রুশ
দেশে লেনিনের নেতৃত্বে ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে যে ঐতিহাসিক বিপ্লব
ঘটেছিল, মাত্র কিছুদিন আগে তার পচাঁত্তর বছর পূর্ণ হল। সব স্মরণীয় বিপ্লবের
পিছনেই মানুষের কিছু মহৎ আদর্শের প্রেলণা থাকে। যেমন ছিল আঠারো শতকের ফরসি
বিপ্লবের পিছনে, যার অবিস্মরণীয় উচ্চারণ শুনতে পাই
আজও(স্বাধীনতা-সাম্য-ভ্রাতৃত্বের বাণীতে)। উনিশ শতকে বিপ্লবী চিন্তর
প্রখ্যাত নায়ক কার্লমাকর্স/ অতীত বিষয়ে কোনও মোহ রক্ষা করতে চাননি তিনি।
বরং ওইরকম মোহ ত্যাগ করাটাই তিনি তাঁর বৈপ্লবিক বর্তব্য বলে গ্রহণ
করেছিলেন। ফরাসী বিপ্লবের তেষট্রি বছর পর উনিশ শতকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে
মার্কস লিখলেন, অহ বহঃরৎব ঢ়বড়ঢ়ষব, যিরপয যধফ রসধমরহবফ ঃযধঃ নু সবধহং ড়ভ ধ
ৎবাড়ষঁঃরড়হ রঃ যধফ রসঢ়ধৎঃবফ ঃড় রঃংবষভ ধহ ধপপবষবৎধঃবফ ঢ়ড়বিৎ ড়ভ সড়ঃরড়হ,
ংঁফফবহষু ভরহফং রঃংবষভ ংবঃ নধপশ রহঃড় ধ ফবভঁহপঃ বঢ়ড়পয.” এক মুহূর্তে বিপ্লব
এদে দিয়েছে দ্রুত অগ্রগতির কল্পনা, পর মুহূর্তে ঘটেছে দ্রুত অধোগতি।
মার্ক্স বলছেন, ঞযব ংড়পরধষ ৎবাড়ষঁঃরড়হ ড়ভ ঃযব হরহবঃববহঃয পবহঃঁৎু পধহহড়ঃ
ফৎধি রঃং ঢ়ড়বঃৎু ভৎড়স ঃযব ঢ়ধংঃ, নঁঃ ড়হষু ভৎড়স ঃযব ভঁঃঁৎব. ওঃ পধহহড়ঃ নবমরহ
রিঃয রঃংবষভ নবভড়ৎব রঃ যধং ংঃৎরঢ়ঢ়বফ ড়ভভ ধষষ ংঁঢ়বৎংঃরঃরড়হ রহ ৎবমধৎফ ঃড়
ঃযব ঢ়ধংৎ.” (ঞযব ঊরমযঃববহঃয ইৎঁসধরৎব ড়ভ খড়ঁরং ইড়হধঢ়ধৎঃব) ফরাসী বিপ্লবের
পিছনে যে আদর্শ, যে প্রেরণা সেটা যতই শ্রদ্ধেয় হোক না কেন, তার বাস্তব
রূপায়ণে যে অসম্পূর্ণতা, যে ব্যর্থতা, তাকে স্বীকার করতে চেয়েছিলেন উনিশ
শতকের চিন্তানায়ক কার্ল মার্ক্স। অতীতের বিপ্লব অথবা তার পরিচিতি সম্বন্ধে
মোহাচ্ছন্নতায় বৈপ্লবিক আদর্শের প্রতি প্রকৃত বিশ্বস্ততা প্রকাশ পায় না,
বরং সেটা একরকমের অন্ধ বন্ধন। সমসাময়িক সমাজের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণই এগিয়ে
যাবার পথের নির্দেশ দিতে পারে, নতুন ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবার কাজে সহায়ক হতে
পারে।
রুশ বিপ্লব সম্বন্ধেও একই কথা সত্য। ওই বিষয়ে কোনও মোহাচ্ছন্ন
ধারণা রক্ষা করা আজকের দিনে কর্তব্য হতে পারে না। তাতে বৈপ্লবিক আদর্শের
প্রতি প্রকৃত বিশ্বস্ততা প্রকাশ পায় না। বিপ্লবোত্তর ঘটনার এবং সমসাময়িক
সমাজের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণই প্রয়োজন। মোহ ত্যাগ করেই অতীতের দিকে তাকাতে
হবে, সমকালীন ইতিহাসকে বুঝতে হবে, ভবিষ্যতের জন্র সঠিক পথে খুঁজতে হবে।
নভেম্বর বিপ্লবের কাছে যদি আমাদের কোনও ঋণ থাকে তবে মোহমুক্ত সমালোচনার
ভিতর দিয়েই ঋণ শোধ হতে পারে। যেহেতু নভেম্বর বিপ্লবের স্বীকৃত মতাদর্শ ছিল
মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ, কাজে ওই মতাদর্শের পুনর্বিচারও বিপ্লবের মোহমুক্ত
সমালোচনারই অন্তর্ভুক্ত। শতবর্ষপূর্বের সমজদর্শন আজরেক দিনেও মূলত
নির্ভরযোগ্য “কারণ মার্ক্সবাদ সত্য”, অর্থাৎ সর্বকালের জন্য সত্য, এইরকম
মৌলবাদী গোঁড়ামি দিয়ে ভবিষ্যতের জন্য বড় রকমের ভুল ঠেকানো যাবে না।
মার্ক্স
বিশ্বমানবতার আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। আদর্শ সাম্যবাদী সমাজের একটা কল্পনা
তাঁর চিন্তাভাবনায় ধরা পড়ে। সেখানে শোষণ থাকবে না, দারিদ্র থাকবে না, আর
প্রতিটি ব্যক্তির মুক্তি হবে সমাজের সামগ্রিক মুক্তির মৌল শর্ত। মুক্ত
মানুষ ও সাম্যধর্মী সমাজের চিত্র অবশ্য মার্কসের আগে ও পরে আরও অনেকের
লেখাতেই স্মরণীয় রূপে খুঁজে পাওয়া যায়, তাঁদের ভিতর কেউ কবি, কেউ-বা
দার্শনিক ও মানবতাবদী। মার্কসের আসল বৈশিষ্ট ওইখানে নয়। পূর্ববর্তী
সামস্যবাদীরেদ তিিিন “ইক্ষুটোপিয়ান” বা কল্পনাবিলাসী বলে সমালোচনা করেছেন।
আদর্শ সমাজের চিত্রাঙ্কনটাই যথেষ্ট নয়। যে সমাজে আমাদের অবস্থান সেখান থেকে
আদর্শ সমাজে কীভাবে পৌঁছানো যাবে সেই পথের সন্ধান দেওয়াটা জরুরি। মার্কসের
বৈশিষ্ট এইখানে যে, তিনি একটা পথের সন্ধান দিতে চেয়েছিলেন। মার্কসবাদের
বিচারে এই পথের কথাটা প্রধান।
মার্কস বিশ্বাস করতেন যে, ধনতন্ত্র থেকে
সাম্যবাদী সমাজে উত্তরণ ঘটবে বিপ্লবের পথে। মার্কস ও এঙ্গলসের শেষ দিকের
কিছু লেখাতে অবশ্য বলা হয়েছে যে, কোনও কোনও দেশে বিশেষ পরিস্থিতিতে
হিংসাত্মক বিপ্লবের প্রয়োজন না হতে পারে, অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ উপায়ে
উচ্চতর সমাজব্যবস্থায় উত্তরণ ঘটতে পারে। তবু মোটের উপর মার্ক্সীয় চিন্তায়
সমাজের গুণগত পরিবর্তনের জন্য বিপ্লবের আবশ্যকতার কথাটাই প্রাধান্য পেয়েছে।
এখানে বিপ্লব বলতে প্রথমেই বোঝাচ্ছে, ধনিকশ্রেণীর হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে
নিয়ে শ্রমিকশ্রেণীর প্রতিনিধিদের দ্বারা রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর
কর্তৃত্বস্থাপন। যেহেতু ধনিকশ্রেণী স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছাড়তে চাইবে না কাজেই
ক্ষমতার এই হস্তান্তর হিংসাত্মক বিপ্লবের পথে ঘটাই স্বাভাবিক এবং
শ্রমিকশেও্রণীকে এজন্য প্রস্তুত করে তোলা বিপ্লবীর কর্তব্য। অসংগঠিত
শ্রমিকশ্রেণীর দ্বারা একাজ সম্ভব নয়। লেনিন জোর দিয়েছিলেন বিপ্লবী দলগঠনের
ওপর। রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর সর্বহারার কর্তৃত্বপ্রতিষ্ঠা সম্ভব কেবল বিপ্লবী
দলের মাধ্যমে, সাম্যবাদে উত্তরণের এটাই পথ। মার্ক্সবাদ লেনিনবাদের এইরকম
কিছু কথা এতই সুপরিচিত যে এনিয়ে দীর্ঘ আলোচনা আপাতত অনাবশ্যক।
মার্কস
আশা করেছিলেন যে, বিপ্লব আগে ঘটবে প্রাগ্রসর কোনও ধনতান্ত্রিক দেশে, বিশেষত
জার্মানির কথা মার্কস এঙ্গেলসের চিন্তায় একটা প্রধান স্থাপ পেয়েছিল।
কিন্তু ১৯১৭ সালে বিপ্লব ঘটলে রুশদেশে। ততোদিনে জার্মানি ও জাপানে দ্রুত
শিল্পোন্নয়ন লক্ষণীয়। এই দুয়ের মাঝখানে রুশদেশ তুলনায় অনুন্নত, যদিও
সেখানেও উনিশ শতকের শেষভাগ থেকেই ধনতান্ত্রিক বিকাশ শুরু হয়ে গেছে।
বিপ্লবোত্তর সমাজের কৃতিত্বের তালিকায় বলা হয়ে থাকে যে, তিরিশের দশকে
পৌঁছতে না পৌঁছতেই সোবিয়েত দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করা গেছে, বিজ্ঞানের
প্রসার ঘটেছে, ব্যাধি ও বার্ধ্যকের বিরুদ্ধে সামাজিক বীমা প্রবর্তিত হয়েছে
সাধারণ শ্রমিকের জন্য, আর সেইসঙ্গে দ্রুত শিল্পায়নের পথে দেশ এগিয়ে গেছে।
সন্দেহ নেই, এইসবই উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব। তবে বিপ্লব ছাড়া এসব ঘটতে পারত না
একথা বলা যায় না। মনে রাখতে হবে যে, রূশবিপ্লবের অনেক আগেই উনিশ শতকের শেষ
ভাগে বিসমার্কের যুগে সামাজিক বীমা চালু হয়ে গেছে জার্মানিতে। বিশ শতকের
গোড়াতেই ব্যঅপক সাক্ষরতার প্রচলন হয়েছে জাপানে। জাপানের ও জার্মানিতে দ্রুত
শিল্পায়ন শুরু হবার পর রুশ দেশেও সেটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। স্টালিনী পথের
দোষগুণ নিয়ে তর্ক সম্ভব, কিন্তু শিল্পোয়ন্ননের অন্য কোনও পথ ছিল না এমন
দাবি করা যুক্তিসঙ্গত নয়।
আলোচনা আবশ্যক আরও একটা মৌল প্রশ্ন নিয়ে।
মার্কস জগৎটাকে বুঝতে চেয়েছিলেন। তিনি বিশেষভাবে বুঝতে চেয়েছিলেন
ধনতন্ত্রের গতিপ্রকৃতি। পরিবর্তনের সঠিক পথ বেছে নেবার জন্য এটা আবশ্যক।
এদিক থেকে মার্কসীয় তত্ত্ব কতটা সফল ? ধনতন্ত্রের গতিপ্রকৃতি কি সেই
তত্ত্বে নির্ভরযোগ্যভাবে ধরা গেছে ? রুশ দেশে বিপ্লবের পর লেনিনসহ বেশ কিছু
মার্ক্সবাদীর প্রত্যাশা ছিল যে, বিপ্লব ছড়িয়ে পড়বে পশ্চিম দিকে প্রাগ্রসর
ধনতান্ত্রিক দুনিয়ায়। সেটা ঘটল না। রুশ বিপ্লবের পর শতবর্ষ কেটে গেছে।
ধনতান্ত্রিক দুনিয়া নানা ঝড়ঝাপটার ভিতর দিয়ে গেছে। অসাম্য দূর হয়নি, বেকার
সমস্যার সমাধান হয়নি। তবু প্রাগ্রসর ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে কম্যুনিস্ট
দলগুলি আজও দুর্বল। শিল্পোন্নত একটি দেশেও বিপ্লব ঘটেনি। পশ্চিমের যেসব
দেশে কম্যুনিস্ট দল একদিন কিছুটা শক্তিশালী ছিল, যেমন ফ্রান্সে, সেখানেও গত
কয়েক দশকে মার্ক্সবাদী আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়েছে, শ্রমিকশ্রেণীর ভিতরও
কম্যুনিস্ট দল শক্তি হারিয়েছে। শুধু পূর্ব ইউরোপে কম্যুনিস্ট রাজত্বের পতন
নয়, পশ্চিমী ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে মার্কসবাদী আন্দোলনের শক্তিক্ষয় সমকালীন
ইতিহাসের একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
মার্কসবাদী প্রত্যাশার সঙ্গে এই
ঘটনাকে মেলানো কঠিণ। মার্কস শিখিয়েছিলেন যে, ধনতন্ত্রের ভিতর শোষকশ্রেণী ও
শোধিত শ্রেণীর ভিতর যে দ্বন্দ্ব সেটা ক্রমেই তীব্র হতে থাকবে, ধনতান্ত্রিক
ব্যবস্থা যতই পরিণত হয়ে উঠবে ততই এই অর্ন্তদ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পাবে, আর তারই
ফলে বিপ্লব ঘনিয়ে আসবে। রুশদেশের মতো একটা অপেক্ষাকৃত অনুন্নত দেশে বিপ্লব
ঘটল কেন, সেটা প্রধান প্রশ্ন নয়। ভেবে দেখবার মতো প্রশ্ন এটাই যে,
প্রাগ্রসর কোনও ধনতান্ত্রিক দেশেই বৈপ্লবিক অবস্থা পক্ক হয়ে উঠল না কেন,
ওইরকম কোনও দেশেই আর্থিক মন্দার সময়েও অধিকাংশ মানুষের ভোট কম্যুনিস্ট দল
পেল না কেন ? মার্কসীয় তত্ত্বের সঙ্গে বাস্তব অবস্থার এই অসামঞ্জস্য তুচ্ছ
করবার মতো নয়।
অসাম্য, দারিদ্য, বেকারি এইসব প্রাগ্রসর ধনতান্ত্রিক
দেশেও আছে। তবুও স্বীকার করতে হয় যে আর্থিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে প্রচলিত
অর্থে সাধারণ শ্রমিকের জীবনযাত্রার মানের উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটেছে। আজকের
ইংরেজ, জার্মান বা মার্কিন শ্রমিক ষাট বছর আগের শ্রমিকের তুলনায় অনেকটা
উন্নত মানের জীবনযাত্রার অধিকারী। বাইরের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষয়ক্ষতিও
কম হয় না, নানা রকমের অন্যায় ও অনিশ্চয়তার শিকার হয় মানুষ। এইসব একটা সহনীয়
সীমার ভিতর রাখবার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। সামাজিক বীমা বা নিরপত্তা
ব্যবস্থা তারই একটি উদাহরণ। ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে যাঁরা
মধ্যপন্থী, সোশ্যাল ডিমোক্র্যাট অথবা গণতান্ত্রিক সাম্যবাদী নামে যাঁরা
অনেক সময় নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকেন, তাঁদের পথটা এইরকম। ধনতান্ত্রিক
বাজারনির্ভর অর্থনীতি তাঁরা মোটের উপর মেনে নিয়েই তার সংস্কারসাধন করেন
সরকারি, বেসরকারি ও সামবায়িক নানা রকমের কল্যাণমুলক সেবাব্যবস্থার
সাহায্যে। ধনোৎপাদনের জন্য বাজার অর্থনীতির ওপর নির্ভরতা আর উৎপাদিত ধনের
একাংশ সরকারি করের সাহায্যে নানাভাবে কল্যাণমূলক কাজে নিয়োগ, এই হল ইউরোপীয়
সোশ্যাল ডিমোক্র্যাটদের প্রচলিত পথ, যেটা অন্যান্য দলও আজ কমবেশি মেনে
নিয়েছে। আর এই পথে অগ্রসর হতে গিয়ে প্রাগ্রসর ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে শ্রমিক
শ্রেণীর সংগ্রামী আন্দোলন তার বৈপ্লবিক তীব্রতা ক্রমে হারিয়ে ফেলেছে।
মার্কর্সীয়
শোষণের তত্ত্ব বলে, ধন অথবা “মূল্য” সৃষ্টি করে শ্রমিক বা “শ্রমশক্তি”।
মূলধনও শ্রমিকেরই সৃষ্টি। এইসব কথার গভীর আবেদন আছে। কিন্তু এই তত্ত্ব দিয়ে
আর্থিক উন্নয়নের ইতিহাস ব্যাখ্যা করতে গেলে একটা অসুবিধা দেখা দেয়।
উন্নয়নের ভিতরেই কিছু গুরুতর সমস্যা লুকিয়ে আছে, সে কথায় পরে যাওয়া যাবে।
আপতত শোষণের তত্ত্ব আর ইতিহাসের ব্যাখ্যা নিয়ে অসুবিধার কথাটা বলা যাক।
উন্নয়ন বস্তুটিকে শুধু শ্রমের আর মূলধনের পরিমাণগত বৃদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা
করা যায় না।
উৎপাদনপদ্ধতি বা প্রযুক্তির গুণগত পরিবর্তন এবং ক্রমাগত
নবীকরণ ধনবৃদ্ধির একটা মূল কারণ। এমন সমাজ ও আর্থিক ব্যবস্থার কথা সহজেই
ভাবা যায় সেখানে শোষণ আছে, কিন্তু প্রযুক্তির নবীকরণের শক্তি দুর্বল, অতএব
আর্থিক বৃদ্ধির গতিও দুর্বল। সাম্রাজ্যবাদী শোষণের দিক থেকে একদিন স্পেন বা
পর্তুগাল পিছিয়ে ছিল না, তবু উনিশ শতকেই ইংল্যান্ড বা বিশ শতকের জাপানের
উন্নয়নের গতি তারা লাভ করেনি। কেবলমাত্র শোষণের তত্ত্ব দিয়ে আর্থিক
উন্নয়নের এবং প্রযুক্তি তথা উৎপাদন পদ্ধতির নবীকরণের ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ হয়
না।
উৎপাদনপদ্ধতির নবীকরণে যাঁরা অগ্রণী তাঁদেরই সেই যুগের বিচারের
উদ্যোগী ও সার্থক শিল্পানায়ক বলা গেছে। ধনতান্ত্রিক সমাজে উদ্যোগী
শিল্পপতিরা যে-ভূমিকা পালন করেছেন তার ফলে শুধু ধনিকদের ধনবৃদ্ধি হয়েছে এমন
নয়। শ্রমিকদেরও জীবনযাত্রার মান শেষ অবধি উন্নত হয়েছে। এই উন্নতির মূলে
শ্রমিক সংগঠনেরও একটা ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। অর্থাৎ, উন্নতিশীল
ধনতান্ত্রিক সমাজে শ্রমিকনেতা ও শিল্পনায়কদের পারস্পরিক সম্পর্ক একই সঙ্গে
দ্বন্দ্বমূলক ও পরিপূরক, সেখানে বিরোধ ও সহযোগিতার পাশাপাশি উপস্থিত।
শ্রেণীদ্বন্দ্বের একপেশে বিরোধের তত্ত্বের সঙ্গে শিল্পোন্নত দেশের অধিকাংশ
মানুষের অভিজ্ঞতা মেলে না, সেই তত্ত্বে আশ্রিত আন্দোলন জনসাধারণের স্থায়ী
সমর্থন লাভ করে না, গণতন্ত্রের ভিত্তি হিসেবে গ্রাহ্য হয় না। প্রাগ্রসর
ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার সাম্প্রতিক ইতিহাসের সাক্ষ্য এইরকম।
স্তালিনের কাছ
থেকে আমাদের যুগ পেয়েছিল শিল্পোন্নয়নের অন্য এক মডেল। তার প্রভাব সোবিয়েত
দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে রাষ্ট্রশক্তি ও কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা
আর্থিক উন্নয়নের চালক। বাস্তবে এর মনে হচ্ছে, আর্থিক ক্রিয়াকাণ্ডে
ক্ষমতাসীন দল ও আমলাতন্ত্রের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা। এতে করে
কৃষকশ্রমিকের হাত থেকে উদ্বৃত্ত ধনের আহরণ (শোষণ) ও বিনিয়োগ বাধা পায় এমন
বলা যাবে না; উদ্যোগ ও নবীকরণ কিন্তু এটা পর্যায়ে এসে বাধা পায়। আমলার
সঙ্গে উদ্যোগী শিল্পনায়কের একটা বড় পার্থক্য আছে। উদ্যোগী শিল্পনায়ক
উৎপাদনপদ্ধতির নবীকরণের জন্য ঝুঁকি নিতে অভ্যস্ত। এর ভিতর দিয়ে পুরনো
শিল্পপ্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়েছে, নতুন শিল্প গড়ে উঠেছে। উন্নয়ন এগিয়ে যায় এই
নির্দয় পথে। অবাধ প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াও এটা ঘটে। জাপানে অথবা জার্মানিতে
অবাধ প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না, তবু উদ্যোগী শিল্পনায়ক থেমে থাকেননি। আমলার
কাছ থেকে ঠিক এই জিনিস পাওয়া যায় না। একরকমের ‘আদর্শ’ আমলা আছেন যাঁরা
যথাসাধ্য নিয়ম মেনে চলেন, ন্যায়রক্ষা করেন।
নিয়মরক্ষা আর নবীকরনের মধ্যে
একটা গোপন দ্বন্দ আছে। আরেক রকমের আমলা দুর্নীতিগ্রস্ত, যারা বার বার কাজ
আটকে দেন। তারপর কোন অসাধু প্রতিদানের মূল্য পথ ছেড়ে দেন । এইসবের ভিতর
দিয়ে উন্নয়নের কাজটা পিছিয়ে যায়। কোন কোন শিল্পে, যেমন যুদ্ধাস্ত্র
উৎপাদনের ক্ষেত্রে, আর পিছিয়ে পড়া দেশের উন্নয়নের পরিকাঠামো গঠনের কাজে,
রাষ্ট্রের একটা বিশেষ ভূমিকা থাকে। সেটা স্বীকার্য। কিন্তু একটা সীমার
বাইরে আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রন এবং শাসকদলের স্বার্থাণ্বেষী হস্তক্ষেপ
আর্থিক উন্নতির পথে গুরুতর বিঘ্ন হয়ে দাঁড়ায়।
সাম্যবাদীরা অবশ্য বলেন,
আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রন তারা কখনো চান না। শ্রমিক শ্রেনীর কর্তৃত্ব তাদের
অভীষ্ট। কিন্তু মূল প্রশ্নটা হলো উপায় নিয়ে। অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছবার উপায়
নিয়ে আরও সাবধানে চিন্তার প্রয়োজন আছে। বিশেষভাবে প্রয়োজন নীতি ও রাজনীতি
নিয়ে নতুন চিন্তার। লেনিনী তত্ত্ব অনুসারে শ্রমিক শ্রেনী সংগঠিত হয় বিপ্লবী
দলের ভিতর দিয়ে। ক্ষমতা দখল করাই তারপরম লক্ষ। কৃষক মজুরের কর্তৃত্বের
নামে অনায়াসে প্রতিষ্ঠিত হয় দলের কর্তৃত্ব। এক দলীয় শাষন পরিনতি লাভ করে
দুর্নীতিগ্রস্ত উৎপীড়নে। এই পরিনতি আশ্চর্য নয়। ক্ষমতা দখল করাই যখন পরম
ধর্ম, তখন ক্ষমতা লাভের জন্য কোনও উপায়কেই আর অসাধু মনে হয়না। ক্ষমতার
লড়াইতে একটা মাদকতা আছে, যাতে সদসৎ বিবেক নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তা ছাড়া
শ্রেণীতত্ত্বের মধ্যেই একটা অসহিষ্ণুতার ঝোঁক আছে যা থেকে মার্ক্রবাদ
লেনিনবাদকে মুক্ত করা কঠিন। শ্রেনী বলতেই এমন একটা সংহত যৌথ অস্তিতের
কল্পনা প্রাধান্য পেয়ে যায় যে, ব্যক্তিস্বাধীনতার সঙ্গে তাকে মেলানো কঠিন
হয়। অসহিষ্ণু জাতীয়তাবাদ যেমন গনতান্ত্রিক স্বাধীনতার পক্ষে অনিষ্টদায়ক ,
অসহিষ্ণু শ্রেনীতত্ত্বও তেমনি। যুদ্ধের উত্তেজনায় অথবা তাত্ত্বিক উন্মাদনায়
দলীয় স্বৈরাচারকেও গৌরবময় বলে ভ্রম হয়। উন্মাদনার মতই অস্থির ও অস্থায়ী
সেই গৌরব।
আমরা এসে যাচ্ছি এরপর উন্নয়ন বা আধুনিক শিল্পায়নের
অন্তর্নিহিত কিছু জটিলতায়। এ-যুগের যেটা প্রধান সংকট তা থেকে ধনতান্ত্রিক
বা সমাজতান্ত্রিক কোন ব্যাবস্থাই মুক্ত নয়। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য,
একদিকে মিলিটারিজম বা সামরিকবাদ অন্যদিকে কনজ্যুমারিজম বা ভোগবাদ, আর
এ-দুয়ের যোগাযোগ। ধনীদরিদ্র সব দেশেই এক সংকট ছড়িয়ে পড়েছে। আমেরিকার মতো
ধনীদেশে যে এটা আছে আমরা তা সহজেই দেখতে পাই এবং তার সমালোচনা করি। ভারত বা
বাংলাদেশের মতো গরিবদেশও যে একই ব্যাধি থেকে মুক্ত নয়, একথা কিন্তু
অস্বীকার করা যায়না। বর্ধিষ্ণু উচ্চমধ্যবিত্তের ভোগবাদ সাধারন মানুষের ভিতর
দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। সামরিকখাতে ব্যায়ের বোঝার সংঙ্গে যোগ হয়ে এরপর
মুদ্রাস্ফীতি ও আর্থিক বিপর্যয় কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছেনা। আমেরিকার মতো
ধনীদেশের পক্ষেও যদি সামরিকতা ও ভোগবাদের এই অশুভ যোগাগের ধাক্কা সামলানো
কঠিন হয় তবে দরিদ্রতর দেশেরত কথাই নেই।
গরবাচভের আমল থেকে কম্যুনিষ্ট
দুনিয়ায় যে বিপর্যয় ঘনিয়ে এসেছে তার মূলেও আছে এই ব্যাপারটা। আমেরিকার
সংঙ্গে টেক্কা দিয়ে সোবিয়েত রাষ্ট্র সামরিক খাতে ব্যায়ের পরিমান বাড়িয়ে
যাচ্ছিল। অন্যদিকে সে দেশের নতুন মধ্যবিত্তের মধ্যে ভোগবাদী তৃষ্ণা বেড়ে
উঠছিল। তা ছাড়া ছিল কম্যুনিষ্ট সৈরতন্ত্রের নিজস্ব কিছু সমস্যা। নতুন
প্রজন্ম একটা পুরনো তত্ত্বের শিকল ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসতে চাইছিল। এসবের ভিতর
কিছুতেই সামঞ্জস্য করা যাচ্ছিলনা। গরবাচভ চাইছিলেন পশ্চিমী শক্তির সংঙ্গে
একটা নিস্ফল সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাধ্যবাধকতা থেকে বেরিয়ে এসে সোবিয়েত
অর্থনীতিকে অন্যভাবে সাজিয়ে নিতে। এইরকম একটা পুনর্গঠন যে কঠিন একথা তাঁর
একেবারে অজানা ছিলনা। কিন্তু তিনি বুঝেছিলেন, অন্য পথ নেই। আসলে সারা
পৃথিবীর পক্ষেই অন্য পথ নেই।
এটা কঠিন পথ কারন এ যুগের একটা প্রবল
ঝোঁকের বিরুদ্ধে এর অবস্থান। এ যুগে রাষ্ট্রশক্তির প্রাধান্য। রাষ্ট্রের
সংঙ্গে রাষ্ট্রের যুদ্ধ। দেশের ভিতর রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর কর্তৃত্ব নিয়ে
লড়াই, সে লড়াই মাঝে মাঝে গৃহযুদ্ধের আকার ধারন করছে। সংগঠিত রাষ্ট্রশক্তির
পাশাপাশি বিস্তার লাভ করেছে বিচ্ছিন্ন হিংসায় বিশ্বাসী সন্ত্রাসবাদীদের
সংগঠন। আধুনিক প্রযুক্তি মানুষের হাতে এনে দিয়েছে ধবংস করবার অতুলনীয়
অস্ত্র। সেই অস্ত্র আজ আর একটি -দুটি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রনের ভিতর নেই।
ক্রমে ভয়ংকর বিস্ফোরক বোমা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে, সন্ত্রাসবাদীদের হাত থেকেও
এই ধবংসের শক্তি সরিয়ে রাখা যাবেনা। এর মধ্যে দাঁড়িয়ে শান্তির কথা বলা
সহজ নয় অথচ অন্য পথ নেই।
ভোগবাদের যোগ আধুনিক প্রযুক্তি ও শিল্পবাদের
সঙ্গে । আধুনিক শিল্প ও প্রযুক্তি মানুষের হাতে এনে দিয়েছে প্রকৃতির ওপর
উন্মাদক প্রভুত্বের স্বাদ। এর ভিতর দিয়ে প্রকৃতি বিস্তার করেছে মানুষের মনে
অন্য এক ছলনা। নবপ্রযুক্তি মানুষের হাতে পৌঁছে দেয় নতুন নতুন ভোগের উপকরণ।
মানুষ ভাবছে, এই ভোগের পথেই আসল সুখ। এটাই এযুগের বস্তুবাদ। ভিন্ন চিন্তা
অবাস্তব, “অবৈজ্ঞানিক”। ভোগবাদের এই আকর্ষণ ঠেকানো কঠিন। ভোগের উপকরণ নিয়ে
প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ছে, ঈর্ষা ও অশান্তি বাড়ছে। সাম্যবাদী দেশগুলিও এই
ঝোঁক থেকে আজ আর মুক্ত নেই। অথচ ভোগবাদ শেষ অবধি মানুষকে মানুষ থেকে
বিচ্ছিন্নই করে। সেই বিচ্ছিন্নতা থেকে ভোগের কোনও উপকরণই মানুষকে উদ্ধার
করতে পারে না। উদ্ধারের জন্য কখনও প্রয়োজন হয় নতুন কোনও উত্তেজনা। সেটাও
মুক্তির ছলনামাত্র।
উনিশ শতকের দুনিয়ায় এইসব সমস্যা প্রাধান্য পায়নি।
হিংসার শক্তি তখনও এতটা বিধ্বংসী হয়ে ওঠেনি। রাষ্ট্রশক্তি তখনও এমন প্রবল ও
সর্বগ্রাসী হয়নি। ভোগবাদ সীমাবদ্ধ ছিল ছোট একটি অভিজাতশ্রেণীর মধ্যে।
মনুষ্যজাতির ভবিষ্যৎ এমন সাগমগ্রিক বিনাশের সম্ভাবনার সম্মুখীন হয়নি সেদিন।
এই নতুন সম্ভাবনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আগামী দিনের জন্য চিন্তা করতে হবে।
শান্তির
প্রশ্নটা এই প্রেক্ষাপটেই নতুন করে ফিরে আসে। এটা অনেকে খেয়াল করেন না।
এইরকম একটা ধ্বনি শোনা যায়, অসাম্য দূর না হওয়া পর্যন্ত শান্তির কথা বলা
অবাস্তব। এতে কিন্তু মূল প্রশ্নটাকেই অস্বীকার করা হয়। অন্যায় ও অসাম্য
হঠাৎ এই পৃথিবী থেকে অন্তর্হিত হবে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ও সাম্যের সপক্ষে
কাজ করে যেতেই হবে। কিন্তু ন্যায়ের সপক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে এমন উপায়
অবলম্বন করা সমর্থনযোগ্য নয় যাতে অন্যায় নতুন করে জন্মলাভ করে অথবা মানুষের
সমাজ সার্বিক ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়। সংগ্রামের অহিংস পদ্ধতি নিয়ে তাই
পরীক্ষানিরীক্ষা আবশ্যক। উনিশ শতকের তুলনায় এটা আজ আরও বেশি আবশ্যক। একথা
যাঁরা মানেন তাঁরাও জানেন, হিংসা থেকে সংগ্রামকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখা বড়
কঠিন। তবু বিশ শতকের অভিজ্ঞতাই এটা সাবধানবাণী উচ্চারণ করে চলেছে। সেই
সাবধানবাণী হিংসার বিরুদ্ধে, শান্তির সপক্ষে।
রুশদেশে নভেম্বর বিপ্লব
দিয়ে ইতিহাসের যে-পর্বটি শুরু হয়েছিল সেটি ইতিমধ্যে অবসিত হয়েছে বিয়োগান্ত
নাটকে। তার পুনরাবৃত্তি হবে প্রহসন। অধুনালুপ্ত সোবিয়েত রাষ্ট্র আজ বহু
খণ্ডে বিখণ্ডিত। তাকে পুনরায় অখণ্ড করবার চেষ্টা চলছে। কম্যুনিস্টদের সঙ্গে
তাহ মিলিয়েছেন কিছু রুশ জাতীয়বাদী সেই প্রচেষ্টায়। কিছু চাঞ্চল্যকর ঘটনা
সহসা ঘটতে পারে, এ সবই অনুমানসাপেক্ষে। ইতিহাসের নতুন পর্বটি কোন স্থায়ী
পরিণামের দিকে চলেছে সেটা এখনও অজ্ঞাত, উদঘাটিত হবে ধীরে ধীরে। পুরনো
সাম্রাজ্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল কেন্দ্রীয় শক্তির দাপটে। ভাঙনের পথে
সেটাই প্রমাণিত হল। আশা করা যাক, আবারও একদিন যুক্তরাজ্য গঠিত হবে, স্বাধীন
অঙ্গরাজ্যগুলি সম্মিলিত হবে যথাসাধ্য, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্মতির
ভিত্তিতে। যদি তাই হয়, তবে ইতিহাসের এই পর্বে একটি উদাহরণ স্থাপিত হবে,
সারা বিশ্বের পক্ষে যেটি অনুকরণীয়।
খোলা বাজারের অর্থনীতি প্রসারিত
হচ্ছে। আমলাতান্ত্রিক অতিকেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে এটা প্রতিক্রিয়া। খোলা
বাজার আর কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের যোগাযোগের একটা সহনীয় অবস্থায় পৌঁছনো যাবে,
এইরকম অনেকে আশা করছেন। কথাটা বোধগাম্য, তবু শেষ বিচারে নির্ভরযোগ্য নয়।
কল্যাণমূলক রাষ্ট্রও কত সহজে সামরিকতার দিকে ঝুঁকে পড়ে তার প্রমাণ পাওয়া
গেছে বারে বারে। আধুনিক ইতিহাসের সাক্ষ্য আরেকবার স্মরণ করা যাক।
কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রের উত্থানের ফলে ভীতত্রস্ত ধনতান্ত্রিক দেশে
সমাজকল্যাণের নীতি প্রবর্তিত হল, এই গল্প অনেকটাই অসার। স্তালিনের কয়েক দশক
আগেই জার্মানিতে শিক্ষা ও বিজ্ঞানচর্চার বিস্তার ঘটেছে, সামাজিক নিরাপত্থা
ব্যবস্থা প্রচলিত হয়ে গেছে। কিন্তু জঙ্গি জাতীয়তাবাদকে ঠেকানো যায়নি।
কম্যুনিস্ট দুনিয়াতেও একই ঝোঁক দেখা গেছে।
বিভক্ত জার্মানি পুনর্মিলনের
পর আরও এক শক্তিশালী সামরিক রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে, এই রকম আশঙ্কা নতুন
করে দেখা দিচ্ছে। প্রতিস্পর্ধী শক্তি হিসাবে রুশ দেশের পুনরভ্যুত্থানকে
স্বাগত জানাবার মতো লোকের অভাব হবে না। আমেরিকার একচ্ছত্র ক্ষমতার প্রতিকার
হিসেবেও এই পরিণতি আকর্ষণীয় মনে হতে পারে। কিন্তু এ শুধু পুরনো সংকটের
দিকে পুনরাবর্তনের পথ। আজকের সদর্থক সংগ্রাম বিশ্বজোড়া সামরিকবাদের
বিরুদ্ধে। শান্তির চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে ইউরোপই পারে নতুন সংকল্প নিয়ে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি দাঁড়াতে। আমেরিকার শান্তিকামী মানুষ
সহযোগিতার হাত বাড়াবে। মনে রাখা ভাল, এ সমস্যঅ শুধু পশ্চিমী দেশগুলিরই নয়।
ঐসলামিক এশিয়া সহ তৃতীয় বিশ্বের নানা অঞ্চলেই সামরিক গোষ্ঠীর প্রভাব প্রবল।
শান্তি আন্দোলনের প্রয়োজন সর্বত্র। গড়ে তুলতে হবে সহযোগিতার বৃহত্তর বৃত্ত
পশ্চিমে এশিয়ায়, ভারতীয় উপমহাদেশে এবং অন্যত্র। সেই সঙ্গে আরও প্রয়োজন,
মানুষকে যে-সংস্কৃতি “খণ্ডক্ষুদ্র” করে রাখে তারও রূপান্তর।
অতীতের
কোনও বিপ্লবকে কাব্যে কীর্তিত করে ভবিষ্যতের মানুষকে নিরাপদ অবস্থানে পৌঁছে
দেওয়া যাবে না। মানুষ ও সমাজের বিবর্তনে আজ পরবর্তী স্তরের লক্ষ্যগুলিই
এমন যে, কোনও বৈপ্লবিক উল্লম্ফনে সেখানে পৌঁছবার কল্পনা অবাস্তব। বিপ্লব
দীর্গজীবী হোক, এই উন্মাদক ধ্বনি নতুন ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে কতটা
প্রাসঙ্গিক সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা অযৌক্তিক নয়। মানুষ দীর্ঘজীবী হোক,
শান্তি দীর্ঘজীবী হোক, এই ধ্বনিই আজ প্রাসঙ্গিক।
শান্তি ও সংগ্রামের
ভিতর কোনও বৈপরীত্য নেই। শান্তির জন্য সংগ্রাম চাই। শান্তির জন্য এই
সংগ্রাম যতটা দৃঢ়সংকল্প নিয়ে তবু শান্তিপূর্ণ অহিংস উপায়ে গড়ে তোলা যায় ততই
মঙ্গল। আমাদের যার যেখানে অবস্থান সেইখানে দাঁড়িয়েই এ বিষয়ে নতুন ভাবে
চিন্তা করতে হবে।
