দক্ষিণ
এশিয়ার দেশগুলো খাদ্যমূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে পারলেও বাংলাদেশ এখনো পারছে
না। এখন খাদ্যমূল্যস্ফীতি বাংলাদেশেই বেশি। বিশ্বব্যাংকের
খাদ্যমূল্যস্ফীতির তালিকায় বাংলাদেশ টানা দুই বছর ধরে ‘লাল’ শ্রেণিতে
রয়েছে। এটি প্রায়শই মুদ্রাস্ফীতির সবচেয়ে লক্ষণীয় রূপ, যা নিম্নআয়ের
ব্যক্তিদের সবচেয়ে কঠিনভাবে প্রভাবিত করে। মুদ্রাস্ফীতি বেশি হওয়ার সাধারণ
কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ফসলের পর্যাপ্ত মজুত না থাকা, দেশের অভ্যন্তরে
অস্থিতিশীলতা, যুদ্ধবিগ্রহ, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি এবং খাদ্য উৎপাদন
ব্যাহত হওয়া। খাদ্যমূল্যস্ফীতি প্রায়ই মুদ্রাস্ফীতির দিকে পরিচালিত করে,
কারণ বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য অতি প্রয়োজন। অর্থনীতিবিদরা আগের বছর বা মাসের
সঙ্গে অথবা কোনো নির্দিষ্ট সময়কালের সঙ্গে বর্তমানের তুলনা করে খাদ্য,
পোশাক, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, সেবামূলক দ্রব্যাদি ইত্যাদি বিভিন্ন
উপাদানের মূল্য বৃদ্ধির যে পার্থক্য যাচাই করেন সেটাই মূল্যস্ফীতি। দক্ষিণ
এশিয়ার অন্য দেশগুলো মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে শুরু
করেছিল।
কিন্তু বাংলাদেশ উচ্চমূল্যস্ফীতি, তথা খাদ্যমূল্যস্ফীতির বিষয়টি
স্বীকার করতেই অনেক সময়ক্ষেপণ করেছে। আগে ডলারের বিনিময় হারের বিষয়টি
গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। তবে
অন্তর্র্বতী সরকার এসে বিষয়টিতে গুরুত্ব দিলেও এখন পর্যন্ত সফলতার মুখ দেখা
যায়নি। বিশ্বব্যাংক সর্বশেষ ১০ থেকে ১২ মাসের খাদ্যমূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি
বিবেচনায় নিয়ে খাদ্যনিরাপত্তা-বিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। এর আগের
টানা এক বছর বাংলাদেশ লাল শ্রেণির তালিকায় ছিল। প্রতি ছয় মাস পরপর এ চিত্র
প্রকাশ করে থাকে সংস্থাটি। সে অনুসারে, প্রায় দুই বছর ধরে বাংলাদেশ লাল
তালিকায় অর্থাৎ অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, ভারতে
খাদ্যমূল্যস্ফীতি এখন ৬ শতাংশের কম। পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি এখন ‘মাইনাস’
(নেতিবাচক), অর্থাৎ খাদ্যপণ্যের দাম কমছে। শ্রীলঙ্কায়ও একই চিত্র। নেপাল ও
মালদ্বীপে খাদ্যমূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের কম।
খাদ্যমূল্যস্ফীতি কোন দেশে কত
বেশি, তা বোঝাতে বিভিন্ন দেশকে চার শ্রেণিতে ভাগ করেছে বিশ্বব্যাংক। যেসব
দেশের খাদ্যমূল্যস্ফীতি ৩০ শতাংশ বা তার বেশি, সেসব দেশকে ‘বেগুনি’
শ্রেণিতে; ৫ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে যেসব দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি, তাদের
‘লাল’ শ্রেণিতে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ২ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে মূল্যস্ফীতির
দেশগুলোকে ‘হলুদ’ ও ২ শতাংশের কম মূল্যস্ফীতির দেশগুলোকে ‘সবুজ’ শ্রেণিতে
রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে ১৭২টি দেশের খাদ্যমূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি তুলে ধরা
হয়েছে সংস্থাটির প্রতিবেদনে। বাংলাদেশের পাশাপাশি আরও ১৪টি দেশ এক বছর ধরে
লাল শ্রেণিতে আছে। এই তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার ভারতও আছে। অন্য দেশের মধ্যে
রয়েছে কঙ্গো, অ্যাঙ্গোলা, ইথিওপিয়া, গাম্বিয়া, গিনি, মাদাগাস্কার, ঘানা,
লাওস, লেসেথো, তিউনিসিয়া, জাম্বিয়া, বেলারুশ ও রাশিয়া। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান
ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, মার্চ শেষে দেশে খাদ্যমূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে
প্রায় ৯ শতাংশ। সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ভুটানের হিসাব
পাওয়া যায়নি। সার্কভুক্ত দেশ আফগানিস্তানেও খাদ্যমূল্যস্ফীতি এখন মাইনাস।
বাংলাদেশের
পাশাপাশি আরও ১৪টি দেশ এক বছর ধরে লাল শ্রেণিতে আছে। এই তালিকায় দক্ষিণ
এশিয়ার ভারতও আছে। অন্য দেশের মধ্যে রয়েছে কঙ্গো, অ্যাঙ্গোলা, ইথিওপিয়া,
গাম্বিয়া, গিনি, মাদাগাস্কার, ঘানা, লাওস, লেসেথো, তিউনিসিয়া, জাম্বিয়া,
বেলারুশ ও রাশিয়া। একটি দেশের বাজারে পণ্যের মজুদ এবং মুদ্রার পরিমাণের
মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হয়। যদি পণ্যের তুলনায় মুদ্রার সরবরাহ অনেক বেড়ে যায়
অর্থাৎ দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক অতিরিক্ত মাত্রায় টাকা ছাপায় তখনই
মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। এর ফলে একই পরিমাণ পণ্য কিনতে আপনাকে আগের চাইতে বেশি
মুদ্রা খরচ করতে হবে।
এর মানে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। সব মিলিয়ে ওই
মুদ্রার মান বা ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে। উদাহরণস্বরূপ গত বছর ২০ কেজি চাল
কিনতে আমাদের খরচ হতো ১০০০ টাকা। কিন্তু চলতি বছর সেই একই পরিমাণ চাল কিনতে
যদি আমাদের খরচ পড়ে ১০৫০ টাকা। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে ৫০ টাকা বা ৫ শতাংশ
বেশি টাকা লাগছে। এই ৫ শতাংশ হলো মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ। এর মানে টাকার মানও
৫ শতাংশ কমে গেছে। এভাবে একটি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে বিভিন্ন পণ্য ও
সেবার দামের পরিবর্তন হিসাব করে মুদ্রাস্ফীতি পরিমাপ করা হয়। মূল্যস্ফীতি
অর্থনীতির একটি স্বাভাবিক চিত্র হলেও বড় ধরনের মুদ্রাস্ফীতিকে অর্থনীতির
জন্য অভিঘাত হিসেবে দেখা হয়। মুদ্রাস্ফীতি বলতে বোঝায় পণ্য ও সেবার দাম
বেড়ে যাওয়াকে। যা সাধারণত ঘটে অতিরিক্ত মুদ্রা সরবরাহের কারণে।
বাংলাদেশ
লাল শ্রেণিতে আসার কারণ বাংলাদেশে গত এক বছরে গড় খাদ্যমূল্যস্ফীতি ছিল ১০
দশমিক ৪৪ শতাংশ। এর মানে হলো, এক বছর আগে যে খাবার কিনতে ১০০ টাকা লাগত,
এখন তা কিনতে লাগছে ১১০ টাকা ৪৪ পয়সা। দেশের সব শ্রেণির মানুষের ওপর এর
সরাসরি প্রভাব পড়ছে। খাদ্যমূল্যস্ফীতি কমানো এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এর
জন্য সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। শুধু মুদ্রানীতি নয়, রাজস্বনীতিতেও পরিবর্তন
আনতে হবে। একই সঙ্গে বাজার তদারকিতে জোর দিতে হবে। বিশ্বব্যাংকের তালিকায়
ছয়টি দেশ এক বছর ধরে ‘বেগুনি’ শ্রেণিতে রয়েছে মালাবি, দক্ষিণ সুদান, হাইতি,
মায়ানমার, আর্জেন্টিনা ও তুরস্ক। সবচেয়ে ভালো অবস্থানে থাকা ‘সবুজ’
শ্রেণির আটটি দেশ হলো সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, সৌদি আরব, ম্যাকাও, চীন,
ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড ও বেনিন। প্রায় তিন বছর ধরে বাংলাদেশে উচ্চমূল্যস্ফীতি
চলছে। তবে এক বছর ধরে খাদ্যমূল্যস্ফীতি বেশি ছিল। টানা ১০ মাস
খাদ্যমূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের বেশি। ১০ মাস পর গত ফেব্রুয়ারি মাসে
খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের নিচে নামে। মার্চ মাসেও তা এক অঙ্কের ঘরেই
ছিল, যা একটু স্বস্তির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের মার্চ মাসের পর
খাদ্যের মূল্যস্ফীতি আর এক অঙ্কের ঘরে নামেনি। গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষ এত
দীর্ঘ সময় ধরে ভোগান্তিতে পড়েননি। এর মধ্যে গত জুলাই মাসে খাদ্যমূল্যস্ফীতি
১৪ দশমিক ১০ শতাংশে ওঠে, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিবিএসের
হিসাবে, ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসের পর থেকে এ বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত অর্থাৎ
গত এক বছরে গড় খাদ্যমূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ। গত এক বছরে গড়
খাদ্যমূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ হওয়ার মানে হলো, ২০২৩ সালের মার্চ থেকে
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যদি আপনার খাবার কিনতে ১০০ টাকা খরচ হয়;
পরের এক বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের মার্চ থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত খাবার
কিনতে লাগল ১১০ টাকা ৪৪ পয়সা। প্রতি ১০০ টাকায় খরচ বেড়েছে ১০ টাকা ৪৪ পয়সা।
এর মানে, বাংলাদেশের সব শ্রেণির মানুষের খাবার খরচ গড়ে এক-দশমাংশ বেড়েছে।
মূল্যস্ফীতি
এক ধরনের করের মতো। সেই হিসাব মতে, আমাদের প্রতি মাসে আয়ের পুরোটাই সংসার
চালাতে খরচ হয়ে যায়। যদি হঠাৎ জিনিসপত্রের দাম বাড়ে এবং সে অনুযায়ী আমাদের
আয় না বাড়ে, তবে অবশ্যই আমাদের ধারদেনা করে সংসার চালাতে হবে কিংবা খাবার,
কাপচোপড়, যাতায়াতসহ বিভিন্ন খাতে কাটছাঁট করতে হবে। মূল্যস্ফীতির চেয়ে
মজুরি বৃদ্ধি বা আয় বৃদ্ধি কম হলে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ে। প্রকৃত আয় কমে
যায়।
বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার অনেক দিন ধরেই
কম। মূল্যস্ফীতি বিশেষ করে খাদ্যমূল্যস্ফীতি কমানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ
জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। মুদ্রানীতির পাশাপাশি রাজস্ব নীতিগুলো এমন
করতে হবে, যেন মূল্যস্ফীতি কমে। এ ছাড়া বাজার তদারকিও জোরদার করতে হবে।
মূল্যস্ফীতি বিশেষ করে খাদ্যমূল্যস্ফীতি কমানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ জন্য
সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। মুদ্রানীতির পাশাপাশি রাজস্ব নীতিগুলো এমন করতে
হবে, যেন মূল্যস্ফীতি কমে। এ ছাড়া বাজার তদারকিও জোরদার করতে হবে।
লেখক: সাবেক রেজিস্টার, জাবিপ্রবি