একদিকে
গাজার বিপন্ন ও বুভুক্ষু মানুষের পক্ষে ফরাসি নাগরিকদের অভূতপূর্ব সমর্থন;
অন্যদিকে ইহুদিবাদীদের ক্রমাগত গণহত্যা সত্ত্বেও পশ্চিমাদের অবহেলার
প্রেক্ষাপটে শেষ পর্যন্ত গর্জে উঠেছেন প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ। তিনি
গাজাসহ ফিলিস্তিনবাসীর পক্ষে তাঁর পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করে বলেছেন, ‘আমরা
গাজাবাসীকে বাঁচাতে সর্বতোভাবে এগিয়ে যাচ্ছি।’ তিনি অবিলম্বে গাজায়
যুদ্ধবিরতি দাবি করে বলেছেন, তাঁরা ত্রাণকাজে সাহায্য করার জন্য সেখানে
তাঁদের সেনা সদস্য পাঠাতে প্রস্তুত। এরই মধ্যে আরো বলিষ্ঠ কণ্ঠে হুংকার
দিয়েছে পশ্চিমা শক্তিধর দেশ যুক্তরাজ্য ও কানাডা।
এই তিন শক্তি অর্থাৎ ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও কানাডা সম্মিলিতভাবে ইহুদিবাদী ইসরায়েলের নিষ্ঠুরতার নিন্দা জানিয়েছে।
এরই
মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে কর্মরত ইসরায়েল দূতাবাসের দুই
কর্মচারীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। লন্ডন, প্যারিস ও কানাডার টরন্টোসহ
বিভিন্ন নগরীতে ইহুদি ধর্মাবলম্বী মানুষের ওপর এক ধরনের ঘৃণা ও জাতিগত
বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। অথচ এর পরও ইহুদিবাদী নেতানিয়াহু সরকার ও
তার চরম দক্ষিণপন্থী উগ্রবাদী প্রশাসন গাজায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণা কিংবা
গাজাবাসীকে নির্বিচারে হত্যা বন্ধ করছে না।
তারা সমগ্র গাজা দখল এবং
হামাস যোদ্ধাদের সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করার আগে তাদের বর্তমান কর্মসূচি
থামাবে না বলে জানিয়েছে। ইহুদিবাদী ইসরায়েলের উগ্রপন্থী নেতৃত্ব গাজায়
যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা কিংবা ত্রাণকার্য চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তাদের
বন্ধু বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরামর্শকেও অগ্রাহ্য
করা শুরু করেছে। তবে এ কথা সত্য যে ইসরায়েলের ওপর গাজাসহ ফিলিস্তিনে শান্তি
প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় চাপ অনেক বেড়ে গেছে। কারণ
যুক্তরাষ্ট্র এখন আর আগের মতো তাদের কথায় উঠবস করছে না।
ইসরায়েলের
নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালানো কিংবা সমগ্র ফিলিস্তিন ভূখণ্ড দখল করার
ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে আগামী মাসের ১৭ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত তিন
দিনব্যাপী এক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। এতে ইসরায়েলে ও ফিলিস্তিনের মধ্যে
৫৭ বছর ধরে চলমান সংঘাত-সংঘর্ষ বন্ধ করে এই সমস্যার একটি
দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই সম্মেলনটি ফ্রান্স ও
সৌদি আরব যৌথভাবে আহবান করেছে। জাতিসংঘের মূল প্রস্তাব অনুযায়ী সাধারণ
পরিষদের মোট ১৫০টি সদস্য রাষ্ট্র আগেই একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র
গঠনের ব্যাপারে তাদের সমর্থনের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে। বর্তমান
সম্মেলনের উদ্দেশ্য হচ্ছে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সে সমর্থন আরো শক্তিশালী করা।
গত
ডিসেম্বরে জাতিসংঘে গৃহীত একটি প্রস্তাবের ভিত্তিতে আগামী মাসে এই
সম্মেলনের আয়োজন করা হচ্ছে। ফিলিস্তিনের রামাল্লাহভিত্তিক কর্তৃপক্ষকে একটি
স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে এরই মধ্যে স্বীকতি দিয়েছে ১৫০টি সদস্য রাষ্ট্র।
এতে জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের একটি ‘অবজার্ভার স্ট্যাটাস’ নিশ্চিত হয়েছে, পূর্ণ
সদস্য পদ নয়। কারণ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যরা এ ব্যাপারে
এখনো তাদের ভোট বা সমর্থন প্রদান করেনি। তবে এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে
গত বছর মে মাসে ইউরোপের তিনটি দেশ আয়ারল্যান্ড, নরওয়েও, স্পেন ফিলিস্তিন
রাষ্ট্রকে তাদের স্বীকৃতি প্রদান করেছে। গত এপ্রিলে ইউরোপের আরেকটি
প্রভাবশালী দেশ ও নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য ফ্রান্স শিগগিরই
ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে পারে বলে জানিয়েছে। সামনের মাসে অনুষ্ঠেয়
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সম্মেলনে ফ্রান্স সে বহু প্রতীক্ষিত স্বীকৃতিটি
জ্ঞাপন করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ১৯৯৩ সালে
ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন ও প্যালেস্টাইন লিবারেশন
অর্গানাইজেশনের (পিএলও) চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাতের মধ্যে ‘অসলো অ্যাকর্ড’
নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন
ডিসির হোয়াইট হাউসের লনে স্বাক্ষরিত সেই চুক্তিটির মূল লক্ষ্য ছিল
ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও গাজা ভূখণ্ডে স্থানীয় প্রশাসন পরিচালনার ব্যাপারে
পিএলও কর্তৃপক্ষকে স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা প্রদান। তখন যুক্তরাষ্ট্রের
তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে তখন
থেকে (অসলো চুক্তি স্বাক্ষরের সময়) পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে ইসরায়েল ও
ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ তাদের মধ্যে বিরাজমান যাবতীয় সমস্যা মিটিয়ে ফেলবে এবং
এরই ভিত্তিতে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটবে। কিন্তু সেই চুক্তি
স্বাক্ষর করে ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিবে ফেরার পর প্রধানমন্ত্রী আইজাক
রবিনকে হত্যা করা হয়। তারপর এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আর গৃহীত সিদ্ধান্ত
অনুযায়ী এগোয়নি। পরে অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ক্ষমতা থেকে বিদায়
নেওয়ার আগে মেরিল্যান্ড রাজ্যের ক্যাম্প ডেভিডে তৎকালীন ইসরায়েলি
প্রধানমন্ত্রী ইহুদ বারাকের সঙ্গে ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের একটি
গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বৈঠক আয়োজন করা হয়েছিল। এতে প্রেসিডেন্ট বিল
ক্লিনটনের উপস্থিতিতে শুধু চূড়ান্ত সীমানা নির্ধারণের বিষয়েই নয়, শরণার্থী
প্রত্যাবর্তন, বিভিন্ন ক্ষতিপূরণ ও ইস্যু নিয়ে দীর্ঘ বিতর্কের সূত্রপাত
হয়েছিল। তখন নির্ধারিত আলোচনার সময়কাল বেশ কিছুটা বাড়ানো হলেও সমস্যা বা
বিতর্কের মীমাংসা মোটেও সম্ভব হয়নি। ক্রমে বিষয়টি আরো জটিল আকার ধারণ করতে
থাকে। এরই মধ্যে ইসরায়েলের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন লিকুদ পার্টির নেতা
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, যিনি স্বাধীন-সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের
প্রস্তাবে বিশ্বাসই করতেন না।
পিএলওর সংগ্রামী নেতা ইয়াসির আরাফাতের
অত্যন্ত সন্দেহজনকভাবে মৃত্যু ঘটেছিল ১১ নভেম্বর ২০০৮ সালে। তাঁকে বিষ
প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল বলে অনেক ফিলিস্তিনি যোদ্ধা এখনো অভিযোগ করেন।
তাঁর মৃত্যুর অনেক আগে থেকেই ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের সংগ্রামী সংগঠন
আল-ফাতাহ এবং গাজার প্রতিবাদী সংগঠন হামাসের নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ভয়ানক
বিতর্ক ও রাজনৈতিক বিরোধ চলছিল। হামাস তখন থেকে প্রকাশ্যেই বলা শুরু করেছিল
যে আল-ফাতাহর নেতাকর্মীদের দিয়ে ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রাম চালানো আর
কোনোমতেই সম্ভব নয়। হামাসের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গাজায় বসবাসকারী শেখ আহমেদ
ইয়াসিন নামের একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা। ইসরায়েলিরা মার্চ ২০০৪
সালে তাঁকে হত্যা করে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ফিলিস্তিনের মুক্তির
প্রশ্নে ইসরায়েলি শাসকদের সঙ্গে কখনো আপস করেননি। হামাস তখন ইসলামিক
প্রতিরোধ আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন হিসেবে খ্যাতি লাভ করে এবং ২০০৭
সালে গাজায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এককভাবে সাফল্যের মুখ দেখে। শেখ আহমেদ
ইয়াসিনের মৃত্যুর পর পর্যায়ক্রমে হামাসের নেতৃত্বে আসেন মুসা আবু মারজুক,
খালেদ মিশাল, ইসমাইল হানিয়া ও ইয়াহিয়া সানোয়ারের মতো অকুতোভয় সংগ্রামী
নেতারা। তাঁদের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা, সংগ্রাম ও ত্যাগ-তিতিক্ষার কারণেই
গাজায় সম্ভব হয়েছিল এই আধুনিক যুগে ইহুদিবাদীদের বিরুদ্ধে এক অভাবনীয়
গেরিলা ‘টানেল ওয়ারফেয়ার’, যা এখনো সারা বিশ্বে এক বিস্ময়কর ব্যাপার।
ইসরায়েলের দোসর হিসেবে খ্যাত সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রের
সাহায্য-সহযোগিতা ও সরাসরি অংশগ্রহণ ছাড়া হামাসের যোদ্ধাদের সামনে ইসরায়েল
কোনোমতেই টিকতে পারত না। যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য ছাড়া
ইসরায়েল এক সপ্তাহও যুদ্ধ চালাতে সক্ষম ছিল না। এখন ইসরায়েল চায় গাজাসহ
সমগ্র ফিলিস্তিনকে গ্রাস করতে। তারা চায় হামাসকে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র এবং শেষ
পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন করতে। কিন্তু হামাস কি শেষ পর্যন্ত তেমন একটি পরিকল্পনা
মেনে নেবে?
গাজায় মানবিক ত্রাণ তৎপরতা চালানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের
বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চেয়েছিলেন অবিলম্বে একটি যুদ্ধবিরতি
ঘোষণা করতে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এর আগে চান সমগ্র গাজা ভূখণ্ড
দখলে নিতে, জিম্মিদের মুক্ত করতে এবং হামাসকে নিরস্ত্র ও নিশ্চিহ্ন করতে।
সেসব নিয়ে এখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে নেতানিয়াহুর এক অঘোষিত বিরোধ
দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় এই উল্লিখিত দুই নেতার মধ্যে বিরাজমান মতবিরোধ
ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানকে এক অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দিচ্ছে বলে তথ্যাভিজ্ঞ
মহলের বিশ্বাস। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মতো বর্তমান
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে
নেতানিয়াহুকে ইসরায়েলের রাষ্ট্রক্ষমতায় রেখে ফিলিস্তিন সমস্যার কোনো
শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব হবে না। এতে এশিয়া, ইউরোপসহ বিশ্বনেতা ও
শান্তিকামী সাধারণ মানুষের কাছে নেতানিয়াহুর পাশাপাশি ডোনাল্ড ট্রাম্প আরো
বিতর্কিত হয়ে পড়বেন। এর মূল কারণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদিবাদীরা অত্যন্ত
শক্তিশালী। তাদের সমর্থনেই নেতানিয়াহু এখনো টিকে রয়েছেন। গোষ্ঠীটি
অর্থনৈতিক দিক থেকে এতই শক্তিশালী যে তারা যেকোনো সময় প্রেসিডেন্ট
ট্রাম্পকে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল করে ফেলতে
সক্ষম। সে কারণেই ট্রাম্প ফিলিস্তিনের ব্যাপারে কোনো শক্তিশালী অবস্থান
নিতে পারেন না এবং তাতেই এশিয়া ও ইউরোপের নেতাদের সঙ্গে ট্রাম্পের নতুন
পর্যায়ে আরেক বিরোধ সৃষ্টি হতে পারে। তবু বিশ্বব্যাপী অসংখ্য মানুষ তাকিয়ে
রয়েছে জাতিসংঘে অনুষ্ঠেয় আগামী মাসের সম্মেলনের দিকে। সে সম্মেলনে সৌদি
আরব, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ অসংখ্য দেশ ফিলিস্তিন সমস্যার একটি
দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান নিশ্চিত করতে একটি আন্তরিক উদ্যোগ বা দায়িত্ব
কাঁধে তুলে নিয়েছে। সে ক্ষেত্রে তারা ব্যর্থ হলে শুধু ফিলিস্তিনবাসী নয়,
সারা বিশ্বের অধিকারসচেতন সংগ্রামী মানুষও হেরে যাবে।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
‘প্যালেস্টাইন-এক সংগ্রামের ইতিহাস’ গ্রন্থের প্রণেতা