
শুরু
হয়েছে কপ-৩০ পৃথিবীর জলবায়ু সম্মেলন ব্রাজিলের বেলেম শহরে। পৃথিবীর প্রায়
২০০টি দেশ অংশ গ্রহণ করছে এ সম্মেলনে। স্থানীয় খাদ্য সংস্কৃতি ও উৎপাদন
ব্যবস্থাকে জোরদার করতে আদিবাসী ও জনগোষ্ঠীর জীবনের সুরক্ষার দাবি জানান
ব্রাজিলের গবেষক নাজাবেস হেইস ১১ই নভেম্বরের এক অধিবেশনে। ঐ অধিবেশনে
ব্রাজিলের প্রতিনিধি ফেসিসিও মুরিয়ানা, ফ্রান্সিন জেভিয়ার, বেলাগিন বা
ব্রুনা সারকুইয়েরাদের আলাপেও অধিকার সুরক্ষার বিষয় ওঠে আসে। ১২ই নভেম্বর
রাশিয়ার ‘সেন্টার ফর সাপোর্ট অব ইনডিজেনাস পিপলস অব দা নর্থের (সিএসআইপএন)
প্রতিনিধি দেইরা এগ্রেইভা রাশিয়ার এনডিসিকে বিশ্লেষন করে জানান। সেখানে
রাশিয়ার আদিবাসীদের অধিকার এবং অঞ্চলের জলবায়ু অভিজ্ঞতাকে যুক্ত করা হয়নি।
তুষারপাতের পরিবর্তন এবং আদিবাসীদের মৌসুম ভিত্তিক শিকার ও খাদ্য সংগ্রহের
জটিলতা দুরকরণের এনডিসিতে কিছু নেই। আদিবাসীদের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে
একত্র করে গন্য করা যাচ্ছে না। উভয়কে পৃথকভাবেই স্বীকৃতি দিতে হবে। পেরুর
আমাজন বনের আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের প্রতিনিধি ইনপুটানারি জাতির সদস্য
কেটি মার্সেলো ১২ নভেম্বর এক অধিবেশনে বলেন, এনডিসি প্রতিবেদনে বহু জটিল
শব্দ ব্যবহার করা হয়। যা আদিবাসীদের ঐতিহাসিক জ্ঞান কান্ডকে তুলে ধরতে পারে
না। বিশেষ করে আদিবাসী নারীরা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বেশি ভুক্তভোগী হলেও
তাদের সংগ্রামকে যুক্ত করা হয়নি।
১৩ই নভেম্বর অনুষ্ঠিত ‘দা সেন্ট্রাল
রোল অব ইনডিজেনাস পিপল এন্ড লোকাল কমিউনিটিস ইন জাষ্ট এনার্জি ট্রানজিশন’
শীর্ষক অধিবেশনে বক্তারা আদিবাসী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে জ্বালানি শক্তি
রুপান্তর প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে রাখার মতামত দিয়েছেন।
১৪ই নভেম্বর জানা
যায়, মরু অঞ্চলের পশুপালনজিবী ও যাযাবর আদিবাসী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীরা বেশি
ক্ষতিগ্রস্ত। ক্ষতিগ্রস্তদের সামগ্রিক সক্ষমতার বিষয়গুলো ছিল এনডিসিতে
অনুপস্থিত। ১৪ই নভেম্বর ব্লু জোনে প্রবেশমুখে বিক্ষোভের সময় তাদের সঙ্গে
কথা বলেন বেলেম সম্মেলনের সভাপতি আন্দ্রে কোরেয়া দ্যলাগো। আদিবাসীরা প্রশ্ন
তুলেছেন, আলোচনার টেবিলে যদি তাঁদের জায়গা না হয়, তবে কেন তাঁদের বন থেকে
এত দূর আসতে হলো?
দুবাই সম্মেলনের ঘোষনা অনুযায়ী ব্রাজিলসহ কয়েকটি দেশ
চায় জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে ধীরে ধীরে সরে আসতে। ২০৩৫ সালের ভেতর সবুজ
জ্বালানির ব্যবহার চারগুন বাড়াতে রাষ্ট্রগুলোকে চাপে রেখেছে বেলেম। কিন্তু
সম্মেলনের ১ সপ্তাহ পার হলেও বিশ্বনেতারা নির্দয়ভাবে নিরব। জলবায়ু সংকটের
গল্প কোনভাবেই কেবল আবহাওয়াবিজ্ঞগণ আর গবেষণাগারের বিষয় নয়। দুনিয়ায় জারি
থাকা কাঠামোগত বৈষম্য, বহুমুখী বঞ্চনা, শ্রেণি ও বর্গীয় বিবাদ, বাইনারি
বিভাজন, কলোনিয়াল লিগ্যাসি আর সাময়িক উন্নয়নের ফলাফল - এসব বিষয় আড়ালে
রেখে, বৈষম্য ও ক্ষমতার প্রবলতা চুরমার না করে কোনভাবেই সবার জন্য কোন
ন্যায্য বার্তা আনতে পারবে না বেলেম সম্মেলন। ১৫ই নভেম্বর তরুন জলবায়ু
কর্মীরা আদিবাসীদের সপক্ষে বন ও বসতি সুরক্ষায় বৈশ্বিক সংহতি তৈরি করেন।
ইনডিজেনাস ইয়ুথ ফোরামের নৃবিজ্ঞানী কামিলা রুবেরু এনডিসি প্রক্রিয়ায়
আদিবাসী যুবদের কার্যকর অংশগ্রহণ যুক্ত করার উপর গুরুত্ব দেন।
ব্লু
জোনের সম্মেলনস্থলে আমাজনের আদিবাসীদের ঢুকতেই দেয়া হয়নি। প্রথম সপ্তাহটি
এর প্রতিবাদে মুখর ছিল। ‘জলবায়ু সংকট সমাধানের উত্তর আমাদের কাছে আছে’
শ্লোগান নিয়ে এলডেইয়া কপ থেকে লুমাস ভেলেন্টিনাস পর্যন্ত ‘আদিবাসী বৈশ্বিক
পদযাত্রায়’ সংহতি জানান হাজারো মানুষ। একটি ছুটির দিন মাঝে রেখে দুই
সপ্তাহের জলবায়ু সম্মেলনের কার্যক্রম আবার শুরু হয় ১৭ই নভেম্বর। জীবাশ্ম
জ্বালানিকে বৈধতা দেয়ায় ১ হাজার ৬০০ লবিষ্ট সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। বায়ার
ক্রপ সাইন্স ও নেসলের মত কৃষিবিষ ও খাদ্য নিয়ন্ত্রণকারী বহু জাতিক
কোম্পানিগুলো জলবায়ু সম্মেলনের স্পন্সর হিসাবে আছে। জলবায়ু সম্মেলন যেন
প্রাণ ও প্রতিবেশ সংহারী এজেন্সিগুলোর কাছে জিম্মি। এ জিম্মিদশা থেকে
জলবায়ু সম্মেলনকে মুক্ত রাখতে প্রকৃত পরিবেশবাদীরা একমত।
জলবায়ু তহবিলের
ক্ষেত্রে ‘বাকু টু বেলেম রোডম্যাপ’ এখনো ২য় সপ্তাহের জন্য আলোচনার টেবিলে
পড়ে আছে। ১৫ই নভেম্বর বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের সংবাদ সম্মেলনে মৎস্য ও
প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আক্তার বলেন, ‘কোন দায় বা ঋণ নয়,
অনুদান হিসাবে জলবায়ু অর্থায়নের জন্য বাংলাদেশ দাবী করে আসছে। জলবায়ু
অর্থায়ন আমাদের অধিকার রাষ্ট্রগুলোর অভিযোজন পরিকল্পনা। অভিযোজন তহবিল,
বৈশ্বিক অভিযোজন লক্ষামাত্রা, জেন্ডার, ক্ষয়ক্ষতি, পূর্ববর্তী অঙ্গীকার
নিয়ে সম্মেলনের ২য় সপ্তাহটি সরব থাকবে। ক্রান্তীয় বর্ষারন্য সুরক্ষায় গঠিত
‘ট্রপিকেল ফরেষ্টস ফর এভার ফান্ড (টিএফএফএফ)’ নামে নতুন জলবায়ু তহবিলে
ইতিমধ্যে ৫৩টি দেশ সই করেছে। ৫৫০ কোটি ডলারের টিএফএফএফ তহবিল ঘোষনা করা
হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য এ চুক্তি সই ও তহবিল আদায় করা জরুরি। আড্ডায়
বাংলাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে নীল, তেভাগা, ভানুবিল,
নানাকার, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং গণঅভ্যুত্থানের শক্তি ও তুলে ধরা
হয়। থাইল্যান্ড থেকে আসা সোহেল হাজং টঙ্ক বিদ্রোহের বিষয়টি যুক্ত করেন।
পর্তুগীজ উপনিবেশের ব্রাজিলীয়ান ইতিহাসত পুরো পেভিলিয়ান জুড়ে ছিল।
জলবায়ু
সম্মেলনের সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণে যখন আমাজন বন কাটা হয়, তখনই আদিবাসীরা
প্রতিবাদ জানান। এ নিয়ে ১৫ই নভেম্বর কথা হয়। এতে বন্য প্রাণী এবং মানুষের
চলাচলে বিঘ্ন ঘটেছে। অনেকে বসতি ছেড়ে শহরে বা বনের আরো ভেতরে চলে যেতে
বাধ্য হয়েছে। পরের দুদিনের (১৯-২০ নভেম্বর) প্রতিপাদ্য হচ্ছে- খাদ্য
ব্যবস্থা, কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, মৎস্যখাত, পারিবারিক কৃষি, নারী,
জেন্ডার, আফ্রিকান বংশোদ্ভুত, পর্যটন ইত্যাদি। হয়তো বরাবরের মতই
বিশ্বনেতাদের মিথ্যা আশ্বাস, অঙ্গীকার ভঙ্গ, বানোয়াট সমাধান আর বিরক্তিকর
কালক্ষেপনের মধ্যে দিয়েই ২১ নভেম্বর শেষ হবে বেলেম জলবায়ু সম্মেলন।
আমাজন
বন বাঁচানোর দাবীতে সম্মেলনের গ্রীন জোন এবং কপ ভিলেজে কায়পো,
টুপিগুয়ারানি, টুপিনামা, তেম্বে, কায়াপো, হুয়ারানি, মুন্ডুরুকু,
ইয়ানুমামিসহ আমাজন বনের আদিবাসী জনতা সম্মেলনের শুরু থেকেই নানাহ প্রতিবাদ
কর্মসূচী করেছেন। পিপলস সামিট ক্লাইমেট মার্চের নামে ১৫ই নভেম্বর দীর্ঘ
জলবায়ু পদযাত্রায় পৃথিবীকে বিক্রি না করার জোর দাবী উঠেছে। নতুন কার্বন
বানিজ্য না চাপিয়ে জনগণের জলবায়ু সমাধানকে মেনে নিয়ে বিশ্বনেতাদের প্রতি
দ্রুত অঙ্গীকার বাস্তবায়নের দাবী জানানো হয়েছে পদযাত্রা থেকে। গ্রামীণ
জনগোষ্ঠীর সপক্ষে কোন সুস্পষ্ট অঙ্গীকার আনতে পারেনি বেলেম। অথচ আদিবাসী ও
স্থানীয় জনগোষ্ঠীই ঐতিহাসিকভাবে এ পৃথিবীকে তাদের শ্রম, মেধা, মূল্যবোধ,
অধ্যাত্মিকতা, দর্শন আর নৈতিকতা দিয়ে জাগিয়ে রেখেছেন। কিন্তু পৃথিবীর
ইতিহাস হল এক নিদারুন দূর্র্বৃত্তায়নের কাহিনী। দরদের ভঙ্গিমায় কর্তৃত্বকে
প্রতিষ্ঠার সুচতুর অভিনয় আর ভূপৃষ্ঠবাসী দেখতে নারাজ।
লেখক: প্রাক্তন অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ
