
১৯৫২ সালে কুমিল্লায় সাংস্কৃতিক সম্মেলন হয়েছিল। নেতৃত্বে ছিলেন ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যাপকবৃন্দ। যদিও উল্লেখ আছে ১৯৫২ সালের ২২, ২৩ ও ২৪ আগস্ট কুমিল্লা শহরে ‘পূর্ব পাকিস্তান সাংস্কৃতিক সম্মেলন’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এই সম্মেলনের আয়োজন করে ‘কুমিল্লা প্রগতি মজলিস।’ ১৯৫২ সালের প্রথম দিকে কুমিল্লার প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীরা মিলে কুমিল্লা প্রগতি মজলিস নামের এই সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করে।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক অজিত নাথ নন্দী, অধ্যাপক আবুল খায়ের আহমদ ও অধ্যাপক আশুতোষ চক্রবর্তী যথাক্রমে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ মনোনীত হন। সম্মেলনের আহ্বান ছিল-
‘জাতি-ধর্ম, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, বিত্তহীন-বিত্তশালী নির্বিশেষে এবং যে বিশাল জনতা যুগ যুগ ধরিয়া মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া নীরবে সভ্যতার ও সংস্কৃতির বুনিয়াদ গঠন ও ধারণ করিয়া আসিতেছে তাদের সবাইকে’ সম্মেলনে যোগদানের আহ্বান জানানো হয়।
সম্মেলন অনুষ্ঠানে ফরয়ার্ড ব্লক, যুবলীগ, কম্যুনিস্ট পার্টি, রেভোলিউশনারী সোশালিস্ট পার্টিসহ অন্যান্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের কুমিল্লা শাখাসমূহ সহযোগিতা করেছিল।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ আখতার হামিদ খান আর্থিক আনুকূল্য ছাড়াও ঢাকা থেকে শিল্পী-সাহিত্যিকদের কুমিল্লায় আসার জন্য নারায়ণগঞ্জ থেকে দাউদকান্দি পর্যন্ত বিনাভাড়ায় লঞ্চের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
উদ্যোক্তাগণ এই সম্মেলনকে ‘সরকার বিরোধী শিল্পী-সাহিত্যিক সম্মেলন’ হিসেবে রূপ দিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। সেজন্য সরকারি কলেজের শিক্ষক হওয়ায় অধ্যাপক শওকত ওসমান সম্মেলনে এসেও প্রবন্ধ পাঠের সুযোগ পাননি।
সম্মেলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়, তাদের প্রস্তাবিত সম্মেলনের প্রধান বিশেষত্ব হবে ‘আত্মসমীক্ষা’। পাকিস্তান রাষ্ট্রের নাগরিকরা বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে জাতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কতদূর অগ্রসর হতে পেরেছেন; শিল্পে, সঙ্গীতে, সাহিত্যে, বিজ্ঞানে কি তারা দিতে পেরেছেন, কি পারেননি, তাই তারা ‘মোহমুক্ত চিত্তে’ পরীক্ষা করে দেখতে চান। এই আত্মসমালোচনার মধ্য হতেই শিল্পী-সাহিত্যিক ও বিজ্ঞান সাধকগণ নিজেদের শক্তি ও সফলতা বুঝতে পারবেন এবং তারই প্রেক্ষিতে রচিত হতে থাকবে ভবিষ্যতের কর্মধারা।
অনুষ্ঠানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলা ও প্রতিষ্ঠানের শিল্পীগণ অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে ছিল চট্টগ্রামের প্রান্তিক শিল্পীসংঘ ও রেলওয়ে শিল্পীসংঘ, ঢাকার আর্ট স্কুল, পূর্ব পাকিস্তান শিল্পী সংসদ, প্রচার বিভাগের শিল্পীগণ, বেতার শিল্পী, অগ্রণী শিল্পী সংঘ, অগত্যা গ্রুপ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক। ঢাকা আর্ট স্কুল একটি চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করে কুমিল্লা টাউন হলের থিওসফিক্যাল ভবনে। এর দায়িত্বে ছিলেন পটুয়া কামরুল হাসান। বেগম সুফিয়া কামাল চিত্রপ্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন। কুমিল্লা জিলা স্কুলের শিক্ষক আলী আহমদ পরে কলেজের বাংলার অধ্যাপক তাঁর সংগৃহীত হাতে-লেখা পুঁথির একটি প্রদর্শনী করেছিলেন টাউন হল প্রাঙ্গণে। সম্মেলনের প্রতিদিনের অনুষ্ঠান দুই পর্বে বিভক্ত ছিল: সকালে প্রবন্ধপাঠ, কবিতা-আবৃত্তি ও বক্তৃতা; আর বিকালে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দ্বিতীয় পর্বের অনুষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন সালাহউদ্দীন আহমদ, কলেজের ডেমোনেন্ট্রটর। ১৯৫২ সালের ২২ আগস্ট সকালে সম্মেলন উদ্বোধন করেন অধ্যক্ষ আখতার হামিদ খান। এরপর অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি অজিত নাথ নন্দী লিখিত ভাষণ দেন। অজিত নাথ নন্দী লোকসংস্কৃতিকেই মূলত দেশের প্রাণ হিসাবে উল্লেখ করে বলেন:
‘এই লোক-সংস্কৃতি যাহা প্রকৃতির কোলে লালিত-পালিত, যাহা আড়ম্বরহীন জীবনযাত্রার সরল সুষমায় রমণীয়, সেই সংস্কৃতির মুমূর্ষুু শক্তি ও সাধনাকে জাগাইয়া তুলিতে হইবে। এই সংস্কৃতি সহজ জীবনের আত্মপ্রকাশ, ইহার উপকরণ ও প্রেরণা প্রতি দিবসের দুঃখ-সুখে চঞ্চল, সরল জীবনযাত্রা। এই জীবন মেঠো সুরে, রাখালিয়া সঙ্গীতে বাণীময় হইয়াছে। এই জীবনেরই রসরোধের তৃপ্তিসাধন করিয়াছে পল্লী আসরের জারী গান ও কবি গান। নানা অনুষ্ঠান ও উৎসব এই জীবনের রসতৃষ্ণায় তৃপ্তি আনিয়া দিয়াছে।’
সম্মেলনের মূল সভাপতি ছিলেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। রাষ্ট্রভাষা বিতর্কের প্রশ্নে তিনি বলেন,
‘আজ প্রশ্ন উঠিয়াছে, বাংলা আমাদের সংস্কৃতির ভাষা হইতে পারে না। আমাদের ধর্ম, ঈমান এই ভাষায় অটুট থাকিতে পারে না। এই প্রশ্নের কোন জবাব দেওয়া আমার কাছে লজ্জার ব্যাপার। বাদুড়ের ডানার ঝাপটায় চাঁদ কি মুখ কুণ্ঠিত করিয়া থাকে?... সংস্কৃতি ধ্বংসের অনেক পথ আছে। জনসাধারণ-বিরোধী ও সমাজ-বিরোধী গোয়ার-নীতি তার অন্যতম উপায় বটে। কিন্তু তার পরিণাম ফল পারস্যে আরবদের ভাগ্যের মতই হইতে বাধ্য।’
শেষে তরুণ সংস্কৃতিসেবীদের উদ্দেশে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বলেন,
‘জ্বলন্ত স্বদেশ-প্রেম ছিল বলিয়াই রবীন্দ্রনাথ-নজরুল জাতীয় কবির মর্যাদা লাভ করিয়াছেন। আজ আপনাদের মত তরুণ হৃদয়ের সংস্পর্শে আসিয়া মৃত্যুর পূর্বে কথঞ্চিৎ সান্ত্বনা লইয়া মরিতে পারিব আশায় অসার দেহ-মন লইয়া, বার্ধক্যের নানা উপসর্গ সঙ্গে করিয়া আমি এখানে আসিয়াছি। আমার এই বিশ্বাস আছে যে, আমার দেশের মৃত্যু নাই, আমার দেশের আত্মা যে জনগণ, তারও মৃত্যু নাই, তেমন অমর আমার এই বাঙ্গালা ভাষা।’
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন তেইশ তারিখের সকালের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন মাহববু-উল-আলম। তিনি বলেন:
‘আমার এক একবার মনে হয়, আমরা যেন বারুদ-স্তূপের উপর বসে আছি। সাহিত্যিকের দৃষ্টি দিয়ে আমি দেখতে পাই, আমরা একটা বিপ্লবের মুখে ছুটে চলছি। এই বিপ্লবের ফল হবে দু’টো। প্রথমতঃ, সমাজের বর্তমান অর্থনৈতিক বুনিয়াদ ভেঙ্গে পড়বে। তার স্থানে মাথা তুলবে নতুন নীতি, ধনসাম্যের একটা অভিনব ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। সেটা ইসলামিক হতে পারে, যদি সময় থাকতে আমরা সাবধান হই এবং কাজ করি। দ্বিতীয়তঃ, ধর্ম এবং উহার আচার স্বীকৃত হবে মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে। আমি বিশ্বাস করি, এই স্বীকৃতির মধ্যেই রয়েছে আমাদের নিরাপত্তার আভাষ।’
অধিবেশনে অধ্যাপক আহমদ শরীফ ‘তন্ত্রসংকট’ শীর্ষক প্রবন্ধ পড়েন।
সম্মেলনের তৃতীয় দিন চব্বিশ তারিখের সকালের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন কুমিল্লার ঈশ্বর পাঠশালার শিক্ষক অবনীমোহন চক্রবর্তী। তিনি বলেন,
‘স্বাস্থ্যপদ বায়ু পৃথিবীর যেদিক হইতেই আসিয়া দ্বারে আঘাত করুক, তাহাকে সাদরে অভ্যর্থনা করিয়া লইবার শিক্ষাই আমাদের বড় শিক্ষা, নতুন দিনের সাহিত্যিকদের ইহাই কাজ। এই পথে তাহারা অগ্রসর হইয়া নব-সাহিত্য, নব-জাতি, নব-সমাজ, নব-সংস্কৃতি রচনা করুন, ইহাই কামনা।’
চব্বিশ তারিখের অধিবেশনের বিশেষ বক্তা ছিলেন কবি জসীম উদ্দীন। সম্মেলনের সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেও অসুস্থ অবস্থাতেই বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন:
‘আমাদের রাষ্ট্র কেবল নাজিমউদ্দীন বা নুরুল আমীনের নয়, এই রাষ্ট্র জনগণের। এই রাষ্ট্র রক্ষার দায়িত্ব তাদেরই। তাদেরকে তাদের রাষ্ট্র বুঝিয়ে দিতে হবে। সত্যিকারের স্বাধীনতা সেদিনই আসবে যেদিন আমাদের দেশের চাষী-মাঝি-মাল্লা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে সাহিত্য বা সঙ্গীত সৃষ্টি করবে এবং তা আদৃত হবে।’
কুমিল্লা পৌরসভার চেয়ারম্যান অতীন্দ্রমোহন রায় উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে সম্মেলনে যোগদানকারী সাহিত্যিকদের ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন:
‘রাত্রির অন্ধকার যত গভীর হোক, অরুণোদয় ঘটবেই। আমাদের বিগত ঐতিহ্যকে স্মরণ রেখে আমাদের সংস্কৃতি গড়ে উঠবে মুক্ত উদার দৃষ্টিভঙ্গী ও সাম্যবাদের উপর ভিত্তি করে।.... ধন্যবাদ জানাই তাদের, যারা এ কয়দিনের মধ্যে দিয়ে আমাদেরকে বুঝিয়েছেন যে, আমাদের চোখ পেছনে না-সামনে।’
সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে প্রতিদিন সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। প্রথম দিন বসে নজরুল সঙ্গীতের আসর। উদ্বোধন করেন মাহবুবুল আলম চৌধুরী। দ্বিতীয় দিনে আয়োজন করা হয় রবীন্দ্রসঙ্গীতের। সঙ্গীতানুষ্ঠানের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদ বিজন ভট্টাচার্যের ‘জবানবন্দী’ নাটক মঞ্চস্থ করে। তৃতীয় দিন বসে লোকসঙ্গীত ও গণসঙ্গীতের আসর। চট্টগ্রামের পাকিস্তান শিল্পী গোষ্ঠী চাটগাঁর আঞ্চলিক ভাষায় রচিত লোকগীতি পরিবেশন করে। বাঁশী বাজিয়ে শোনান সুচরিত চৌধুরী। সেদিন দুটি পালা গান গাওয়া হয়। নোয়াখালীর বৃদ্ধ কবিয়াল কোরবান আলী সর্দার পাকা দাঁড়িতে খেজাব লাগিয়ে ঘুঙুর পায়ে শ্লথ ধুতি পরিধান করে নাচের ভঙ্গীতে ‘চৌধুরীর লড়াই’ পালা পরিবেশন করেন। দর্শকশ্রোতারা মাইকের কথা বললেই কবিয়াল প্রমাদ গুণলেন। কারণ ও জিনিসটা তিনি সহ্য করতে পারেন না। তবু মাইক আনা হলে কবিয়াল বসে পড়লেন। এরপর চট্টগ্রামের কবিয়াল রমেশ শীল ‘যুদ্ধ বনাম শান্তি’ পালা গাইলেন। তিনি নেন যুদ্ধের পক্ষ। আর তাঁর শিষ্য রায় গোপাল নেন শান্তির পক্ষ। সবশেষে গৌরীপুর স্কুলের ‘স্কাউট’ ছেলেরা তাদের শিক্ষক মুহম্মদ ওয়াজেদ আলীর নেতৃত্বে সমবেত সঙ্গীতে অংশগ্রহণ করে।
কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত ১৯৫২ সালের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বিশেষভাবে তাৎপর্যমণ্ডিত ছিল। এই সম্মেলনেও বামপন্থীরা জড়িত ছিলেন। কিন্তু সম্মেলন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ১৯৫১ সালের চট্টগ্রাম সম্মেলনের অভিজ্ঞতার আলোকে কুমিল্লা সম্মেলনে কোনো ভারতীয় লেখককে উদ্যোক্তারা আমন্ত্রণ জানাননি। উদ্যোক্তারা পূর্ব বাংলায় নিজেরাই নিজেদের সাংস্কৃতিক ভাগ্য নির্মাণের ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। ফলে বামপন্থীদের উদ্যোগে হলেও এই সম্মেলন দক্ষিণপন্থীদের মধ্যেও আলোড়ন তোলে।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ আখতার হামিদ খানসহ অন্যান্য প্রধান শিক্ষকদের ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। আজ স্বাধীন বাংলাদেশ যে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত-চিত্রকলা ও সংস্কৃতিচর্চায় এগিয়ে গেছে, ১৯৫২ সালে অগাস্ট মাসের তিনদিন (২২-২৪) ব্যাপী সম্মেলনের ভূমিকা ছিল সুদূরপ্রসারী। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ এভাবে জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছিল। আমাদের ভুললে চলবে না যে আমরা এই ঐতিহ্যের কাছে চিরঋণী। তা কোনো আবেগের খেরোখাতার দলিল নয়, বাস্তবতার যুগোপযোগী দিকনির্দেশনার ইস্তেহার, যাকে বলা যায় ‘সর্বজনীন সংবিধান।’
তথ্যসূত্র ঃ
১. সাঈদ-উর-রহমান, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম, পান্ডুলিপি, (আনিসুজ্জামান সম্পাদিত) ষষ্ঠ খন্ড, ১৩৮৩, পৃ ৯১।
২. পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন, রেজোয়ান সিদ্দিকী, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
