
বাংলাদেশের
ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে পাটের গভীর শিকড় রয়েছে।
একসময় বাংলাদেশের স্বর্ণসূত্র হিসেবে পরিচিত এই প্রাকৃতিক তন্তু
বিশ্ববাজারে দেশের পরিচিতি গড়ে তুলেছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পলিথিন ও
সিনথেটিক উপকরণের ওপর নির্ভরতা বাড়ায় পাটের ব্যবহার কমে আসে। এই প্রবণতার
পরিবেশগত মূল্য এখন স্পষ্ট; নদী, খাল, সমুদ্র কিংবা শহরের ডাস্টবিন সবখানেই
পলিথিন জমছে পাহাড়ের মতো। ফলে আবারও নতুন করে আলোচনায় এসেছে পাট, তবে শুধু
কৃষিপণ্য হিসেবে নয়, বরং পরিবেশ রক্ষার একটি কার্যকর অস্ত্র হিসেবে। আজকের
বাস্তবতায় পাটকেন্দ্রিক শিল্প, সংস্কৃতি, উদ্ভাবন ও পর্যটনের প্রসার শুধু
অর্থনৈতিক দায়বদ্ধতা নয়, বরং একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ার অপরিহার্য শর্ত।
দেশে
পাটকেন্দ্রিক শিল্প সম্প্রসারণের জন্য প্রথম প্রয়োজন পাটপণ্যের বহুমুখী
ব্যবহার নিশ্চিত করা। শুধু বস্তা বা রশির মধ্যে এই সম্ভাবনাকে আটকে রাখা
যায় না। আধুনিক জীবনযাপনের সঙ্গে মিল রেখে পাটের তৈরি ব্যাগ, জুতা, ফ্যাশন
অ্যাক্সেসরিজ, সজ্জাসামগ্রী থেকে শুরু করে গৃহসজ্জার নানা উপাদান
বিশ্ববাজারে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বাংলাদেশেও এই প্রবণতা বাড়ছে, তবে কাঙ্ক্ষিত
মাত্রায় নয়। বিশেষ করে ঘর ও কর্মস্থলের ইন্টেরিয়র ডিজাইনে পাটের নান্দনিক
প্রয়োগ বিশ্বমানের ডিজাইন হাউসগুলো ব্যবহার করছে অনেক দিন ধরেই। চেয়ার,
টেবিল, লাইটশেড, ওয়ালহ্যাঙ্গিং কিংবা কার্পেট; সব ক্ষেত্রেই পাটের
স্বাভাবিক টেক্সচার ও প্রাকৃতিক আভা নতুন সৌন্দর্য যোগ করছে। দেশে এখনো এই
সম্ভাবনা পুরোপুরি ব্যবহৃত হয়নি। এ জন্য দরকার প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, দক্ষ
ডিজাইনার এবং পাটকে নিয়ে তরুণ উদ্যোক্তাদের সৃজনশীল অংশগ্রহণ।
ডেকোরেটিভ
আর্টসে পাটের ব্যবহার বাড়ানো এখন শুধু নান্দনিকতার প্রশ্ন নয়, বরং একটি
দ্রুত বর্ধমান বৈশ্বিক বাজার দখলের সুযোগ। সাম্প্রতিক বছরগুলোয়
হ্যান্ডক্রাফট ও ইকো-ডেকোর বাজারে প্রাকৃতিক তন্তুর ব্যবহার
উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্রের (আইটিসি)
তথ্যানুযায়ী, বৈশ্বিক হস্তশিল্প শিল্পের আকার এখন ৬০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি,
যার মধ্যে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই উপাদাননির্ভর সজ্জাসামগ্রীর চাহিদা বছরে
প্রায় ১২ শতাংশ হারে বাড়ছে। এই বাজারে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অবদান বাড়ছে,
কারণ প্রাকৃতিক ফাইবারভিত্তিক শিল্পে দক্ষতা এখানেই বেশি।
বাংলাদেশ
পাটভিত্তিক সজ্জাসামগ্রী রপ্তানিতে ইতোমধ্যেই শক্তিশালী বাজার গড়ে তুলেছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পাট ও
পাটজাত পণ্যের মোট রপ্তানি আয় ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি, যার মধ্যে প্রায় ৮-১০
শতাংশ এসেছে হস্তশিল্প, ডেকোর আইটেম ও গিফট আইটেম থেকে। এটি আগের পাঁচ
বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ, যা স্পষ্ট করে যে সৃজনশীল পাটশিল্পের সম্ভাবনা
দ্রুত বাড়ছে। বিশ্বব্যাপী ইকো-ইন্টেরিয়র ডিজাইনের বাজারও গত এক দশকে
বিস্তৃত হয়েছে। গ্লোবাল ইন্টেরিয়র ডেকোর মার্কেট রিপোর্ট (২০২৪) অনুযায়ী
পরিবেশবান্ধব ডেকোর আইটেমের বাৎসরিক বাজার প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন ডলার, যেখানে
প্রাকৃতিক ফাইবারজাত পণ্যের চাহিদা প্রতি বছর ১০-১১ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ঢাকাসহ দেশের শহরগুলোয়ও এই প্রবণতা স্পষ্ট। বিভিন্ন আর্ট গ্যালারি, বুটিক
শো-রুম ও ক্রাফট ফেয়ারে পাটের তৈরি ভাস্কর্য, চিত্র স্থাপনা ও নকশাদার
সজ্জাসামগ্রীর বিক্রি গত তিন বছরে ৩০-৪০ শতাংশ বেড়েছে।
আন্তর্জাতিক
ক্রেতারা এখন পাটভিত্তিক ইউনিক আর্ট পিস, ইকো-ওয়ালহ্যাঙ্গিং, মিনিমালিস্ট
টেবিল ডেকোর ও মডার্ন স্কাল্পচারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। বাংলাদেশের শিল্পীরা
ইতোমধ্যে ইউরোপ, স্ক্যান্ডিনেভিয়া, জাপান ও উত্তর আমেরিকার বাজারে এসব পণ্য
রপ্তানি করছেন, যা দেশের জন্য নতুন সাংস্কৃতিক ব্র্যান্ডিংয়ের সুযোগ তৈরি
করেছে। এই পরিসংখ্যান স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে গবেষণা, ডিজাইন উদ্ভাবন ও
দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পাটকেন্দ্রিক আর্ট সেক্টর সহজেই বাংলাদেশের একটি
শক্তিশালী সৃজনশীল শিল্পে পরিণত হতে পারে। শিল্পীরা যদি নতুন নকশা, রং,
প্রযুক্তি ও উপস্থাপনায় আরও মনোযোগ দেন, তবে পাট শুধু ঐতিহ্যের প্রতীক নয়,
বরং বৈশ্বিক শিল্পবাজারের একটি আধুনিক, প্রতিযোগিতামূলক ও লাভজনক সেগমেন্ট
হয়ে উঠবে।
পাটশিল্পের প্রসার মানে শুধু সৃজনশীলতার বিকাশ নয়, এর সঙ্গে
জড়িয়ে আছে দেশের বিপুল কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা। পাটচাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ,
নকশা, উৎপাদন, বিপণন এবং রপ্তানিসহ প্রতিটি ধাপে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হতে
পারে। স্থানীয় শিল্পের বিকাশে পাটের অবদান শুধু আর্থিক নয়, সামাজিকভাবেও
তা গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে গ্রামীণ নারীরা যদি পাটভিত্তিক ক্ষুদ্র ও
মাঝারি শিল্পে যুক্ত হতে পারেন, তবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন গতিশীলতা
আসবে। নারী উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রেও পাট একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে
পারে।
সরকার পাট চাষকে পুনরুজ্জীবিত করতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে।
পাটচাষিদের জন্য প্রণোদনা, উন্নত বীজ সরবরাহ এবং চাষের আধুনিকীকরণে গবেষণা
এখনো চলমান। পাশাপাশি পাটপণ্যের বাজার সম্প্রসারণেও সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে।
পরিবেশ ও পাট মন্ত্রণালয় যৌথভাবে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগ
ব্যবহারকে উৎসাহিত করছে। ইতোমধ্যে ইউরোপসহ উন্নত দেশগুলোয় বাংলাদেশের পাটের
ব্যাগ বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। সুইজারল্যান্ডের বড় বড় সুপারশপে বাংলাদেশের
পাটের ব্যাগ ব্যবহৃত হচ্ছে এটি বাংলাদেশের জন্য যেমন গর্বের, তেমনি
সম্ভাবনারও নতুন দরজা। কিন্তু দুঃখজনক হলো, দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে এখনো
পাটের ব্যাগের ব্যবহার সীমিত। যেখানে পরিবেশ রক্ষার তাগিদ সবচেয়ে বেশি, ঠিক
সেখানেই মানুষ এখনো পলিথিন ছাড়তে পারছে না।
পরিবেশ রক্ষায় ভোক্তাদের
ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশবান্ধব জীবনযাপনের ভিত্তি শুধু সরকারি
আইন বা নিষেধাজ্ঞার ওপর নয়, দরকার সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন আচরণে সচেতন
পরিবর্তন। পলিথিন ব্যবহার কমাতে ভোক্তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছাড়া
বাস্তব পরিবর্তন সম্ভব নয়। সামান্য সচেতনতা দিয়েই এটি আনা যায়। বাজারে
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনার সময় নিজের পাটের ব্যাগ নেওয়া সহজ। এটি ভবিষ্যৎ
প্রজন্মের জন্য দায়িত্বশীল একটি ছোট উদ্যোগ, যা পরিবেশ সুরক্ষায় বড় ভূমিকা
রাখে। প্লাস্টিক শতাব্দী ধরে পরিবেশে থেকে যায়, আর পাটপণ্যস্বাভাবিকভাবে
পুনর্ব্যবহারযোগ্য, বায়োডিগ্রেডেবল ও দূষণমুক্ত। তাই পাটের ব্যাগ বেছে
নেওয়া শুধু বিকল্প নয়, এটি ভবিষ্যতের প্রতি আমাদের নৈতিক অঙ্গীকার।
নাগরিকরা যদি এমন সচেতন মনোভাব নেন, পরিবেশের চাপ কমবে, পাটপণ্যের বাজার
বিস্তৃত হবে এবং উৎপাদকরা বিনিয়োগ ও উদ্ভাবনে উৎসাহিত হবেন।
উদ্যোক্তাদের
সামনে পাটশিল্প একটি সুদৃঢ় ও সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
পরিবেশবান্ধব ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য তৈরির প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারের
আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে পাটপণ্য উদ্যোক্তাদের জন্য একটি সোনালি
সুযোগ। কিন্তু এখনো অনেক উদ্যোক্তা দ্বিধায় ভুগছেন। কেউ কেউ মনে করেন
পাটপণ্যের বাজার সীমিত, আবার কেউ ভাবেন প্রযুক্তিগত দিক থেকে পাট এখনো
পিছিয়ে। বাস্তবতা হলো, সামান্য গবেষণা, ডিজাইন উন্নয়ন, ব্র্যান্ডিং ও
মার্কেটিং কৌশল প্রয়োগ করা গেলে পাটপণ্য বিশ্ববাজারে সফলভাবে টিকে থাকতে
পারে। বাংলাদেশে যে কাঁচামালের প্রাচুর্য রয়েছে, তা অন্য অনেক দেশেই নেই।
এই সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পাটপণ্য তৈরি করার এখনই
সময়।
পাটকে কেন্দ্র করে দেশের পর্যটন ও সংস্কৃতিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি
হচ্ছে। পাট জাদুঘর, পাটপণ্য প্রদর্শনী, হস্তশিল্প গ্রাম বা গ্রামীণ কৃষকের
জীবনধারা প্রদর্শনমূলক ইকোট্যুরিজমে রূপান্তর করলে দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের
কাছে বাংলাদেশের পাট সংস্কৃতি এক অনন্য আকর্ষণ হয়ে উঠতে পারে। এসব উদ্যোগ
শুধু শিল্প-সংস্কৃতির সৌন্দর্যই তুলে ধরবে না, মানুষকেও পরিবেশবান্ধব
জীবনযাপনের দিকে অনুপ্রাণিত করবে। প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব দিন দিন
দৃশ্যমান হচ্ছে, তাই পর্যটনকেন্দ্রিক উদ্যোগে পাটপণ্য ব্যবহার অগ্রাধিকার
পেলে তা পরিবেশ রক্ষার শক্তিশালী বার্তা হবে। পর্যটনকেন্দ্র, হস্তশিল্প
গ্রাম বা জাদুঘরে পাটের ব্যাগ, সজ্জাসামগ্রী ও দৈনন্দিন পণ্য প্রদর্শন করলে
দর্শনার্থীরা বুঝতে পারবেন প্রাকৃতিক ও টেকসই উপকরণ কতটা কার্যকর। এতে
স্থানীয় শিল্প উন্নত হবে, উদ্যোক্তারা বাজার সম্প্রসারণের সুযোগ পাবেন এবং
দেশের পরিবেশবান্ধব পরিচিতি আন্তর্জাতিকভাবে আরও উজ্জ্বল হবে।
সব মিলিয়ে
একটি বিষয় স্পষ্ট। বাংলাদেশের পরিবেশ রক্ষা, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, স্থানীয়
শিল্পের বিকাশ ও টেকসই অর্থনীতির জন্য পাটের বিকল্প নেই। আধুনিক বিশ্বে
শিল্প ও প্রযুক্তি যখন পরিবেশবান্ধব দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তি করে এগোচ্ছে,
তখন পাট আমাদের জন্য এক অমূল্য সম্পদ। এই সম্পদকে শুধু কৃষিপণ্য হিসেবে নয়,
শিল্প, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি ও টেকসই উন্নয়নের বহুমাত্রিক সম্পদ
হিসেবে দেখার সময় এখনই। পাটকে স্বর্ণ ফসলে পরিণত করতে উদ্যোক্তা, ভোক্তা,
চাষি, সরকার ও গবেষকদের মিলিত উদ্যোগ জরুরি। পরিবেশ রক্ষায় পাট শক্তিশালী
সহযোদ্ধা হতে পারে। নতুন ব্যবহার, নান্দনিকতা ও সচেতনতার মাধ্যমে
জনসম্পৃক্ততা তৈরি করলে পাটকেন্দ্রিক শিল্প ও সংস্কৃতি আগামী প্রজন্মের
জন্য পরিচ্ছন্ন, সুন্দর ও টেকসই বাংলাদেশ গড়তে সাহায্য করবে।
লেখক: সিনিয়র কৃষিবিদ ও কলামিস্ট
