রোববার ২৩ মার্চ ২০২৫
৯ চৈত্র ১৪৩১
বায়ুদূষণ-নাগরিক জীবনে এক নীরব ঘাতক!
মোহাম্মদ মাসুদ রানা চৌধুরী
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ১২:৪২ এএম আপডেট: ২০.০২.২০২৫ ১:৩২ এএম |



 বায়ুদূষণ-নাগরিক জীবনে এক নীরব ঘাতক!বায়ুদূষণ বর্তমান সময়ে একটি বৈশ্বিক পরিবেশগত সমস্যা হিসেবে মানবাধিকারের জন্য হুমকি স্বরুপ বলে বিবেচিত হচ্ছে। জাতিসংঘ ঘোষিত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০’ এর ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার বেশ কয়েকটি লক্ষ্যমাত্রার কাংখিত অর্জনের ক্ষেত্রে বায়ু দূষণের ফলে উদ্ভুত ঋণাত্বক প্রভাব বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাংলাদেশেও বায়ুদূষণ নগর জীবনে বহুবিধ সমস্যার উৎস হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিদ্যমান প্রমাণক থেকে জানা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের শিকার শহরগুলোর তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের প্রধান প্রধান শহর। মানুষের উন্নত জীবনযাপন নিশ্চিত করার জন্য আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবকাঠামো নির্মাণ, পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা অতীব জরুরি। কিন্তু ভারসাম্য বজায় না রেখে বা টেকসই উন্নয়ন ভাবনাকে বিবেচনায় না রেখে বর্তমানে যেভাবে শিল্পকারখানা, অবকাঠামো নির্মাণ ও গ্যাসোলিনচালিত যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে তার প্রতিক্রিয়া স্বরুপ আমাদের চারপাশের বায়ু মানুষের ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। জনস্বাস্থ্য পড়েছে মারাত্মক হুমকির মুখে। বায়ুদূষণের কারণে সব বয়সের মানুষের বহুবিধ শারীরিক সমস্যা যেমন শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি, কাশি, হাঁপানি, ব্রংকাইটিস, উচ্চ রক্তচাপ, মাথাব্যাথা, ফুসফুসে ক্যানসার, শুক্রাণুর ক্ষতি, জন্মগত ত্রুটি, স্ট্রোকের ঝুঁকি, কিডনির রোগ, হার্ট অ্যাটাক, মানসিক সমস্যা, হতাশা, বিষাদ, অস্থিরতা এবং অন্যান্য নেতিবাচক অনুভূতির প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মহিলাদের উচ্চ রক্তচাপের উচ্চ ঝুঁকি, কার্ডিওভাসকুলার এবং হার্টের সমস্যা, স্নায়বিক এবং জন্মগত সমস্যা, ত্বকের সমস্যা, এবং অ্যাজমাসহ বিভিন্ন ধরণের রোগ বালাই বেড়ে যাচ্ছে। 
বায়ুদূষণ হল বায়ুমণ্ডলে এমন রাসায়নিক, শারীরিক বা জৈবিক পদার্থের উপস্থিতি যা মানুষ এবং অন্যান্য জীবের জন্য ক্ষতিকর। দূষিত বাতাসে মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কঠিন ও তরল পদার্থ এবং গ্যাস যেমন অর্গানিক কার্বন, ব্লাক কার্বন, হেভি মেটাল, সালফেট, ফসফেট, নাইট্রেট, লেড, ক্যাডিয়াম, মার্কারি, সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড, এমোনিয়া, মিথেন, কার্বন মনো অক্সাইডসহ আরও অনেক ধাতু থাকে। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো, কলকারখানা ও যানবাহন নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া, অস্বাস্থ্যকর প্রক্রিয়ায় পৌর ও গৃহস্থালির আবর্জনা ব্যবস্থাপনা, লাগামহীন বৃক্ষনিধন, ব্যাপক কয়লা ও কাঠ পোড়ানো, অতিরিক্ত অ্যারোসল ও অন্যান্য স্প্রে ব্যবহার এবং রাসায়নিক কীটনাশকের যথেচ্ছা ব্যবহার ইত্যাদি কারণে বায়ুদূষণ ঘটছে। বায়ুদূষণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দূষণজনীত নানান স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং রোগব্যাধি। গবেষণামতে বায়ুদুষণ মানব স্বাস্থ্যের জন্য সামগ্রিকভাবে চতুর্থ বৃহত্তম ঝুঁকির কারণ। বিশ্বে সারা বছর যুদ্ধ, খুন, যক্ষা, এইচআইভি, এইডস ও ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে যত মানুষ মারা যান; তার চেয়ে বায়ুদূষণের কারণে বেশি মানুষের প্রাণ যায়। বায়ুদূষণের সংগে সংশ্লিষ্ট যেসব রোগের কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে, তম্মধ্যে- (১) ২৯ শতাংশের ক্ষেত্রে দায়ী ফুসফুস ক্যান্সারজনিত রোগ, (২) ১৭ শতাংশের ক্ষেত্রে দায়ী শ্বাসকষ্টজনিত সংক্রমন, (৩) ২৪ শতাংশের ক্ষেত্রে দায়ী স্ট্রোক, (৪) ২৫ শতাংশের ক্ষেত্রে দায়ী হৃদযন্ত্র কেন্দ্রিক রোগ, এবং (৫) ৪৩ শতাংশের ক্ষেত্রে দায়ী ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি)। 
যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত বায়ুদূষণ বিষয়ক এক বৈশ্বিক প্রতিবেদন ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স-২০২৩’ এ তথ্য মতে বায়ুদূষণের কারণে সারা বিশ্বে মানুষের গড় আয়ু কমেছে ২ বছর ৪ মাস। ইউনিসেফের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট (এইচইআই) থেকে প্রকাশিত  ‘স্টেইট অব গ্লোবাল এয়ার’ এর ২০২৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২১ সালে বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে প্রায় ৮১ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছে। এ রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২১ সালে বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে প্রায় পাঁচ বছরের কম বয়সি ০৭ লক্ষ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেটের ‘কমিশন অন পলিউশন অ্যান্ড হেলথ’ রিপোর্ট অনুযায়ী শুধু দূষণজনিত কারণে ২০১৯ সালে ৯০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে- যা ঐ বছর বিশ্বের মোট মৃত্যুর ছয়ভাগের এক ভাগ। আশংকার বিষয় হলো সেই ৯০ লাখ মৃত্যুর প্রায় ৭৫ শতাংশেরই কারণ ছিল বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণের কারণে শিশুদের আইকিউ কমে যাচ্ছে। ফলে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘আইকিউ এয়ার’ একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটা নির্মল বা দূষিত, সে সম্পর্কে ধারণা দেয়ার লক্ষ্যে নিয়মিত বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা তাৎক্ষণিক সূচক প্রকাশ করে বায়ুদূষণ পরিস্থিতি তুলে ধরে। রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ কবলিত দেশের তালিকায় উপরের দিকে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স-২০২৩’ শীর্ষক এক বৈশ্বিক গবেষণা প্রতিবেদনে বায়ুদূষণের তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়েছে তা খুবই আশংকাজনক। প্রতিবেদনের তথ্য মতে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশসমূহের একটিতে পরিণত হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রধান প্রধান শহরে বায়ুদূষণের হার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী নির্ধারিত মানের চেয়ে অনেক বেশি এবং বায়ুদূষণের প্রভাবে বাংলাদেশিদের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে।
বায়ুদূষণ মৃত্যু ছাড়াও মানুষের দীর্ঘ মেয়াদী রোগের কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এবং এটি স্বাস্থ্য সেবা প্রক্রিয়া, অর্থনীতি এবং সামাজিক ব্যবস্থার উপরে এটি বড় ধরণের চাপ তৈরী করছে। বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত ‘দ্য বাংলাদেশ কান্ট্রি এনভায়রনমেন্ট অ্যানালাইসিস (সিইএ)’ নামের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণের ফলে ২০১৯ সালে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে মোট জিডিপির ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ। এতে বায়ুদূষণের অবদান ছিল ৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। বায়ুদূষণের কারণে উৎপাদনশীলতা হ্রাস এবং জীবনমানের অবনতি হলে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রতি বছর ৫ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে বলে অনুমান করা হয়। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশের জাতীয় বায়ু মানের মানদণ্ড পূরণ করা সম্ভব হলে মৃত্যুহার ১৯ শতাংশ হ্রাস, আয়ুষ্কালজনিত সমস্যা ২১ শতাংশ এবং অক্ষমতার সঙ্গে বসবাস করা বছরে ১২ শতাংশ কমতে পারে। এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২১ সালের কঠোর বায়ু মানের মানদণ্ড পূরণ করা সম্ভব হলে মৃত্যুহার ৭৯ শতাংশ হ্রাস পাবে। যা প্রতিবছর ৮১ হাজার ২৮২ মানুষের জীবন রক্ষা করবে। 
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটানোর উদ্দেশ্যে উন্নয়নকাজ চলমান রাখতে হবে এবং একইসাথে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করে দূষণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। বায়ুদূষণ রোধে এর উৎস চিহ্নিত করে ধূলিদূষণ বন্ধ এবং জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত নিম্নমানের কয়লা ও তরল জ্বালানি হিসেবে নিম্নমানের ডিজেল, অকটেন, পেট্রোল ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। উন্নত দেশগুলোর অনুসরনে উন্নয়ন কাজ করার সময় নিঃসরণ মাত্রার নির্ধারিত মানদণ্ড মেনে চলতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে ও পরিবেশের উপর উন্নয়ন প্রকল্পের সম্ভাব্য প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে প্রকল্পের অর্থনৈতিক মূল্য নিরূপণ করা জরুরী। বায়ুদূষণ রোধ করার জন্য স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ বাস্তবায়নে সকলের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। ময়লা আবর্জনার পুনঃব্যবহার বাড়াতে হবে। রাস্তায় আবর্জনা সংগ্রহের জন্য পরিবেশ বান্ধব পদ্ধতি অবলম্বন করা দরকার। নির্মাণ কাজের সময় নির্মাণ স্থান ঘেরাও করে রাখা ও নির্মাণসামগ্রী পরিবহনের সময় ত্রিপল দিয়ে ঢেকে নিতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে জেলা শহরগুলোতে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ইটভাটাগুলোতে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং ইটের বিকল্প হিসেবে ব্লকের ব্যবহার বাড়াতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়ির নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ও নাগরিক উদ্যোগে বেশি বেশি করে গাছ লাগাতে হবে। সাইকেল চালনা উৎসাহিত করার করার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি খাত ও এনজিওগুলোকেও এগিয়ে আসা দরকার। বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনগনের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বায়ুদূষণের মতো নীরব ঘাতককে নিয়ন্ত্রনের মধ্যে নিয়ে আসার জন্য সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা খুবই জরুরী। 
লেখকঃ বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত।












সর্বশেষ সংবাদ
বিদায় মাগফিরাত
ঈদযাত্রায় ৮ কিলোমিটারে ভোগান্তির শঙ্কা
কুসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে নিয়ে অপপ্রচারের প্রতিবাদে মানববন্ধন
ব্রাহ্মণপাড়ায় হাজীজালাল উদ্দিন ফাউন্ডেশনের ঈদ উপহার বিতরণ
চান্দিনায় তিন বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি গ্রেফতার
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লা টাউন হল সংস্কারে দরপত্র জমা পড়েছে মাত্র তিনটি
কুমিল্লায় বহুতল ভবনে আগুন, আহত ৫
এবার চান্দিনায় এসএসসি পরীক্ষার্থীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ; আটক ২
কুমিল্লা পলিটেকনিকের আবাসিক শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা
কুমিল্লায়হেফাজতে ইসলামের বিক্ষোভ
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২