আজ
মঙ্গলবার ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট তথা বাংলাদেশ পদাতিক বাহিনীরপ্রতিষ্ঠাতা
মেজর এম এ গণির ৬৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি একজন কিংবদন্তি জন নেতা ছিলেন
যার কীর্তি এখনও নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে
বাঙালি মুসলমানদের জন্য আলাদা নিয়মিত বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা মেজর এম এ গনি ১
ডিসেম্বর ১৯১৯ সালে কুমিল্লায় ব্রাহ্মণপাড়ার নাগাইশ গ্রামে জন্মগ্রহণ
করেন। তিনি খুলনা থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন এবং তারপর উচ্চ শিক্ষার
জন্য কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে যোগ দেন। কিন্তু তার চাচা ডাঃ এম এ সোবহান
মারা যাওয়ায় তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে পড়াশোনা
ছেড়ে কলকাতায় বেঙল ফায়ার সা্র্িভসে যোগ দেন। ২য় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে ৮
জানুয়ারী ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কমিশন সার্ভিসে যোগ দেন। ৮
আগস্ট ১৯৪২ সালে পদাতিক বাহিনীতে কমিশন লাভ করেন এবং ইন্ডিয়ান পাইওনিয়ার
কোরে নিয়োজিত হন। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি ব্রহ্মপুত্র নদীর পুর্ব পার্শের
এলাকা থেকে বার্মার দক্ষিণে আকিয়াব পর্যন্ত পাইওনিয়ার কোরের সেনাদের নিয়ে
শত্রুদের সাথে লড়াই করে আগ্রাসন প্রতিহত করেছিলেন।
বার্মা অভিযানের
সময়ই তৎকালীন ব্রিটিশ সেনা কতৃর্পক্ষ তাঁর অধীনে যুদ্ধ করা বাঙালি মুসলিম
সৈন্যদের বীরত্ব, সাহসিকতা এবং যুদ্ধের ক্ষমতা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তাদের
দক্ষতা ও সাহসিকতা উপরের ব্রিটিশ সেনা অধিনায়কদেরও নজর কাড়ে।
যুদ্ধের
ভয়াবহতার সাথে অভিজ্ঞ পাইওনিয়ার কোরের সৈন্যদের নিয়ে নিয়মিত সেনাবাহিনী
গঠনের জন্য উর্ধ্বতন কমান্ডারদের সমীপে ক্যাপ্টেন এ গনির প্রস্তাব পুর্ব
বাংলার সৈনিকদের নতুন আশার জন্ম দেয়। যুদ্ধ শেষে ভারত বিভক্তির পুর্বেই
পাইওনিয়ার কোরের সৈন্যদের যাদের রাখা হবে তাদের ২ টি কোম্পানি নিয়ে ভারতের
যালনা শহর থেকে রওয়ানা দিয়ে ১৭ সেপ্টম্বর ১৯৪৭ সালে ট্রেন যোগে ঢাকার
ফুলবাড়িয়া এসে পৌছায়। পরবর্তীতে কুর্মিটোলায় সেনাছাউনি গড়ে তোলার আদেশ
আসে।
১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কুর্মিটোলায় আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
সময়ের
পরীক্ষায় উত্তীর্ণ অপরাজেয় এই রেজিমেন্ট প্রথম সক্রিয় যুদ্ধ দেখেছিল ১৯৬৫
সালে পাক ভারত যুদ্ধে। এতে ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের অফিসার ও সৈন্যরা
সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের আগে ৮টি ইস্ট বেঙ্গল
রেজিমেন্ট ইউনিট গড়ে উঠেছিল যার মধ্যে ৫টি ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে।
১৯৭১ সালে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তার বীরত্ব গৌরব দেখায় কারণ এটি ছিল
ঐতিহাসিক রেজিমেন্ট, যেটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সমরংগনে
নেতৃত্ব দিয়ে ছিল ও মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক এবং পথপ্রদর্শক ছিল।
নিজের
স্বকীয়তা বজায় রাখতে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে উর্ধ্বতন কমাণ্ডারদের আদেশের
প্রতিবাদে বেঙল রেজিমেন্টের অফিসাররা বজ্রকণ্ঠে বললেন, “বংগালী সেনারা শুধু
তাদের মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলবে না।” ‘ভাষা আন্দোলনের প্রথম
প্রতিবাদ সেটাই। প্রদেশের সকল পারিষদের সামনে এই বিদ্রোহী প্রতিবাদ কি
ব্রিগেডিয়ার আইউব খান সহজে হজম করার মানুষ? তাৎক্ষনিকভাবে তেমন কোন
প্রতিক্রিয়া না দেখালেও পরে বৈষম্যের আসল রূপ প্রকাশ পায়। তিন মাসের মধ্যে
দুবার পদোন্নতি দিয়ে তা বাতিল করে প্র্বু পদে বহাল করে মেজর গণিকে বদলি করে
দেয়। তবুও তাকে রেজিমেন্টের পরিধিতে কাজ করতে হয়েছিল। রিক্রুটিং অফিসার
হিসাবে সারা দেশ সফর করে রেজিমেন্টের জন্য সেরা যুবকদের বাছাই করে ১ম ও ২য়
রেজিমেন্ট সম্পন্ন করেছিলেন। এটি ওনি এক চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়ে ছিলেন।
কিন্তুঘাম ও রক্ত দিয়ে যে প্রতিষ্ঠান গড়ে শক্ত ভিত্তিতে তৈরি করেছিলেন তাতে
কাজ করার সুযোগ পেলেন না।
বৈষম্য ও নীতিগত কারণে কতৃর্পক্ষের সাথে
বনিবনা হচ্ছিল না। পাকিস্তানি সামরিক কমান্ডারদের বৈরি মনোভাবের কারণে তিনি
শারিরীক কারণে সেনাবাহিনী থেকে ০৬ নভেম্বর ১৯৫৩ অব্যাহতি লাভ করেন।
চাকুরী
থেকে অব্যহতি পাবার পরের মাস জানুয়ারি ১৯৫৪ সালে তার নির্বাচনী এলাকার
প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা
করেন এবং যুক্তফ্রন্ট মনোনীত প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে এক ঐতিহাসিক বিজয় লাভ
করেন। তিনি রাজনৈতিক কার্যধারার একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিলেন এবং
কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের
প্রতিবাদ দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার জন্য অনেক
প্রস্তাব রেখেছিলেন।
এখানে বলা বাহুল্য যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট
অনুরূপ আরেকটি বাহিনীর অগ্রদূত — তা হল বাংলাদেশ ইনফ্নেট্রি রেজিমেন্ট।
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু ইউনিট দিয়ে ২০২০ যাত্রা শুরু করানো হল একটি
পদাতিক রেজিমেন্ট হিসাবে বাংলাদেশ ইনফ্নেট্রি রেজিমেন্টের। সুতরাং
নিরপেক্ষভাবে বললে সমগ্র পদাতিক বাহিনী ষা সেনাবাহিনীর মুল ফাউন্ডেশন এক
দেশপ্রেমিক সন্তান মেজর এ গনির কর্মের ফসল যা অনেকে ভাবতে ও স্বীকার করে
মুল্যাায়ন করতে চান না।
তিনি ২৮ শে অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর ১৯৫৭ পর্যন্ত বার্লিনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ভেটেরান্স কনফারেন্সে অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচিত হন।
তিনি ১১ নভেম্বর ১৯৫৭ মধ্য রাতে বার্লিনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাকে কুমিল্লা সেনানিবাসে দাফন করা হয়।
আগামীকাল
বুধবার ১২ নভেম্বর অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের সংগঠন রাওয়া ক্লাবে মেজর
গনির স্মরণে এক আলোচনা সভা আয়োজন করা হয়েছে। সকালে কুমিল্লা সেনানিবাসে
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তাঁর সমাধিতে আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধা
জানানো হবে।
