নিজস্ব প্রতিবেদক।। কুমিল্লার ১০৬ কিলোমিটার সীমান্ত এখন চোরাচালানকারীদের সবচেয়ে সক্রিয় রুটে পরিণত হয়েছে। সীমান্তপথে বেড়েছে ভারতীয় আতশবাজি, বিস্ফোরক দ্রব্য ও অস্ত্রের অনুপ্রবেশ। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ঘিরে সীমান্তের চোরাচালান চক্র আরও সংগঠিত ও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে সীমান্তের কাঁটাতার অতিক্রম করে দেশে প্রবেশ করা ভারতীয় এসব আতশবাজি সদৃশ বিস্ফোরণ রেলপথকে নিরাপদ ও সাশ্রয়ী বাহন হিসেবে ব্যবহার করায় চোরাই মালামাল দ্রুত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে। যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) -এর বেশকিছু অভিযান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের রসুলপুর, শশীদল ও সালদা নদীসহ কুমিল্লার স্টেশনগুলোতে প্রায় প্রতিদিনই ধরা পড়ছে ভারতীয় চোরাই পণ্যের চালান। এসব চালানের বড় অংশই আতশবাজি।
বিজিবি দেয়া তথ্য মতে, ভারতের ত্রিপুরা বেষ্টিত কুমিল্লার ১০৬ কিলোমিটার সীমান্ত নিরাপত্তায় ১০ ও ৬০ বিজিবি ব্যাটালিয়ন দায়িত্বে থাকলেও শুধুমাত্র ১০ বিজিবির হিসাবেই চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত জব্দ হয়েছে ৭০ কোটি টাকার বেশি চোরাই পণ্য, যার মধ্যে রয়েছে ২৪ কোটি টাকার আতশবাজি। যা আগের বছরের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। এই বিপুল পরিমাণ আতশবাজির অনুপ্রবেশকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের দাবি, শুধু বিজিবি নয়; রেলওয়ে পুলিশ, জেলা পুলিশ ও র্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও আরও সক্রিয় হতে হবে। রেলপথ কেন্দ্রিক চোরাচালান ঠেকাতে সমন্বিত নজরদারিও বাড়াতে হবে।
এদিকে রেলওয়ে সূত্র বলছে, মালবাহী কামরা, স্লো প্যাসেঞ্জার ট্রেন, এমনকি আন্তঃনগর ট্রেনের বিভিন্ন বগিও ব্যবহার করছে চোরাচালানকারীরা। ট্রেনে গোপনে মাল ওঠানো এবং নির্জন স্টেশনে নেমে যাওয়ার কারণে নজরদারি কঠিন হয়ে পড়ছে। ফলে রেলওয়ের নিরাপত্তা দুর্বলতাকেই কাজে লাগাচ্ছে চক্রটি।
বিজিবির দাবি, রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে সীমান্তে সক্রিয় অপরাধ চক্রগুলো নিজেদের কার্যক্রম আরও সম্প্রসারিত করেছে।
তবে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য বলছে, আতশবাজির সঙ্গে একই রুটে আসছে বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক ও অস্ত্র। ত্রিপুরা সীমান্তের আশাবাড়ি, ভাল্লক, নারায়ণপুর, বাঁশতলী ও চরনল পয়েন্ট দিয়ে এসব পণ্য প্রথমে আসে। এরপর রেলওয়ে কেন্দ্রিক রুট ব্যবহার করে ছড়িয়ে পড়ে সালদা নদী, শশীদল, রসুলপুরসহ কুমিল্লার বিভিন্ন স্টেশনে। এখান থেকে চট্টলা, কর্ণফুলী ও নাসিরাবাদ ট্রেন ব্যবহার করে চোরাই পণ্য যায় চট্টগ্রাম, কুমিল্লা শহর, ঢাকা ও দেশের অন্যান্য এলাকায়।
এছাড়া সীমান্তের যশপুর, নিশ্চিন্তপুর, বিবির বাজার থেকে গোমতী নদীসহ অন্তত ২০টি পয়েন্টে নিয়মিত চোরাচালান চলছে বলে অভিযোগ করছেন স্থানীয়রা।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর মোঃ সৈয়দুর রহমান বলেন, সীমান্ত দিয়ে আনা অনেক আতশবাজিতেই এমন রাসায়নিক থাকে, যা অন্য উপাদান যোগ করলে বড় ধরনের বিস্ফোরক বানানো সম্ভব। তাই এসব আতশবাজি শুধু বিনোদনসামগ্রী নয়। এগুলো নাশকতার উপকরণেও পরিণত হতে পারে। তাই আসুন নির্বাচন ঘিরে সীমান্তে নজরদারি বাড়ানোর বিকল্প নেই।
বিজিবির পক্ষ থেকেও উদ্বেগ প্রকাশ করে কুমিল্লা ১০ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মীর আলী এজাজ বলেন, আতশবাজি চোরাচালানের ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এগুলো কোথায় যাচ্ছে এবং বিস্ফোরক তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে কিনা; এ নিয়ে গোয়েন্দা নজরদারি আরও বাড়ানো হয়েছে। সীমান্তে এবং রেলপথে নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। এছাড়াও চোরাই পথে আসা আতশবাজি মূলত কোথায় যাচ্ছে, কি ধরনের কাজে ব্যবহার হচ্ছে সে বিষয়েও গোয়েন্দা তৎপরতায় রয়েছে বিজিবি।
এদিকে নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, নির্বাচনকে ঘিরে সীমান্ত এলাকাগুলোতে বিজিবির পাশাপাশি সেনাবাহিনী পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর নজরদারী বৃদ্ধির জন্য বলা হয়েছে। একই সঙ্গে শহরের বিভিন্ন জায়গায় চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশিসহ অপরাধ দমনে আহবান জানানো হয়েছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর প্রতি। যাতে করে নির্বাচনকে ঘিরে কোনোপ্রকার বিশৃঙ্খলা তৈরি করে নির্বাচন বানচালের অপচেষ্টা কেউ করতে না পারে।
