
বাংলাদেশের
রাজনীতি আবার এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচন সামনে। কিন্তু
সেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখনো স্পষ্টতা নেই। একদিকে সরকার পক্ষ বলছে,
নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করবে, অন্যদিকে অনেকের অভিযোগ, পরিবেশ এখনো
প্রতিযোগিতার উপযোগী নয়। দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে এখন তিনটি প্রবণতা পাশাপাশি
চলছে। একদিকে নির্বাচন কমিশন ও অন্তর্বর্তী সরকারের সক্রিয় অবস্থান।
অন্যদিকে রাজনীতির পুনর্গঠন প্রচেষ্টা এবং জনগণের মনে অনাস্থা এবং
অবিশ্বাস। জুলাই জাতীয় সনদ ও তা বাস্তবায়নের আদেশ এবং গণভোট এখন আলোচনার
তুঙ্গে। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এখন স্পষ্টতই দ্বিধাবিভক্ত। শুধু বিভক্ত নয়,
পরস্পরকে আক্রমণ করে চলছে নানা ধরনের বক্তৃতা-বিবৃতি। এসব কারণে আসন্ন
জাতীয় সংসদ নির্বাচন সঠিক সময়ে হবে কি না, তা নিয়েও অনেকে সন্দেহ-সংশয়
প্রকাশ করছেন।
অন্তর্র্বতী সরকারের সাম্প্রতিক বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে,
তারা সরাসরি কোনো দলীয় সমঝোতা তৈরি করতে চাইছে না। বরং রাজনৈতিক দলগুলোকে
আলোচনার মাধ্যমে নিজেরাই ঐকমত্যে পৌঁছানোর আহ্বান জানিয়েছে। এ বক্তব্যে
একদিকে দায়িত্ববোধের ইঙ্গিত থাকলেও অন্যদিকে তা নতুন প্রশ্নও উত্থাপন করছে।
বাংলাদেশে রাজনীতির ইতিহাস বলে, দলগুলো নিজেরাই খুব কমই আলোচনার মাধ্যমে
সমঝোতায় পৌঁছায়। প্রায়ই দেখা গেছে, বহিরাগত মধ্যস্থতা বা রাষ্ট্রীয়
হস্তক্ষেপ ছাড়া বিরোধ নিরসন হয়নি। সে ক্ষেত্রে, বর্তমান আহ্বান কি
বাস্তবসম্মত? নাকি এটি দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার এক সূক্ষ্ম রাজনৈতিক কৌশল? এ
প্রশ্ন এখন দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
একই সঙ্গে বিএনপি ও
জামায়াতের মধ্যকার সম্পর্কও নতুন করে আলোচনায় এসেছে। আরপিওর ২১ ধারার
সংশোধন নিয়ে উভয় দলের অবস্থান ভিন্নমুখী। এই মতপার্থক্যই এখন জোট রাজনীতির
সবচেয়ে বড় পরীক্ষার জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত
সংস্কার ও নির্বাচনি কাঠামো নিয়ে মতপার্থক্য যত বাড়ছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে
যে, রাজনীতির মাঠে আস্থার সংকট এখনো গভীর।
নির্বাচন কমিশনের সাম্প্রতিক
মন্তব্য হলো- ‘নির্বাচনের ওপর গণতন্ত্রের গতিপথ নির্ভর করছে’। এ মুহূর্তে
রাজনৈতিক বাস্তবতার কেন্দ্রবিন্দুতে জায়গা করে নিয়েছে। কারণ এ কথাটি কেবল
আনুষ্ঠানিক বক্তব্য নয়, এটি বাস্তব এক সতর্কবার্তা। বাংলাদেশের গণতন্ত্র
এখন নির্বাচনের মান ও গ্রহণযোগ্যতার ওপরই নির্ভর করছে। নির্বাচন যদি
বিশ্বাসযোগ্য হয়, তাহলে রাজনৈতিক স্থিতি ফের আসতে পারে; কিন্তু যদি আগের
মতো বিতর্কে জর্জরিত হয়, তবে গণতন্ত্রের ভিত্তি আরও নড়বড়ে হয়ে পড়বে। ২০১৪
এবং ২০১৮ সালের অভিজ্ঞতা এখনো মানুষ ভুলে যায়নি। তাই ২০২৫ সালের নির্বাচনে
দেশবাসী প্রত্যাশা করছে- এবার অন্তত নির্বাচনি প্রক্রিয়া এমন হবে, যেখানে
প্রতিটি নাগরিক নিজের ভোটের মূল্য বুঝতে পারবে।
এ ক্ষেত্রে আবার ‘ঐকমত্য
কমিশন’-এর প্রশ্ন সামনে আসে। এ কমিশনকে নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো উভয়
শিবিরের বক্তব্যে আশাবাদ ও সংশয় মিশে আছে। কমিশন যদি সত্যিকার অর্থে
নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার, দলীয় নিবন্ধন, প্রতীক বরাদ্দ, প্রচারব্যবস্থা ও
ভোট গ্রহণ পদ্ধতিতে ভারসাম্য আনতে পারে, তাহলে এটি দীর্ঘমেয়াদি গণতন্ত্রের
ভিত শক্ত করবে। কিন্তু যদি এটি কেবল আনুষ্ঠানিক আলোচনার একটি ফাইল হয়ে
থাকে, তাহলে ফলাফল আগের মতোই ‘কমিশনভিত্তিক রাজনীতি’র পুরোনো চিত্রে ফিরে
যাবে। বাস্তবতা হলো- রাজনৈতিক ঐকমত্য কখনো কাগজে তৈরি হয় না; তা তৈরি হয়
আস্থার মঞ্চে। আর আস্থা গড়ে ওঠে স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্য আচরণের মাধ্যমে।
যা বর্তমানে রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্রমেই দুর্লভ হয়ে পড়ছে।
বিভিন্ন কারণেই
বাংলাদেশের জনগণ এখন রাজনীতিতে এক ধরনের দ্বৈত অভিজ্ঞতার মধ্যে আছে। একদিকে
তারা চায় নির্বাচন হোক, যাতে দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে;
অন্যদিকে তারা চায় একটি সত্যিকারের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ, যেখানে ভোট
মানে হবে অংশগ্রহণ। ভোটারদের এ মানসিক অবস্থাকেই রাজনৈতিক দলগুলো এখনো
যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে পারেনি। রাজনীতিবিদরা যেখানে ক্ষমতার সমীকরণে
ব্যস্ত, সেখানে সাধারণ মানুষ চায় স্থিতিশীলতা ও নিশ্চয়তা, যে নির্বাচন শেষে
দেশ নতুন করে রাজনৈতিক সংঘাতে নিমজ্জিত হবে না।
সম্প্রতি বিএনপির
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন মন্তব্য করেছেন, জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে জনমনে
সৃষ্ট সংশয়, সন্দেহ গণতন্ত্রে উত্তরণের পথকে সংকটপূর্ণ করে তুলতে পারে।
শেষ পর্যন্ত কোনো অগণতান্ত্রিক কিংবা অপশক্তির কাছে বিনা শর্তে
আত্মসমর্পণের পথে হাঁটতে হয় কি না, এমন শঙ্কাও তারেক রহমান জানিয়েছেন। একটি
বড় দলের প্রধান নেতার শঙ্কা যদি এমন হয় তাহলে সাধারণ জনগণ শঙ্কা প্রকাশ
করবে সেটি স্বাভাবিক। মাঠের রাজনীতি এ মুহূর্তে তুলনামূলক শান্ত হলেও
অস্থিরতা কাটছে না। আওয়ামী লীগ মাঠে ফিরতে চায়। কিন্তু প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ
ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অজুহাতে তাদের কর্মসূচি সীমিত রাখা হয়েছে। সরকারও
বুঝছে, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে
পারে। এ টানাপোড়েনের মাঝেই নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষতার প্রতীক হিসেবে
টিকে থাকতে হবে। নির্বাচন কমিশনের কাজ এখন কেবল নির্বাচনের আয়োজন নয়, বরং
একটি রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতার অবকাঠামো তৈরি করা- যেখানে দলগুলো স্বস্তি
বোধ করবে, আর নাগরিক সমাজ দেখবে গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি বাস্তব হচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুই মেরুর দ্বন্দ্ব ছাড়া কোনো বিষয়েই ঐক্য সম্ভব নয়।
কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি বলছে, যদি রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সীমাবদ্ধতা
বুঝে সংলাপে আসে, তাহলে অন্তত নির্বাচনি সংস্কার, ভোটের পরিবেশ, আর
প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা বিষয়ে একমত হওয়া অসম্ভব নয়। অথচ অর্থনীতিবিদ,
ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশের অর্থনীতি যেভাবে বিপর্যয়ের দিকে
যাচ্ছে, তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দ্রুত নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা
হস্তান্তরের কোনো বিকল্প নেই।
জুলাই জাতীয় সনদ ও এর বাস্তবায়ন নিয়ে
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের দলগুলোর মধ্যে সৃষ্ট এমন বিভাজন নিয়ে
উৎকণ্ঠা সর্বমহলে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্ভাব্য গণভোটের পক্ষে-বিপক্ষে
যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পাশাপাশি উঠেছে নানা প্রশ্ন। সংবিধান
সংস্কার-সংক্রান্ত ৪৮টি বিষয়ে সমর্থন করেন কি করেন না- এই একটি প্রশ্নে
কীভাবে ‘হ্যাঁ-না’ ভোট হবে? কিছু প্রস্তাবে কারও মতামত ইতিবাচক হতে পারে
আবার কিছু প্রশ্নে নেতিবাচক হতে পারে। সেটি কীভাবে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ দিয়ে
স্পষ্ট করা যাবে? ঐকমত্য কমিশনের আলোচনাগুলো, আরপিও সংশোধনের বিতর্ক,
নির্বাচন কমিশনের আহ্বান- সবই একই বাস্তবতার ভিন্ন প্রকাশ। এ বাস্তবতার নাম
গণতন্ত্রের টিকে থাকা। যদি রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে না গিয়ে
দেশের ভবিষ্যতের পক্ষে চিন্তা করতে পারে, তাহলে হয়তো এবারকার নির্বাচনই হবে
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পুনর্জন্মের সূচনা। অন্যথায়, আমরা আরেকটি
নির্বাচনের পরও সেই পুরোনো প্রশ্নটাই শুনব- ‘নির্বাচন হলো, কিন্তু গণতন্ত্র
কোথায়?’
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
