পৌনে
৩ বছর ধরে ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ দেখিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) চাকরি
করছেন মার্কেটিং বিভাগের প্রভাষক আবু ওবায়দা রাহিদ। এখানে যোগদানের সময়
তিনি কুমিল্লার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৬ বছর ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে চাকরির
অভিজ্ঞতা সনদ প্রদর্শন করেন। কিন্তু রাহিদের সিসিএনে ছয় বছরের অ্যাকাডেমিক
সম্পৃক্ততা, নিয়োগপত্র ও অন্যান্য নথিপত্র দেখাতে পারেনি সিসিএন
কর্তৃপক্ষ।
জানা যায়, ২০২৩ সালের ২৯ জানুয়ারি যোগ্যতার শর্ত পূরণ না
করলেও আবু ওবায়দা রাহিদকে নিয়মবহির্ভূতভাবে নিয়োগ দেন তৎকালীন আওয়ামী
সমর্থিত উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবদুল মঈন। ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের শিক্ষক
নিয়োগের বিধিমালা অনুযায়ী চাকরিপ্রার্থীর স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের ফলাফল
ন্যূনতম ৩ দশমিক ৭০ হতে হবে। তবে রাহিদকে মার্কেটিং বিভাগে নিয়োগ দিতে
অভিনব উপায়ে অননুমোদিত একটি বিধি যোগ করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন তৎকালীন
উপাচার্য। ওই বিধিতে এমফিল বা পিএইচডি ডিগ্রিধারী অথবা শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা
থাকলে ফলাফলের যোগ্যতায় শিথিলতার কথা বলা হয়। যদিও সে সময় এ বিধিটিও
বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুমোদিত ছিল না। রাহিদের স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের ফলাফল ছিল
যথাক্রমে ৩ দশমিক ৫৬ ও ৩ দশমিক ৫৪। ফলাফল কম থাকার পরও এ বিধির আলোকে
সিসিএনে শিক্ষকতার ‘ভুয়া’ অভিজ্ঞতা সনদ দেখিয়ে নিয়োগ ভাগিয়ে নেন তিনি।
গত
৫ মার্চ "আ.লীগ নেতার চাপে ভুয়া সনদেই চাকরি" শিরোনামে দেশ রূপান্তরে একটি
সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদ প্রকাশের পর শিক্ষার্থীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে
একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি সিসিএনের কাছে রাহিদের নথিপত্র
চেয়ে একটি চিঠি দেন। পরবর্তীতে সিসিএন কর্তৃপক্ষ গত ১১ অক্টোবর চিঠির
প্রতুত্তর দেন।
চিঠিতে রাহিদের সিসিএনে অ্যাকাডেমিক সম্পৃক্ততার
ব্যাপারে বলা হয়, তিনি ২০১৭ সালে এক সেমিস্টার এবং পরবর্তীতে ২০২১ ও ২০২২
সালে ৪ থেকে ৫ সেমিস্টার ক্লাস গ্রহণ করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ীভাবে
নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন না; বরং বিশেষ প্রয়োজনে ও চুক্তিভিত্তিকভাবে ক্লাস
নিতেন। সিসিএনের তার কার্যক্রম তৎকালীন বোর্ড অব ট্রাস্টিজের প্রয়াত
চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কুমিল্লা অ্যাডভোকেট
আবদুল মতিন খসরুর বিশেষ সুপারিশে শুরু হয়।
প্রশাসনিক সুবিধার্থে কিছু
নথিপত্র ও বিভাগের কাগজপত্রে তাঁকে পূর্ণকালীন প্রভাষক হিসেবে উল্লেখ করা
হলেও তাঁর জন্য কোনো স্থায়ী নিয়োগপত্র বা প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা প্রদান করা
হয়নি। তাঁর ব্যক্তিগত ফাইলে গৃহীত ক্লাসের শিডিউল, পূর্ববর্তী
সেমিস্টারসমূহের রুটিন ও ক্লাসভিত্তিক পেমেন্টের নথি সংরক্ষিত আছে বলে
জানায় কর্তৃপক্ষ।
অভিজ্ঞতা সনদ প্রদানের ব্যাপারে বলা হয়, প্রয়াত
চেয়ারম্যানের সুপারিশে ও বহিঃস্থ রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক অনুরোধে ও তাঁর
অনুরোধক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের প্রভাষক পদে ২০১৬
সালের ২৫ নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত অভিজ্ঞতার সনদ প্রদান
করা হয়, যা তিনি পরবর্তীতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে
শিক্ষক পদে আবেদনের জন্য ব্যবহার করেছেন।
সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে দীর্ঘদিন জড়িত থাকলেও তাঁর নিয়োগটি পূর্ণকালীন না
হওয়ায় তাঁর নিয়োগের জন্য যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। যার ফলে তাঁর
ব্যাক্তিগত ফাইলে সেমিস্টার ভিত্তিক ক্লাস গ্রহণের তথ্য ব্যতীত আর কোনো
তথ্য নথিতে সংরক্ষিত নেই।
এসব বিষয়ে জানতে সিসিএনের চেয়ারম্যান তারিকুল
ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না। এসব
রেজিস্ট্রার দেখে আপনারা রেজিস্ট্রারের সাথে কথা বলেন। আমি তখন অ্যাকশন
নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু ইচ্ছে করে নেইনি। সিসিএন ভুয়া সনদ দেয় এটাতো আপনারা
আগেও লিখেছেন। এখনো লিখেন, সমস্যা নাই। এটা প্রমাণিত হলে হবে।
রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মো: জামাল নাছেরের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।
এই
তদন্ত কমিটির আহবায়ক হিসেবে আছেন ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড.
মো: আহসানউল্লাহ। আব্দুল মঈনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে রাহিদকে
বাঁচাতে তদন্তে গড়িমসির অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা কেন
গড়িমসি করবো আমরাও চাই এই ঘটনার সত্যতা উঠে আসুক। আমরা সবকিছু বিবেচনা করে
তদন্ত করেছি। এরপর প্রতিবেদন জমা দিব। বাকিটা কর্তৃপক্ষ দেখবে।
ভুয়া
সনদের বিনিময়ে চাকরির বিষয়ে জানতে চাইলে আবু ওবায়দা রাহিদ বলেন, আপনি আমাকে
যেই প্রশ্নগুলো করেছেন আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। আপনি এর বাইরে কিছুই
লিখতে পারবেন না। তদন্ত কমিটি ডাকলে আপনি গড়িমসি করেন কেন জানতে চাইলেও
তিনি বলেন, আমি বারবারই বলবো এই ব্যাপারে কিছুই জানি না।
ইউজিসির
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ জামিনুর রহমান
বলেন, এটাতো একটা গর্হিত অপরাধ। কেউ যদি এটা করে থাকে তাহলে তার গুরুতর
শাস্তি হওয়া উচিত। আপনারা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেন।
তারা ব্যবস্থা না নিলে আমাদেরকে জানাবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য
অধ্যাপক ড. মো: হায়দার আলী বলেন, আমরা তদন্ত কমিটি করেছি। কমিটি অভিযোগের
সত্যতা এবং অনেকগুলো তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে। আমরা বিষয়টি সিন্ডিকেটে তুলবো।
এরপর সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেব।
