রসমালাইয়ের পর ভৌগলিক নির্দেশক (জিআই) পন্যের স্বীকৃতি পেয়েছে কুমিল্লার শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী খাদি। এই উপমহাদেশে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের ঐতিহাসিক স্মারক খাদি কাপড়ের স্বীকৃতি নিয়ে কুমিল্লা জেলা থেকে দীর্ঘদিন দাবি জানিয়ে আসলেও তা অপূর্ণ ছিলো। অবশেষে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে খাদি। খাদির এই স্বীকৃতি পাওয়ায় আনন্দিত তাঁতী, খাদি কাপড় ব্যবসায়ীসহ কুমিল্লাবাসী।
কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী খাদিসহ আরও ২৪টি পণ্যকে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) সনদ দিয়েছে সরকার। গতকাল বুধবার ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর আয়োজিত বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস-২০২৫ এর আলোচনা সভায় সংশ্লিষ্টদের এসব সনদ হস্তান্তর করা হয়।
দীর্ঘদিন পরে হলেও খাদি নিজেদের পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া খুব খুশি হয়েছেন খাদি কাপড় বোনার কারিগর কুমিল্লার দেবিদ্বার গ্রামের সত্তোরোর্ধ তাঁতী চিন্তাহরণ দেবনাথ। বৃহষ্পতিবার সন্ধ্যায় চিন্তাহরণ দেবনাথ বলেন, ‘খাদি আমাদের। দাদা-বাবাদের পরম্পরায় ৭০/৮০ বছর এই কাপড় তৈরী করেছি। খাদি এখন আমাদের(জিআই) স্বীকৃতি পেয়েছে আমি খুউব খুশি হয়েছি। খুশির খবরটি আপনার কাছ থেকে প্রথম শুনলাম। তাঁতের শেষ বয়সে এসে খাদির এই স্বীকৃতি মিললো।’
চিন্তাহরণ আরো বলেন, ‘যতকিছুই হোক কুমিল্লার হাতেবোনা খাদির বিশেষত্ব আলাদা। তাঁতে কাপড় বুনে সেটা থেকে পোশাক তৈরী করে পরলে যে আরাম, তা অতুলনীয়। তবে আসল খাদি বাঁচিয়ে রাখতে তাঁতীদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। যেসব তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে- কাচামাল, তুলা, ভর্তুকি দিয়ে হলেও তাঁতীদের জাগাতে হবে। এক সময় আমাদের দেবিদ্বার, চান্দিনা গ্রামে শত শত তাঁত থাকলেও তুলা আর কর্মীর অভাবে এখন প্রায় সব বন্ধ। মেশিনের খাদি আর তাঁতের খাদির অনেক তফাত।’
তবে কালের আবর্তনে তুলা এবং কর্মী সঙ্কটে খাদি হ্যান্ডলুম (তাঁত) থেকে মেশিন লুমের প্রাধান্যে চলে যায়। এখন মেশিনেই তৈরী হয় বেশিরভাগ খাদি। নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদিসহ বিভিন্ন জেলার কারখানায় তৈরী হয় খাদি কাপড়। কুমিল্লার চান্দিনা, দেবিদ্বারের তাঁতীরাও ছেড়ে দেন চরকায় সুতা কাটা আর তাঁতে কাপড় বোন। এখনো এসব গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে আলাদা তাঁতের ঘর রয়েছে। অলস পড়ে আছে তাঁত। তারপর কিছু কিছু হ্যান্ডলুমের খাদি বাজারে মেলে এখনও, প্রায় কাছাকাছি মানের হওয়ায় মেশিনলুমের খাদিও দখল করেছে বাজার। দেশে বিদেশে যাচ্ছে এসব কাপড়, চাহিদাও বাড়ছে দিন দিন।
কুমিল্লার খাদিঘরের স্বত্বাধিকারী প্রদীপ কুমার রাহা বলেন, পৃথিবীর যেখানে বাঙালি আছে, সেখানে খাদি কাপড়ের প্রসার ঘটেছে। কুমিল্লায় বিদেশিরা আসেন, তারাও খাদির কাপড় কিনছেন। এটা হাতে তৈরি কাপড় হওয়ায় পরে ন্যাচরাল ফিল পাওয়া যায়।
খাদি ব্যবসায়িরা জানান, খাদি কাপড়ের বিশেষত্ব হলো এটি হাতে তৈরি, পরিবেশবান্ধব এবং আরামদায়ক। কুমি কারিগররা তাদের অনন্য দক্ষতার মাধ্যমে খাদিকে একটি শিল্পে রূপান্তরিত করেছেন। তিনি বলেন, এ স্বীকৃতির ফলে কুমিল্লার খাদি পণ্যের বিপণন ও রপ্তানির সুযোগ আরও বৃদ্ধি পাবে। দেশীয় বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারেও কুমিল্লার খাদি পণ্য নতুন মাত্রা পাবে, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারিগরদের জীবনমান উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সম্ভাবনাও তৈরি হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
একই এলাকার খাদি জ্যোৎস্না স্টোরের মালিক তপন পাল বলেন, ‘কুমিল্লার প্রতিটি মানুষ খাদির এমন স্বীকৃতিতে আনন্দিত। শত বছর পার হলেও এখনো দেশ-বিদেশে খাদি কাপড়ের ব্যাপক চাহিদা।’
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের দীর্ঘ প্রচেষ্টায় গত বছর কুমিল্লার রসমালাই জিআই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কুমিল্লার খাদি ও বিজয়পুরের মৃৎশিল্পের জিআই স্বীকৃতির জন্য তখন থেকেই কাজ শুরু হয়। কুমিল্লার ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে পরিচিত তিনটি পণ্যের মধ্যে দুটি জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। যে একটি বাকি আছে, সেটিও দ্রুত সময়ের মধ্যে স্বীকৃতি পাবে বলে তিনি আশাবাদী।’
জানা গেছে, খাদি হাতে বোনা এক ধরনের বিশেষ কাপড়। কার্পাস তুলা থেকে হাতে কাটা সুতা দিয়ে এই কাপড় বোনা হয়। এই কাপড় যে তুলা দিয়ে তৈরি হয়, সেই সুতাও হাতে তৈরি হয়। খাদি কাপড় মূলত মোটা। মহাত্মা গান্ধীর আহ্বানে ১৯২১ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় খাদি জাতীয় প্রতীকে পরিণত হয়। এ কাপড়ের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। ‘স্বদেশি পণ্য গ্রহণ করো আর বিদেশি পণ্য বর্জন করো’ এই স্লোগানের ওপর ভিত্তি করেই তখন খাদিশিল্পের বিকাশ হয়।
তবে খাদি কাপড়ের নামকরণ নিয়ে রয়েছে মতবাদ। দেশে যখন খাদি কাপড়ের চাহিদা বেড়ে যায়, তখন সাধারণ মানুষের কাপড়ের চাহিদা পূরণ করার জন্য মাটির নিচে গর্ত করে পায়ে চালানো প্যাডল দ্বারা এ কাপড় তৈরি হতো। খাদ থেকে তৈরি হতো বলে এর নাম হয় খদ্দর বা খাদি। আবার অনেকে বলে থাকে খদ্দর শব্দটি গুজরাট শব্দ। এই শব্দ থেকে খাদি বা খদ্দর হচ্ছে। বাংলাদেশে কুমিল্লায় সর্বপ্রথম খাদিশিল্পের প্রসার ঘটে। ধীরে ধীরে বাড়ে খাদি কাপড়ের চাহিদা। এই চাহিদাকে ধরে রাখার জন্য ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর তৎকালীন কুমিল্লা সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ও বার্ডের প্রতিষ্ঠাতা ড. আখতার হামিদ খান তৎকালীন গভর্নর ফিরোজ খান নূনের সহযোগিতায় দি খাদি কো-অপারেটিভ অ্যাসোসিয়েশন লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন। তখন কুমিল্লার অভয়াশ্রম, চট্টগ্রামের প্রবর্তক সংঘ আর নোয়াখালীর গান্ধী আশ্রমে খাদি বা খদ্দর কাপড় বোনা হতো।
ড. আখতার হামিদ খান প্রতিষ্ঠিত দি খাদি কো-অপারেটিভ অ্যাসোসিয়েশন লিমিটেডের হাল ধরেন চান্দিনার শৈলেন গুহ ও তার ছেলে বিজন গুহ। তারা এই খাদিশিল্পের সুনাম ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য অনবরত কাজ করে গেছেন। শৈলেন গুহ মারা যাওয়ার পর তার ছেলে অরুণ গুহ বাবার প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেন। পরবর্তী সময়ে অরুণ গুহ মারা গেলে শৈলেন গুহের আরেক ছেলে বিজন গুহ এই শিল্পকে ধরে রেখেছেন কোনোমতে। চান্দিনায় মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতিবিজড়িত একটি তাঁতশিল্প রয়েছে আজও। ১৯৯৪ সালে কুমিল্লার খাদিশিল্প তাদের গুণগত মানের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়।