
প্রবৃদ্ধির
সুফল দরিদ্র মানুষের ঘরে পৌঁছাচ্ছে না। বৈষম্য আরও গভীর হচ্ছে জীবিকা
অনিশ্চয়তায় আটকে যাচ্ছে লাখো পরিবার। চার বছর ধরে বাড়ছে দারিদ্রের হার।
২০১০-১৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশের দারিদ্র হ্রাসের অগ্রগতি ছিল। সে সময়
দারিদ্র জনগোষ্ঠীর ভোগব্যয়ও বাড়ছিল দ্রুত। কিন্তু ২০১৬ সালের পর প্রবৃদ্ধির
কাঠামো বদলে যায়। উচ্চ আয়ের পরিবারগুলো বেশি লাভবান হয়। নিম্ন আয়ের
পরিবারগুলোর বেশি লোকসান হয়। এখন দেশে এক কোটি মানুষের বেশি দারিদ্রসীমার
নিচে রয়েছে এছাড়া ৬ কোটি মানুষ অর্থাৎ জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ যে কোন
বিপর্যয়, অসুস্থতা, প্রাকৃতিক দূর্যোগ বা অর্থনৈতিক আঘাতে আবারও
দারিদ্রসীমার নিচে নেমে যেতে পারে। রিসার্চ এন্ড পলিসি ইন্টিগ্রেসন ফর
ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) এর এক গবেষণায় উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে, “বৈষম্য বাড়লে
দারিদ্র স্থায়ী হয়, উন্নয়ন ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।”
ব্যবসায় লাভের বদলে চলছে
টিকে থাকার সংগ্রাম। যাঁরা পারছেন না, তাঁদের ব্যবসা বা উদ্যোগ বন্ধ হয়ে
যাচ্ছে। অনেক কারখানা এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে, কাজ হারিয়েছেন বিপুল সংখ্যক
কর্মী। নতুন বিনিয়োগ না থাকায় নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে না। দ্রুত বাড়ছে
বেকারের সংখ্যা। ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি হারানোর প্রভাব সরাসরি পড়েছে সরকারের
রাজস্ব আয়ে। সমস্যাগ্রস্থ করদাতারা ঠিকমতো করও দিতে পারছে না। উচ্চ
মূল্যস্ফীতির সময় বেশি ভ্যাট পাওয়ার কথা থাকলেও সেখানে চলছে খরা। আমদানি
শুল্কেও মোটা অংকের ঘাটতি। ফলে সরকারের নিজস্ব আয়ের জায়গাটিও ঝুঁকিতে।
বিজ্ঞজনের
ধারণা, বেসরকারি খাত স্থবির, কোন বিনিয়োগ নাই। শিল্পের উৎপাদন সংকুচিত।
একে একে কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। উচ্চ সুদে কেউ ব্যবসার প্রসার ঘটাতে
চাচ্ছেন না। আবার নতুন কারখানায়ও বিনিয়োগ করছেন না। সাধারণেরও সীমিত আয়ের
বিপরীতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে পণ্যের চাহিদা ও ভোগব্যয় কমে গেছে, যার
ফলে কমছে আমদানি। বিশেষ করে শিল্পের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ
আমদানি কমছেই। এ কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু তা
সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। ব্যবসায়ী অর্থনীতিবিদরা
বলছেন, অনিশ্চয়তার কারণে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা নতুন অর্ডার দিতে
দ্বিধাগ্রস্থ হচ্ছেন। আইন শৃঙ্খলা ও ব্যবসায় পরিবেশের উন্নতি আর রাজনৈতিক
সরকার না আসা পর্যন্ত অর্থনীতিতে গতি ফিরবে না। রাজস্ব আদায় চাঙ্গা করতে
গেলে ব্যবসা বানিজ্য ও বিনিয়োগে চাঙ্গাভাব ফিরিয়ে আনতে হবে। সামাজিকভাবে
দেখা যায়, মানুষের আয় কমে যাওয়ায় ভোগ কমেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো কমিয়েছে
উৎপাদান। আগের তুলনায় পণ্যের দাম বাড়লেও বিক্রি কমায় ভ্যাট আদায় কমছে।
অর্থনীতি গতিশীল না হলে রাজস্ব আদায় বাড়বে না।
প্রতিযোগীতাপূর্ণ
বিশ^বাজারে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে হবে। একবার পিছিয়ে গেলে সেখান থেকে
নিজেদের অবস্থান টেনে তোলা সহজ নয়। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে
মুজেরির মতে, “ঘাটতি মেটানোর জন্য ঋণ নেয়া ছাড়া সরকারের আর কোন উপায় নেই।
কেন্দ্রিয় ব্যাংক অথবা ব্যাংকিং খাত থেকে এ ঋণ নিয়েই হয়তো এ ঘাটতি মেটানো
হতে পারে। কেন্দ্রিয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতি আরো
বাড়ার সম্ভাবনা আছে।” আমরা এখন এক কঠিন সময় পার করছি। দেশের সার্বিক
অনিশ্চয়তার কারণে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা নতুন অর্ডার দিতে দ্বিধাগ্রস্থ
হচ্ছেন। দ্রুত সমাধান না আসলে সংকট আরো গভীর হবে।
২০২৩-২৪ সালের মধ্যে
২০ লাখ কর্মসংস্থান কম হয়েছে। ২০২৫ সালে আরও ৮ লাখ কর্মসংস্থান কম হওয়ার
আশঙ্কায় আছে। এ সময়ে ব্যয় বেড়েছে বিভিন্ন খাতে, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচীসহ
সরকারি সহায়তা বিস্তৃত হয়েছে। তবে সুবিধা ভোগী শনাক্তকরণের দূর্বলতা থাকায়
প্রকৃত দরিদ্র পরিবারগুলোর একটি বড় অংশ কাঙ্খিত সহায়তা পাচ্ছে না। একই
সঙ্গে মৌলিক সেবাগুলোর মানের উন্নতি খুব কম। স্কুলে ভর্তি বাড়লেও শেখার
মানের ঘাটতি বড় বাঁধা। স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় বাড়ছে কিন্তু মান স্থবির। খাদ্য
ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, তা নিম্ন আয়ের পরিবারে
সরাসরি চাপ সৃষ্টি করছে। মূল্যস্ফীতি, জলবায়ু-ঝুঁকি আর শহরাঞ্চলে চাকুরি
সৃষ্টির ধীরগতি আগামী কয়েকবছর দারিদ্র হ্রাসকে আরও কঠিন করে তুলবে। এখন
নীতির লক্ষ্য হতে হবে আয় বাড়ানো, কর্মসংস্থান বিস্তৃত করা এবং সামাজিক
সুরক্ষায় সঠিক মানুষকে শনাক্ত করা।
স্বৈরাচারের পতনের পর প্রায় ১৬ মাস
অতিবাহিত হয়েছে। দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর পরিবর্তে আরো দূর্বল হয়ে
যাচ্ছে। শান্তি স্বস্তির পরিবর্তে অস্থিরতা-উত্তেজনা বেড়ে চলছে। আইন
শৃঙ্খলার অবনতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আস্থাহীনতা চরমে উঠেছে। ছিনতাই,
চাঁদাবাজি, ডাকাতি, খুনখারাবি, ধর্ষণ মানুষের ঘুম হারাম করে দিচ্ছে।
চাকুরিজীবী, পেশাজীবীদের ঠিকানা হয়ে উঠেছে রাজপথ। সবকিছুর প্রভাব পড়ছে
অর্থনীতিতে, ব্যবসা-বাণিজ্যে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, উচ্চ সুদের হারসহ বিনিয়োগে
স্থবিরতার কারণে ধুকছে অর্থনীতি, ধুকছে বিনিয়োগ, ব্যবসা শিল্প। এক কঠিন
প্রক্রিয়ার নীরব মন্দার আক্রমনের শিকার বাংলাদেশ।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ
