বিশ্বায়নের
যুগে বিভিন্ন সময়ে দেশে মন্দা পরিস্থিতি অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেয়।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যখন দুর্বল থাকে, তখন দেশের নীতিনির্ধারকদের বিভিন্ন
মেয়াদি রাজস্ব পরিকল্পনা করতে হয় এবং অবশ্যই সেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা থাকতে
হবে। বর্তমানে দেশের মূল্যস্ফীতি অন্যতম একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ক্রমাগত মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ দারিদ্র্যসীমার অনেক নিচে নেমে গেছে।
সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের মান ক্রমশই নিম্নমুখী হয়েছে। সাধারণের জীবন থেকে
পুষ্টি চলে গেছে। কাজেই পণ্যের মূল্য যাতে না বাড়ে সেদিকটা নজরে রাখার সময়
এসেছে। প্রয়োজনে আমদানি শুল্ক কমিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে হবে।
দেশজুড়ে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য এখন বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। তা ছাড়া
আঞ্চলিক বৈষম্য ক্রমবর্ধমানভাবে বেড়েই চলছে। দেশের সাধারণ মানুষ অধিকাংশই
দিন আনে দিন খায়। কাজেই নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেলে তাদের ক্রয়ক্ষমতা
স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর
একটি অংশকে ঋণ করে জীবনযাপন করতে হয়। কারণ প্রয়োজনমতো চাহিদা মেটাতে না
পেরে তাদের অনেককে বাড়তি খরচ মেটাতে হয়।
মূল্যস্ফীতি রোধে বাজার
নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এ সমস্যা থেকেই যাবে। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে
ঋণের সুদহার বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সুদহার বাড়িয়ে
মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলা করছে। সে ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে বিচার-বিশ্লেষণের
দরকার আছে। আরও অধিকসংখ্যক প্রান্তিক মানুষকে নিরাপত্তাবেষ্টনীর
অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে পড়লে সমাজে অস্থিরতা
আরও বেড়ে যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
বর্তমানে দেশে উৎপাদনশীলতা
বাড়ানোর বিকল্প নেই। একই সঙ্গে দেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে।
বেসরকারি বিনিয়োগও বেশ শ্লথগতিতে আছে। অর্থনীতিকে চাঙা রাখতে সরকারের
পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। মূল্যস্ফীতি বাড়লে প্রান্তিক
জনগোষ্ঠী বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে সাধারণ
দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ খুবই অসুবিধার মধ্যে রয়েছে।
মূল্যস্ফীতির হার যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, মজুরি বৃদ্ধির হার সেভাবে বাড়ছে
না। মূল্যস্ফীতি আর মজুরি বৃদ্ধির এ পার্থক্যের কারণে সাধারণ মানুষ সংসারের
ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে হিমশিম খাচ্ছে। অনেক পরিবার তাদের খাবারের পরিমাণ
কমিয়ে দিয়েছে। ব্যয় বৃদ্ধির কারণে কেউবা তুলনামূলক কম পুষ্টিসম্পন্ন খাবার
গ্রহণ করছে। অধিকাংশ মানুষ তাও খেতে পারছে না।
অনেক মানুষই এখন
উচ্চমূল্যস্ফীতির কষাঘাতে জর্জরিত। দেশের সাধারণ জনগণ প্রচণ্ড চাপের মধ্যে
আছে। উচ্চমধ্যবিত্তের মানুষ হয়তো তাদের সঞ্চয় ভেঙে জীবনযাত্রার মানটা রক্ষা
করতে পারে। কিন্তু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীরতো কোনো সঞ্চয় নেই। আমরা দেখছি, এই
মানুষগুলোর জীবনমান ক্রমশই নিম্নমুখী হচ্ছে। এখানে আমাদের যা করতে হবে;
সরকারের সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় যেসব প্রকল্প আছে, তা যেন
সুষ্ঠুভাবে কার্যকর করা যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ
বিভিন্ন ভাতার ক্ষেত্রে প্রায়শই অভিযোগ আসে। প্রকৃতপক্ষে যারা পাওয়ার যোগ্য
তারা পায় না। যারা পাওয়ার যোগ্য নয়, তারা পায়। অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি
কারচুপি হয়। এমনও দেখা যায় যে, খাদ্য সহায়তার কাজ কোনো কোনো মেম্বারের
বাড়িতে হয়। সেখানে গুদামে রক্ষিত মালামাল অনেক সময় ধরাও পড়ে। এ বিষয়গুলো
খতিয়ে দেখতে হবে। যারা এ ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত তাদের আইনের আওতায়
নিয়ে এসে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। দিনের পর দিন সাধারণ মানুষের
জীবনমানের ওপর যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে দ্রুতই জনবান্ধবমূলক
কর্মসূচি বা পদক্ষেপ নিতে হবে।
এখনো সিন্ডিকেট আছে এবং তা ব্যাপকভাবেই
আছে। মাঝে মাঝে আমরা দেখি বাজারগুলোতে নানারকম অপারেশন হয়। সেই অপারেশনে
কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। কাউকে ক্ষতিপূরণ চার্জ করা হয়। কিন্তু দুই দিন
পরে এরা নানারকম ফন্দি-ফিকির শুরু করে। সেটা নিয়ে আলোচনার বিষয় থাকতে পারে।
মোটামুটিভাবে সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য আমি মনে করি, বর্তমানে যে আইন আছে
‘প্রটেকশন অব কনজ্যুমার লাইফ’- সে আইনের যথাযোগ্য বাস্তবায়ন জরুরি।
প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে এর মাত্রা বাড়ানো যেতে পারে। সাধারণ প্রান্তিক
মানুষের জীবনযাপনের মান ফিরিয়ে আনতে এই শ্রেণির দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে।
এদের কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।
অর্থনৈতিক কার্যক্রম সফল হতে হলে দেশের
সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো নাজুক অবস্থায় আছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি
নিয়ন্ত্রণে এনে সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জোর পদক্ষেপ চালাতে হবে। পণ্য
পরিবহনকালে চাঁদাবাজি এখনো আগের মতোই চলছে। মার্কেটে মার্কেটে চাঁদাবাজি
হচ্ছে। হয়তো চাঁদাবাজের বদল হয়েছে। কিন্তু চাঁদাবাজি বন্ধ হচ্ছে না।
মূল্যস্ফীতির জন্য রাস্তায় রাস্তায় পণ্য চলাচলকালে এসব চাঁদাবাজি অনেকটাই
দায়ী। বাজারব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেটের এ ধরনের কারসাজি বন্ধে
সরকারি-বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
দেশের
অর্থনীতি একটা বড় সমস্যার মধ্যদিয়ে যাচ্ছে বলা যায়। দেশ থেকে অনেক টাকা
পাচার হয়েছে। আইনগুলো শক্তিশালী হওয়া দরকার। তা ছাড়া প্রশাসনিক দুর্বলতা
যথেষ্ট পরিমাণে পরিলক্ষিত হয়েছে। এসব বিষয় অর্থনীতির ভিত্তিকে আরও বেশি
দুর্বল করেছে। ফলে অর্থনীতি একটা বড় রকম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। অর্থনৈতিক
স্থিতিশীলতা তৈরি না হয়ে আরও ঝুঁকির মধ্যে আছে। এর ফরে জীবনযাত্রার মান
বেশি নিচে নেমেছে। এমতাবস্থায় সচেতনতার পাশাপাশি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
নিতে হবে। তা না হলে অর্থনীতি আরও বেশি সমস্যাসংকুল হয়ে পড়বে। অর্থনীতিতে
নানামুখী সংস্কারের মধ্যে প্রথমেই প্রয়োজন ব্যাংক খাতে সংস্কার। এ খাতে
সুশাসনের বড় অভাব আছে। বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে
কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। ঋণসমস্যা সমাধানে দেশ থেকে পাচার অর্থ
ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা খুবই জরুরি। এর ব্যত্যয় হলে দেশের
অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ অপেক্ষাকৃত কঠিন হবে।
লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা