বৃহস্পতিবার ৩ জুলাই ২০২৫
১৯ আষাঢ় ১৪৩২
ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার বাড়ছে
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য একটি গভীর সংকেত
অধ্যক্ষ মহিউদ্দিন লিটন
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই, ২০২৫, ১:১৭ এএম আপডেট: ০৩.০৭.২০২৫ ১:৫৬ এএম |




 ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার বাড়ছে  ২০২১ সালে নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করেছিল ২২ লাখ ৪০ হাজার ৩৯৫ জন শিক্ষার্থী। তাদেরই ২০২৫ সালের ২৬ জুন অনুষ্ঠিত উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরীক্ষায় অংশ নেয় মাত্র ১২ লাখ ৩১ হাজার ৩৫২ জন। অর্থাৎ ১০ লাখ ৯ হাজার ৪৩ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষার মূলস্রোত থেকে ঝরে পড়েছে-যা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য একটি গভীর সংকেত।
শুধমাত্র কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডে উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষায় গত বৃহস্পতিবার ২৬ জুন বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষা দিতে যায়নি ২ হাজার ৪২৮ জন। গত ২৯ জুন বাংলা দ্বিতীয় পত্রে অনুপস্থিত ২ হাজার ৬৮২ জন। বাংলা প্রথম পত্রের চেয়ে দ্বিতীয় পত্রে অনুপস্থিত ২৫৪ জন বেশি। সবমিলিয়ে বাংলা পরীক্ষা দেয়নি ৫ হাজার ১১০ জন।
এবছরে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় মোট পরীক্ষার্থী গত বছরের চেয়ে ৮১ হাজার ৮৮২ জন কমেছে। গত তিন বছরের মধ্যে এবারই পরীক্ষার্থী সবচেয়ে কম। ২০২৪ সালে ১৪ লাখ ৫০ হাজার ৭৯০ পরীক্ষার্থী, ২০২৩ সালে ১৩ লাখ ৫৯ হাজার ৩৪২ শিক্ষার্থী এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নেয়। এদিকে দুই বছর আগে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাশ করে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তির পর রেজিস্ট্রেশন করে ও সোয়া ৪ লাখের বেশি শিক্ষার্থী এবার পরীক্ষা দেননি। 
২০২৩ সালে এসএসসি পাশ করেন ১৬ লাখ ৪১ হাজার ১৪০ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ১৪ লাখ ৮৩ হাজার ৮৮৯ জন শিক্ষার্থী একাদশ শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করে। বাকি ১ তার লাখ ৫৭ হাজার ২৫১ জন শিক্ষার্থী একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি না হয়ে শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়ে, যা ভর্তি পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার প্রায় ৯.৫৮ শতাংশ। এর পরের ধাপে তথা একাদশ শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করে ও চূড়ান্ত এইচএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ করেনি ৪ লাখ ৩৩ হাজার ৩০৪ জন শিক্ষার্থী, যা প্রায় ২১.২ শতাংশ। সব মিলিয়ে দুই বছরে ঝরে পড়েছে ৫ লাখ ৯০ হাজার ৭৫৫ জন শিক্ষার্থী, যা মোট এসএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর ৩৫.৯৯ শতাংশ। একসঙ্গে এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর পরীক্ষা না দেওয়াটা উদ্বেগজনক।
উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ার কারন সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি কুমিল্লা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য অধ্যক্ষ আবদুর রহমান বলেন, এইচএসসি পর্যায়ে পড়াশোনা নানা কারণে ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে, যেটা অনেক অভিভাবকের পক্ষে বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অনেক শিক্ষার্থী কর্মে প্রবেশ করতে বাধ্য হচ্ছেন। আবার অনেকেই কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে যাচ্ছেন। গ্রাম পর্যায়ে বাল্য বিয়ে ও আরেকটি বড় কারণ। ঝরে পড়ার কারণগুলো চিহ্নিত করে সরকারকে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেন তিনি।
শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল কাইয়ুম উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ার কারন সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, এসএসসি ও এইচএসসি পর্যায়ে এই ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ হলো দারিদ্র্য এবং শিক্ষার্থীদের বাল্য বিয়ে হয়ে যাওয়া। এসএসসি পাশের পর অনেক শিক্ষার্থী কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেও বিদেশে চলে যেতে চায়। এটাও ঝরে পড়ার আরেকটি বড় কারণ। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে যুগ উপযোগী শিক্ষা কারিকুলামের অভাব রয়েছে, মাদক ও মোবাইল আসক্তির বেড়ে যাওয়া ও ঝড়ে পড়ার হার বাড়ছে।
চলমান এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড ও বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ডে নিয়মিত-অনিয়মিত মিলিয়ে মোট ১২ লাখ ৫১ হাজার ১১১ পরীক্ষার্থীর অংশগ্রহণের কথা ছিল। পরীক্ষার প্রথম দিন বৃহস্পতিবার মোট ১৯ হাজার ৭৫৯ জন পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিলেন। গত বছর এ পরীক্ষায় প্রথম দিন অনুপস্থিত ছিলেন ১৫ হাজার ২০৩ পরীক্ষার্থী। গত এপ্রিলে অনুষ্ঠিত এ বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ও তুলনামূলক অনুপস্থিতি বেশি ছিল। ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীন এই পরীক্ষার প্রথম দিনে অনুপস্থিত  ছিল ২৬ হাজার ৯২৮ পরীক্ষার্থী। অথচ গত বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় প্রথম দিন অনুপস্থিত ছিল ১৯ হাজার ৩৫৯ পরীক্ষার্থী। 
বর্তমানে প্রত্যেক অভিভাবকই চান, তাঁর সন্তান লেখাপড়া শিখুক। তবে দরিদ্র অভিভাবককে শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিতে হয়। কারণ, ও পরের শ্রেণিগুলোয় শিক্ষার ব্যয় ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। প্রাইভেট-কোচিং, নোট-গাইড, ভর্তি ফি-বেতন, শিক্ষার উপকরণ ইত্যাদি বাবদ প্রচুর খরচ হয়। খরচের এই চাপ সামলাতে পারে না এসব পরিবার। পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হওয়ার কারণেও অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় পাস-ফেলের ব্যবস্থা আছে, তবে কীভাবে শিখন ঘাটতি পূরণ করা যেতে পারে, সে পরিকল্পনা অভাব রয়েছে।
মেয়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার পেছনে এ বয়সেই বাল্যবিবাহ হতে দেখা যায়। অনেক দরিদ্র অভিভাবক মনে করেন, মেয়েকে বিয়ে দিতে পারলেই সমস্যা মিটে যাবে। মেয়ে শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার হার ছেলে শিক্ষার্থীর চেয়ে বেশি। ছেলে সন্তানের ক্ষেত্রে মনে করা হয়, সে পড়াশোনা শেষ করে ভবিষ্যতে চাকরি করে সংসারের হাল ধরবে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে ছেলে শিশুর পড়াশোনা কষ্ট করে চালানো হলেও মেয়ে শিশুর পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করা ও ধরে রাখার জন্য সরকার প্রতিবছর উপবৃত্তিসহ অন্যান্য খাতে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে বই ও খাবার দিচ্ছে। এরপরও এত বেশি শিক্ষার্থী কেন ঝরে পড়ছে, এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। 
কর্মমুখী শিক্ষা চালু করার পাশাপাশি উপবৃত্তির টাকার পরিমাণ ও আওতা বাড়ানো যেতে পারে। বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে। সমাজের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষাকাঠামোর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। শিক্ষকদের অভাব অভিযোগের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে সমাধান করে  শিক্ষকেরা যেন শ্রেণিতে পাঠদানে আর ও মনোযোগী হন, সে বিষয়ে তদারিক করা যেতে পারে। শিক্ষার্থী যে কারণেই ঝরে পড়ুক না কেন, তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য পরিকল্পনা করা দরকার। 
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ, বাগিচাগাও, কুমিল্লা।












সর্বশেষ সংবাদ
সন্ধ্যায় সিদ্ধান্ত নিয়ে সকালে গণপিটুনি, কুমিল্লায় এক পরিবারের তিনজন নিহত
ফজর আলীর ভাই শাহপরানের সম্পৃক্ততা পেয়েছে পুলিশ
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের হাড়াতলীতে ফেলা হচ্ছে বিষাক্ত স্লাজ বর্জ্য
কুমিল্লায় ভেজাল ঘি ও নকল বৈদ্যুতিক তারের বিরুদ্ধে অভিযান, ৪০ হাজার টাকা জরিমানা
কুমিল্লায় পৃথক দুর্ঘটনায় ৩জন নিহত, আহত ২
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
সন্ধ্যায় সিদ্ধান্ত নিয়ে সকালে গণপিটুনি, কুমিল্লায় এক পরিবারের তিনজন নিহত
কুমিল্লার বুড়িচংয়ে দোকানে মিললো টিসিবির ১৪৪২ লিটার তেল
ফজর আলীর ভাই শাহপরানের সম্পৃক্ততা পেয়েছে পুলিশ
বাড়ি ছাড়লেন সেই নারী
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের হাড়াতলীতে ফেলা হচ্ছে বিষাক্ত স্লাজ বর্জ্য
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২