
গত শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে শক্তিশালী ভূমিকম্পে কাঁপল দেশ। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল রাজধানী ঢাকার খুব কাছে নরসিংদীর মাধবদী উপজেলায়। ৫ দশমিক ৭ মাত্রার মাঝারি মানের এ ভূমিকম্প স্মরণকালের মধ্যে তীব্রতার দিক থেকে নজিরবিহীন। তবে মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস বলছে, এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৫। ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে এটার উৎপত্তি। ৫ দশমিক ৭ মাত্রার মাঝারি এ ভূমিকম্পকে কম্পনের তীব্রতার দিক থেকে নজিরবিহীন বলছেন ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা। ভূমিকম্পের প্রভাব পড়েছে ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোতেও। ভূমিকম্পের প্রভাবে বিভিন্ন স্থানে দেয়াল ধসে পড়েছে। কোনো ভবনের রেলিং ও অংশবিশেষ ভেঙে পড়তে দেখা গেছে। বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে ফাটল। পরিবেশ উপদেষ্টা এটিকে সতর্কবার্তা বলেছেন। ভূমিকম্পে হতাহতের ঘটনায় শোকবার্তা জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দেশে গত শুক্রবারের ভূমিকম্পে অন্তত ১০ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন ৫০০-এরও বেশি মানুষ। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের জরুরি বিভাগে আহত রোগী ও স্বজনদের ভিড় দেখা গেছে। আহতদের কারও হাত ভাঙা, কারও পা ভাঙা। ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সরা। এসব রোগী এবং রোগীর স্বজনরা জানান, ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কে দৌড়াদৌড়ি, হুড়োহুড়ি, লাফিয়ে পড়তে গিয়ে লোকজন আহত হয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড় ভূমিকম্পগুলো ১৫০ বছর পরপর ফিরে আসার আশঙ্কা থাকে। এদিক থেকে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে। তাই এই ভূমিকম্পের পর সবাইকে সচেতন ও সাবধান হতে হবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। আর্থকোয়েক নিউজ এজেন্সির তথ্যমতে, মাধবদীতে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল হওয়ায় আগামী ১০ থেকে ১২ দিন পর বাংলাদেশসহ হিন্দুকুশ পর্বতমালা ও পামির এলাকায় বিভিন্ন স্থানে মাঝারি থেকে শক্তিশালী মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।
ঢাকায় ২১ লাখেরও বেশি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। রাজউকের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই নির্মিত বহুতল ভবনগুলো ঢাকাবাসীর মৃত্যুঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। ভূমিকম্পের ঝুঁকি সূচকের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের ২০টি সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ নগরের শীর্ষে রয়েছে ঢাকা। এই ঝুঁকির শহরে ১৩ শতাংশ জায়গায় কোনো ধরনের ভবন নির্মাণ না করতে বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু এই পরামর্শ উপেক্ষা করছেন আবাসন ব্যবসায়ীরা। রাজউকের একটি গবেষণা দলের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের পাঁচটি বড় ফল্ট অঞ্চল রয়েছে মধুপুর ফল্ট, দাউকি ফল্ট, প্লেট বাউন্ডারি ফল্ট-১, প্লেট বাউন্ডারি ফল্ট-২, প্লেট বাউন্ডারি ফল্ট-৩। এই ফল্টির প্রতিটি রিখটার স্কেলে ৭ থেকে ৮ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে সক্ষম। মধুপুর ফল্ট লাইনের পাশে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীর সাড়ে ৮ লাখ ভবন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজউকের মাধ্যমে সব বিল্ডিং কোড নিরীক্ষা করা জরুরি। ভবনগুলোকে সবুজ, হলুদ, লাল- এই তিন শ্রেণিতে চিহ্নিত করা যেতে পারে। সবুজ মানে ঝুঁকিমুক্ত, হলুদ মানে সংস্কার প্রয়োজন এবং লাল ভবন মানে অবিলম্বে খালি করে মজবুত করা জরুরি।
দেশে স্মরণকালের ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়ে গেল, যা আমাদের জন্য খুবই ভয়াবহ সতর্কবার্তা। ঢাকার ভবনগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া ফাঁকা জায়গারও চরম অভাব। ঢাকায় বড় ধরনের দুর্যোগ বা ভূমিকম্প হলে মানুষের আশ্রয় নেওয়ার মতো খোলা জায়গার স্বল্পতা বিপদের কারণ হতে পারে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে চরম উদাসীন। আমরা দেখছি, জলাশয় ভরাট করা হচ্ছে, পার্কগুলো অবৈধভাবে দখল করা হচ্ছে। সবুজ ধ্বংস করে জীববৈচিত্র্য নষ্ট করা হচ্ছে। এক কথায় সবুজের বদলে প্রতিযোগিতা করে কংক্রিটের নগরী গড়ে তোলা হচ্ছে। প্রকৃতিও বদলা নিচ্ছে এসব কারণে। সরকারকে এখনই বৃহৎ পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে এবং এ ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় করণীয় কী হবে, তা ঠিক করতে হবে। বিশেষজ্ঞ পরামর্শ কাজে লাগাতে হবে। ভূমিকম্প ঝুঁকিপ্রবণ এলাকাগুলোয় লিফলেট, প্রচার-প্রচারণা ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
