বছরের
পর বছর বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়ছে। দিন দিন রোগের ভাইরাস আরও
শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। সেদিকে নজর না দেওয়ায় এ বছর ডেঙ্গুর প্রভাব আরও
মারাত্মক হয়ে উঠেছে। গত কয়েক বছর অব্যাহতভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটে চললেও
সেদিকে তেমন কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে এ বছর মৌসুমের আগে আগে সেটা
প্রকট হয়ে উঠেছে। যারা এখন আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের মধ্যে দ্বিতীয়বার
আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যাই বেশি। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটা ধরন আছে। কোনো ব্যক্তি
ডেঙ্গুর একটা ধরন দ্বারা আক্রান্ত হলে সেই নির্দিষ্ট ধরনের বিরুদ্ধে তাদের
মধ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। কিন্তু যখন মানুষ বাকি তিনটা ধরনের মধ্যে
যেকোনো একটি ধরনে আক্রান্ত হয় তার শরীরে এ নতুন ধরনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ
ক্ষমতা থাকে না।
তখন গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। ডেঙ্গুর
প্রধান লক্ষণ হচ্ছে প্রচণ্ড জ্বর অনুভব করা এবং সে ক্ষেত্রে জ্বর টানা
কয়েকদিন থাকতে পারে। ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেওয়ার পর আবারও জ্বর আসতে পারে।
এর সঙ্গে শরীরে ব্যথা, মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা এবং চামড়ায় লালচে দাগ
বা ফুসকুড়ি দেখা যায়। ডেঙ্গু আক্রান্ত সব রোগীকে হাসপাতালে স্থানান্তর করার
দরকার নেই। বিভিন্ন ধরনের জটিলতা যেমন পেটে ব্যথা, বমি, ডায়াবেটিস,
স্থুলতা, অন্তঃসত্ত্বা, জন্মগত সমস্যা, হৃদযন্ত্র, কিডনি বা লিভারের সমস্যা
থাকলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়াই ভালো। ডেঙ্গুর ভয়াবহতায় লিভার, কিডনি,
মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র বা
আইসিইউর প্রয়োজন হতে পারে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে ঘরের ভেতর-বাহির নির্বিশেষে
সমগ্র পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন ও আবর্জনামুক্ত রাখতে হবে। পানি জমতে পারে এমন
জায়গা সপ্তাহে অন্তত একবার পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। গাছের টব, ফুলদানি, পড়ে
থাকা গাড়ির টায়ারে জমে থাকা পানি ফেলে দিয়ে শুকনো ও পরিচ্ছন্ন করতে হবে।
শরীর ঢেকে রাখা পোশাক যেমন- লম্বা-হাতা শার্ট, লম্বা প্যান্ট, মোজা এবং
জুতা পরতে হবে। ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী মশা ভোর এবং সন্ধ্যায় সবচেয়ে বেশি
সক্রিয় থাকে। এ সময় অতিরিক্ত সতর্ক থাকুন। রাতে শোবার সময় মশারি ব্যবহার
করুন। মশানিরোধক কীটনাশক ব্যবহার করতে পারেন। নগরবাসীকে এ সময় সজাগ ও সচেতন
হতে হবে। ডেঙ্গু এখন গ্রামেও ছড়িয়েছে, কারণ গ্রামেও শহরের মতো পানি জমার
জায়গা তৈরি হয়েছে। যেমন: পলিথিন, প্লাস্টিক, প্যাকেটের খাবার, পাকা রাস্তা,
পাকা ভবন, যান্ত্রিক গাড়ি ইত্যাদি। ডেঙ্গু হলেই আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থাকা
উচিত। কিছু বিপদসংকেত জানা থাকলে সতর্ক হতে সুবিধা হবে। গুরুতর যেকোনো
লক্ষণ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। নিজে থেকে কোনো
ওষুধ খাওয়া যাবে না। কারণ ভুল ওষুধ স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
ডেঙ্গু
জ্বরের জন্য দায়ী এডিস মশা অন্ধকারে কামড়ায় না। সাধারণত সকালের দিকে এবং
সন্ধ্যার কিছু আগে এডিস মশা তৎপর হয়ে ওঠে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের কোনো
বিশেষ লক্ষণ দেখা নাও যেতে পারে। সঠিক চিকিৎসায় বাড়িতে থেকেই এ রোগের
নিরাময় সম্ভব। শুধু বিশেষ কিছু ক্ষেত্রেই রোগীকে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন
হয়। সে ক্ষেত্রেও এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে রোগী ভালো হয়ে যাওয়ার পূর্ণ
সম্ভাবনা থাকে। করোনা মহামারির সময় ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না
গেলেও পরের বছর এর প্রকোপ বেড়ে যায়। ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী মশা কোনো ব্যক্তিকে
কামড়ালে, সেই ব্যক্তি চার থেকে ছয় দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হতে
পারেন।
আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো ভাইরাসবাহী এডিস মশা কামড়ালে, সেই মশাও
ডেঙ্গু জ্বরের ভাইরাসবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে ডেঙ্গু
ছড়িয়ে পড়ে। ডেঙ্গু ছোঁয়াচে নয়। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে স্পর্শ করলে
অথবা এক বিছানায় ঘুমালে কিংবা তার ব্যবহৃত কিছু ব্যবহার করলে, অন্য কারও এ
রোগে আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ নেই। ফলে, ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে
আসায় কোনো বাধা নেই, কিংবা তাকে আলাদা রাখার কোনো প্রয়োজনও নেই। তবে ডেঙ্গু
জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে মশারির মধ্যে রাখাই উত্তম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে
প্রথমবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর বিশেষ কোনো উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা যায় না।
শুধু অল্প কিছু ক্ষেত্রেই রোগের প্রভাব গভীর হয়। ডেঙ্গুর সাধারণ
উপসর্গগুলো হলো- উচ্চ জ্বর, তীব্র মাথার যন্ত্রণা, চোখের পেছনে ব্যথার
অনুভূতি, মাংসপেশি এবং অস্থিসন্ধিতে যন্ত্রণা, বমিভাব, মাথাঘোরা, গ্রন্থি
ফুলে যাওয়া এবং ত্বকে বিভিন্ন স্থানে ফুসকুড়ি দেখা দেওয়া।
এই উপসর্গগুলো
রোগসংক্রমণের চার থেকে ১০ দিনের মধ্যে দেখা দেয়। সাধারণত দুই থেকে সাত দিন
পর্যন্ত উপসর্গ স্থায়ী হতে পারে। ডেঙ্গু ভাইরাস মানুষের শরীরের
রক্তনালিগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে রক্তনালিতে ছিদ্র তৈরি হয়। রক্ত
প্রবাহে জমাট-তৈরির কোষগুলোর (প্ল্যাটিলেট) সংখ্যা কমে যেতে থাকে। এর জন্য
মানুষের শরীরে রক্তচাপ কমে গিয়ে শক লাগা, শরীরের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ অঙ্গে
রক্তপাত, যেকোনো অঙ্গের ক্ষতি এবং শেষপর্যন্ত রোগীর মৃত্যু হতে পারে। রোগীর
শরীরে গুরুতর উপসর্গগুলোর কোনো একটি দেখা দিলে অবশ্যই দ্রুত ডাক্তারের
সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত বা রোগীকে নিকটবর্তী হাসপাতালে ভর্তি করানো দরকার।
অন্যথায় রোগীর প্রাণ সংকটে পড়তে পারে। সবচেয়ে ভালো গুরুতর লক্ষণের শুরুতে
সতর্ক হওয়া।
দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণ পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। তবে
প্রতিটি হাসপাতালেই এখন ডেঙ্গু কর্নার আছে। প্রায় প্রতিটি হাসপাতালেই
নির্দিষ্ট শয্যা প্রস্তুত রয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও চিকিৎসা দিতে
ডাক্তাররা প্রস্তুত আছেন, স্বেচ্ছাসেবী আছেন। এখন দরকার সবার স্বপ্রণোদিত
অংশগ্রহণ। আমরা হাসপাতালের রোগীদের মশারির ভেতরে থাকার পরামর্শ দিই- যা
আমার মতে সঠিক নয় এবং বাস্তবসম্মতও নয়। বরঞ্চ হাসপাতালগুলোর এক একটা ভবনকে
পুরোপুরিভাবে মশানিরোধক নেট (জাল) দিয়ে ঘিরে দেওয়া উচিত। উচ্চবিত্ত,
মধ্যবিত্তদের ঘরকে পুরো নেট (জাল) দিয়ে ঢেকে রাখার কারণে সেখানে মশা তেমন
ঢুকতে পারে না। বাড়িতে সেটা সম্ভব হলে হাসপাতালে তা কেন পারা যাবে না? এর
পাশাপাশি শহর ও গ্রামে নিয়মিত মশকনিধন কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। ঘরবাড়ি
পরিষ্কার-পরিচ্ছন রাখতে হবে। ডেঙ্গু প্রতিকারের পাশাপশি প্রতিরোধমূলক
ব্যবস্থা নিতে হবে।
লেখক: জনস্বাস্থ্যবিদ ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, রোগতত্ত্ব রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)