
দুর্নীতির সেই চিরাচরিত রীতি। শ্রমিক পাঠানোর নামে অতিরিক্ত অর্থ আত্মসাৎ। নিয়ম যা বেঁধে দেওয়া হয় তাকে তোয়াক্কা না করা। এবার এরকম আত্মসাতের ঘটনায় ফেঁসে যাচ্ছে ১০০টি রিক্রুটিং এজেন্সি।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত বিশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে কারসাজি করে অন্তত ২৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় ফেঁসে যাচ্ছেন এসব রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকসহ তিন শতাধিক ব্যক্তি। এই এজেন্সির মধ্যে এ পর্যন্ত ৪০টির মালিকসহ ১০২ জনের বিরুদ্ধে পৃথক ৪০টি মামলা করেছে দুদক। এতে অভিযোগ করা হয়েছে, আসামিরা ২ লাখ ৫ হাজার ২৮৪ জনের কাছ থেকে সরকার-নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত ৩ হাজার ৪৩৮ কোটি ৯৫ লাখ ১৭ হাজার ৫০০ টাকা আদায়ের পর আত্মসাৎ করেছেন। এখানেই শেষ নয়, আরও ৬০টি এজেন্সির মালিকসহ অন্তত ২০০ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধানে অভিযোগসংশ্লিষ্ট সবার বিরুদ্ধে একই ধরনের তথ্য-প্রমাণ পেয়েছেন দুদকের কর্মকর্তারা। দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শেষে আরও ৬০টি মামলা হতে পারে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
মালয়েশিয়া আমাদের শীর্ষ দুটি শ্রমবাজারের একটি। সৌদি আরবের পরেই দ্বিতীয় শীর্ষ শ্রমবাজার হিসেবে দেশটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার হয়ে উঠেছে। দুদক সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তির আওতায় ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১০টি নির্ধারিত রিক্রুটিং এজেন্সি মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাত। কিন্তু এজেন্সিগুলোর অনিয়ম এতটাই বেড়ে যায় যে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নেওয়া বন্ধ করে দেয় মালয়েশিয়া। ২০২১ সালে শ্রমিক নেওয়ার বিষয়ে আবার দেশটি বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে। ওই চুক্তিতে রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যা বাড়িয়ে করা হয় ১০০। দেখা যাচ্ছে, চুক্তি বাতিলের পরে পুনর্বহাল হয়েছে। একবার বাংলাদেশ শ্রমিক পাঠানোর সুযোগ হারিয়েছে, আবার পরে তা ফিরে পেয়েছে। অভিযোগের ধরনটা সেই একই। মালয়েশিয়ায় পাঠাতে শ্রমিকপ্রতি সর্বোচ্চ ৭৮ হাজার ৫৪০ টাকা ফি নির্ধারণ করে দেয় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। কিন্তু এর তোয়াক্কা না করে গড়ে তোলা হয় নতুন সিন্ডিকেট। মালয়েশিয়াগামী প্রত্যেকের কাছ থেকে নির্ধারিত ওই অর্থের অতিরিক্ত ১ লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ টাকা করে আদায় করেন এজেন্সির মালিক ও সিন্ডিকেটের সদস্যরা। এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দেয় সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামালের (লোটাস কামাল) পরিবারসহ ২০-২৫টি এজেন্সি। এভাবে এজেন্সিগুলো ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়াগামী অন্তত ১৪ লাখ ৩২ হাজার ৮৩৫ জনের কাছ থেকে নির্ধারিত খরচের অতিরিক্ত প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা আদায়ের মাধ্যমে আত্মসাৎ করে।
অভিযোগ সেই পুরনো ধাঁচের। চুক্তি করা ও বাতিল হওয়া, পরে আবার চুক্তি করে শ্রমিক পাঠানোর অনুমতি পেয়েছে বাংলাদেশ। এই যে চুক্তি বাতিল হয়ে যাওয়া, এটা একধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। বলতে দ্বিধা নেই, এটা একধরনের জাতিগত লজ্জা। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক স্তরে এভাবে লজ্জার মুখোমুখি করেছে। দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। শ্রমবাজারে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা ও সংকট।
দুর্নীতি দমন কমিশন যে ১০০ রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে মামলা করেছে, বর্তমানে তার অনুসন্ধান চালাচ্ছে। এই তদন্ত যাতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। আত্মসাৎকারী এজেন্সি, যতই শক্তিশালী হোক, তারা যেন পার না পায়। এর আগে খবরের কাগজে প্রকাশিত আরেক সংবাদে জানা গিয়েছিল যে, মালয়েশিয়াতে শ্রমিক পাঠানোর লক্ষ্যে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নতুন করে এজেন্সি নিয়োগ দিচ্ছে। সেই নিয়োগও যেন স্বচ্ছ হয়, সে বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন শ্রমবাজারে সাধারণত তারাই শ্রমিক হয়ে যান, যারা দরিদ্র বা নিম্নবিত্তের মানুষ। ভিটেমাটি বিক্রি, ধারদেনা করে জীবিকার সন্ধানে তারা বিদেশে পাড়ি জমান। এরাই আমাদের রেমিট্যান্সকে সবল ও স্ফীত করার কাজে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখেন। তাদের সামগ্রিক জাতিগত ভূমিকাকে উপেক্ষা করা যায় না। কিন্তু আমাদের শ্রমবাজারকে যারা অনিশ্চিত আর সংকটে ফেলে, তাদের অপরাধের শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রটি তাহলে আরও সম্ভাবনার সুযোগ তৈরি করতে পারে। এ দিকটির প্রতি দুদক ও সরকারকে নজর দিতে হবে।
