ট্রের সবাই যার মৌলিক চাহিদা পূরণমূলক একটি সুস্থ সমাজে সহঅবস্থান বা একত্রে শান্তিময় পরিবেশে বসবাস করা।
এই যে কাঙ্ক্ষিত সমাজের কথা বললাম, তা কি তৃতীয় বিশ্বের, দক্ষিণ এশিয়ার এ বাংলাদেশে শান্তিময় সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। সম্ভব। হয়তো বলবেন, যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরায়, সেখানে আবার সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা?- অ্যাবসার্ড। আপনার কথাও ঠিক যে, ৫৪ বছর আগে রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে যে দেশটি আমরা স্বাধীন করেছি পশ্চিম পাকিস্তানের স্বৈরশাসনের নিষ্পেষণ, শোষণ, দুঃশাসন থেকে। যে দেশটি শুরু থেকেই রাজনৈতিক অস্থিরতা, মহামারি, বন্যা, খরা, ঝড়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানান উত্থান-পতন- সেখানে একটি পরিশীলিত সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি, হচ্ছে না। বলবেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে, সুস্থ সমাজ কীভাবে প্রতিষ্ঠা পাবে? ঠিক- মেনে নিলাম। নিতে হবেই, কারণ বিগত পাঁচ দশকই বাংলাদেশে অস্থির, টালমাটাল, বিপন্ন ও বেদনাময় সময় কেটেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার ঢেউ সমাজের প্রতিটি স্তরে লেগেছে। ফলে আমরা সামনে যাব তো দূরের কথা, ক্রমশ পেছনে গেছি। এ পেছানোর দায় বিগত সব সরকারকেই নিতে হবে। কারণ জনগণ চায় সুস্থ পরিবেশ। সোজা কথা, সাধারণ মানুষ তিনবেলা খেতে চায়, রাতভর ঘুমাতে চায় আর দিনের বেলা আরামে হাঁটতে চায়। স্বীকার করতেই হবে, বিগত সাড়ে পাঁচ দশকে ক্ষমতাসীন কেউ-ই এ শান্তি বা পরিতৃপ্তি ব্যক্তি, পরিবার বা সমাজকে দিতে পারেনি। শাসকরা মাছের মতো ডাঙায় উঠলে যেমন তাদের মাথা পচে যায়, তেমনি সরকারে গেলেই যেন তাদের পরিকল্পনাহীন মগজ নষ্ট হতে থাকে এবং জনগণের কথা ভুলে যেতে থাকে! যাদের দেওয়ার কথা শান্তিময় সমাজ, তাদের মগজে পচন ধরে।
দেখুন না, বাংলাদেশের খুব কাছে- ছোট্ট একটি পাহাড়ি দেশ ভুটান, যারা স্বচক্ষে দেখে এসেছেন, তারা বলতে পারবেন, কী পিসফুল অর্থাৎ নিটোল ও শান্তিময় পরিবেশ, ধারণার বাইরে... আমি নিজেও একবার ভ্রমণ করেছি ভুটান। আহা মানুষগুলো এত ভদ্র-বিনয়ী (কোনো কোনো ক্ষেত্রে জাপানিজদের চেয়েও আমার কাছে মনে হয়েছে বিনয়ী), রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, কোনো কোলাহল নেই, যেন পাহাড়ের মতোই নীরব ও শান্ত এবং সবুজ বৃক্ষের মতোই ভুটানিজদের মন। বেশি বলিনি, ভুটান ভ্রমণ করা বাংলাদেশের একজন লেখক আমার আগে ভ্রমণ করে এসে বলেছেন, সবাই তো মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডায় সেকেন্ড হুম বানায় বা চলে যায়, আমি যদি সেকেন্ড হোম করি তাহলে করব ভুটানে। আসলেই যারা যাবেন ভবিষ্যতে, তারা দেখবেন তাদের প্রধানমন্ত্রী বা রাজার বাড়ির সামনে কোনো সিকিউরিটি নেই। রাজা নিরাপত্তাবলয় ছাড়াই ৩০০ ফিট ওপরে পায়ে হেঁটে উঠে মন্দিরে যান, নামেন। পারু, থিম্মু, পুনাখা যে শহরেই যাবেন, দেখবেন নীরব, শুনশান, শান্ত। তাহলে আমরা কেন পারি না, সমতলের বাসিন্দারা? পারা উচিত নয়। আমরা কেন, পরশ্রীকাতর, আমরা কেন হিংসুটে, অন্যের ক্ষতি করি, ঈর্ষান্বিত হই, স্বার্থপর হই, আমাদের কেন বিনয় নেই, ভদ্রতা নেই? শুধু কি রাজা বা শাসকের দোষ দিয়েই যাব? নিজেরা পরিশুদ্ধ হব না?
ব্যক্তিগতভাবে আমি এশিয়া, ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা, আমেরিকা, কানাডাসহ প্রায় ১৭টি দেশ ভ্রমণ করেছি। কোথাও দেখিনি, রাস্তায় অযথা হর্ন বাজে। যেমন, কানাডায় গত বছর প্রায় ২৫ দিন ছিলাম, একটা গাড়ির হর্নও শুনিনি। কেন বলছি, আপনি ঢাকা শহরে দেখেন, হর্নে হর্নে আপনার কান ফেটে যাওয়ার অবস্থা! কে শেখাবে আর কাকে শেখাবেন? চোরে শোনে কি ধর্মের কাহিনি। আসলে তো গোড়ায় গলদ? শেখাটা শুরু হয় পরিবার থেকে। পরিবারের প্রধান কি পরিশীলিত সমাজের মৌলিক বিষয়গুলো সন্তানদের শেখাচ্ছেন? অবশ্য এ কথাও ঠিক- আমরা তো কেউ শিখতেও চাই না, জানতেও চাই না, বুঝতেও চাই না? তাহলে দায়টা কার? উত্তর, দায়টা সবার। একদম নিজের ঘরে যদি আসেন, তাহলে- সকালে আপনি ঘুম থেকে উঠলেন, ওঠার পর প্রথমেই যদি আপনি আপনার বিছানাটা ঠিকঠাক করেন, ঘরটা প্রতিদিন পরিষ্কার রাখুন, ডাইনিং টেবিলে বসে খান, বাচ্চাদের খাওয়ানোর অভ্যাস করান, তাদেরও শেখান, বলুন মুই (আমি) ভালো তো জগৎ ভালো। অর্থাৎ তোমার কাজ তুমি করো, প্রতিদিন ঘর সুন্দর করে গুছিয়ে রাখো, সুন্দর করে কথা বলো, ভদ্র আচরণ করো, মানুষকে ভালোবাসো, মানবিক হও, দেশমাতৃকাকে ভালোবাসো। বই পড়, জগতের যা কিছু সুন্দর, তা গ্রহণ করো। বিকশিত হও ফুলের মতো, সুভাস ছড়াও সেই ফুলের মতোই। মানুষ এমনিতেই তোমাকে তখন ভালোবাসবে। মনে রাখতে হবে, আমি সুন্দর হলেই সমাজ সুন্দর। খারাপদের চোখে আঙুল দিয়ে জানিয়ে দাও, যে অসুন্দর তাকে কেউ পছন্দ করে না? যদিও প্রেমের গান, তাও উদাহরণ হিসেবে সামনে আনি, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন- ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সে কি মোর অপরাধ’... নিশ্চয়ই না। কারণ আমাদের সুন্দরের পুজারি হতে হবে। গানও আমাদের মন পরিচ্ছন্ন রাখে। আপনি ভালো গান শুনলেও আপনার সুন্দর মন তৈরি হবে। মোট কথা আপনাকে ভাবতে হবে- প্রথমে ব্যক্তি আপনাকে নিয়ে, তার পর আপনার সমাজকে নিয়ে।
আমাদের এও মনে রাখতে হবে যে, আমি যে সমাজে জন্মেছি, বেড়ে উঠেছি, যে সমাজে বাস করছি, সেই সমাজটি আমার, হ্যাঁ আমারই। সুতরাং সমাজ কুলষিত হলে আমি ব্যক্তিটি শান্তি পাব না? যেন আমার স্বার্থেই আমার সমাজকে উন্নত করব। করব কারণ, এ সমাজে, এ দেশেই আমার মৃত্যু হবে। যতদিন বাঁচি, ততদিন আমার স্বার্থেই যেন নিজের সমাজকে একটি পরিশীলিত সমাজ নির্মাণে সবার সঙ্গে আমিও এগিয়ে আসি। সব ধরনের উন্নয়ন একই সঙ্গে করতে হবে অর্থাৎ অবকাঠামো উন্নয়ন, নৈতিক উন্নয়ন, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক উন্নয়ন এবং মানসিক উন্নয়ন। তাহলেই সমাজ পরিশীলিত হওয়ার পথে হাঁটতে শুরু করবে। বলবেন কি পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তিময় দেশ আইসল্যান্ডের কথা কিংবা আরও নয়টি শান্তির সেরা দেশ- আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর,  সুইজারল্যান্ড, পর্তুগাল, ডেনমার্ক, স্লোভেনিয়া ও মালয়েশিয়ার কথা? নিশ্চয়ই তারা সমাজের সব ক্ষেত্রে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে, না হলে পৃথিবীতে সেরা হওয়া কি সম্ভব হতো? তাহলে নির্মল দেশ ও আনন্দময় সমাজ গঠন করতে উল্লিখিত দেশগুলোকে আমাদের সামনে রাখতে হবে এবং তা আজ থেকেই। এজন্য দুর্নীতিকে না বলতে হবে, সদা সত্য কথা বলতে হবে, কাজে নিষ্ঠাবান হতে হবে, হিংসা করা যাবে না, নৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে হবে, মানুষকে ভালোবাসতে হবে, সবার আগে নিজেকে ভালোবাসতে হবে। নিজেকে ভালোবাসলেই সমাজকে ভালোবাসা যাবে।
লেখক: কবি












http://www.comillarkagoj.com/ad/1752266977.jpg
সর্বশেষ সংবাদ
সংসদ নির্বাচন ১২ ফেব্রুয়ারি
নভেম্বরে কুমিল্লার সড়কে ঝরেছে ২২ প্রাণ
তফসিলকে স্বাগত জানিয়ে কুমিল্লায় অভিনন্দন মিছিল
হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি ধরতে পুলিশের অনীহা!
বিজয় দিবসের টোকেন মানি নিচ্ছে সদর দক্ষিণ উপজেলা প্রশাসন
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
গোমতীর উত্তরের জনপদকে নগরায়নে রূপ দেওয়া হবে
১২৫ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করল এনসিপি, কারা পেলেন মনোনয়ন
পদত্যাগ করেছেন উপদেষ্টা আসিফ ও মাহফুজ
কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের সব অফিস তামাকমুক্ত ঘোষণার দাবিতে মতবিনিময় সভা
লালমাইয়ের ভাবকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দৃষ্টিনন্দন ফটক নির্মাণ ও উদ্বোধন করলেন আবদুল্লাহ আল মামুন
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২