পৃথিবীতে
সবাই শান্তিতে বসবাস করতে চায়। বিশ্বব্যাপি প্রতিদিন যে ব্যাপক কর্মকান্ড
পরিচালিত হয় তার মূলে রয়েছে দিনশেষে শান্তিতে জীবন যাপনের নিশ্চয়তা বিধান
করা। বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই শান্তিপ্রিয়। নিজ দেশে আমরা যেমন শান্তিতে
থাকতে চাই, তেমনি বাংলাদেশ জন্মলগ্ন থেকেই ‘সবার প্রতি বন্ধুত্ব, কারও
প্রতি বৈরিতা নয়’ - এ নীতির আলোকে বিশ্বের যে কোনো অঞ্চলে মানুষের
শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বত্র
শান্তি প্রতিষ্ঠায় অব্যাহত সমর্থন, শান্তি, মানবাধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা,
গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়নসহ মানুষের অগ্রযাত্রাকে
সমর্থন করে। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের অধীনে পরিচালিত শান্তিরক্ষা
কার্যক্রমে বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে আসছে। আন্তর্জাতিক শান্তি ও
নিরাপত্তার নিশ্চিতকরণে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি বাংলাদেশ প্রতিবেশী
রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সহাবস্থান বজায় রেখে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে
ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে।
যুদ্ধ কারো কাংখিত না হলেও, বিভিন্ন
কারনে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে, দেশে দেশে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়।
যুদ্ধ কখনোই ভালো কিছু বয়ে আনে না। পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে যুদ্ধের ভয়াবহতা
কেড়ে নিয়েছে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের প্রাণ, জীবনের তরে পঙ্গু করেছে কত
মানুষকে তার ইয়ত্তা নেই। ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সম্পদের ক্ষতি
হয়েছে। যুদ্ধজনিত করণে অনেক সভ্যতা পৃথিবীর মানচিত্র থেকে বিলুপ্ত হয়ে
গেছে।
বিশ্বের যে সব অঞ্চলে সংঘাত রয়েছে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য,
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। নিরাপত্তা পরিষদ
আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় ১৯৪৮ সালে যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ ও বজায় রাখার
জন্য জাতিসংঘের সামরিক পর্যবেক্ষকদের মোতায়েনের অনুমোদন দেয়। এই অভিযানের
নাম দেওয়া হয়েছিল ‘জাতিসংঘের যুদ্ধবিগ্রহ তদারকি সংস্থা’ - যা জাতিসংঘের
প্রথম শান্তিরক্ষা বাহিনী। জাতিসংঘের ডাকে সাড়া দিয়ে বিশ্বের শান্তি
রক্ষায়, শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের 'ব্লু হেলমেট' নামক শান্তিরক্ষা
মিশনের আওতায় বাংলাদেশ পেশাদারি মনোভাব নিয়ে তার সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের
শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে নিয়োগ করেছে। ১৯৮৮ সাল থেকে শুরু করে বিগত ৩৭
বছরে ২ লক্ষের উপরে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী (সেনা, নৌ ও বিমান) ও পুলিশ
বাহিনীর সদস্য বিশ্বের ৪৩ টি দেশে জাতিসংঘ পরিচালিত ৬৩ টি মিশনে
শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছে। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় এ ধরনের
মনোভাবের কারনে বাংলাদেশ বর্তমানে শান্তি রক্ষা কার্যক্রমে সৈন্য প্রেরণের
দিক থেকে শীর্ষ অবস্হানে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। বিশ্বমন্ডলে বাংলাদেশের
একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরী হয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষায় নারীদের অবদান ও
ভূমিকার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। আর্মড ফোর্সেস ডিভিশনের এক হিসাব
অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ১ হাজার ৭১৮ জন নারী শান্তিরক্ষী
বিভিন্ন মিশনে অংশগ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর ১ হাজার ৫১৩ জন,
নৌবাহিনীর ৫৪ জন এবং বিমান বাহিনীর ১৫১ জন। জাতিসংঘ ২০২৫ সালের মধ্যে
শান্তি রক্ষা মিশনে ২২ শতাংশ নারী স্টাফ অফিসার ও মিলিটারি অবজারভার
নিয়োগের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ১৮ শতাংশ নারী’র
অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে এবং এই হার আরও বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।
১৯৮৯ সালে নামিবিয়া মিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা
কার্যক্রমে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুলিশ। এ পর্যন্ত বিশ্বের ২৪টি দেশের ২৬টি
মিশনে পুলিশের ২১ হাজার ৮১৫ জন শান্তিরক্ষী সদস্য অংশগ্রহণ করেছেন।
বর্তমানে ৩টি দেশে ১৯৯ জন পুলিশ সদস্য শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে নিয়োজিত
আছেন।
শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের অবদানকে স্বীকৃতি দেয়ার উদ্দেশ্যে
সারাবিশ্বে ২৯ মে আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস হিসেবে পালন করা
হয়। বৈশ্বিক শান্তিরক্ষায় বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধপীড়িত দেশে বাংলাদেশি
শান্তিরক্ষী বাহিনীর অকুতোভয় বীর সদস্যরা এক অনন্য ভূমিকা পালন করছে।
কর্মক্ষেত্রে তারা সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের প্রদর্শণের পাশাপাশি আন্তরিকতা ও
সাহসিকতার সম্মিলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। বিশ্বমন্ডলে আমাদের
শান্তিরক্ষী বাহিনী তাদের মানবিক কার্যাবলী, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে
মানুষকে জীবনের স্বাদ ফিরে পেতে সহায়তা করার মাধ্যমে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে
বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
শান্তিরক্ষা
মিশনে বাংলাদেশের দক্ষতা ও কর্মক্ষমতার ব্যাপক সুনাম রয়েছে। শান্তিরক্ষীরা
যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে মিশনগুলোতে সাধারণ মানুষের জীবন রক্ষা করা, নারী ও
শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং শরণার্থী ও বাস্তুচ্যুত মানুষদের
সহায়তায় কাজ করে। অবস্থানভেদে দুই পক্ষের মধ্যে অস্ত্রবিরতির শর্ত মানা
হচ্ছে কি না, তা নজরে রাখা, যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘিত হলে রিপোর্ট করা, সাবেক
যোদ্ধাদের অস্ত্র জমা নেওয়া, তাঁদের সমাজে পুনঃস্থাপন করা এবং সমাজে শান্তি
ও আস্থা ফিরিয়ে আনার কাজ করে। কখনো কখনো স্থানীয় পুলিশ ও বিচারব্যবস্থাকে
প্রশিক্ষণ ও সহায়তায় কাজ করে। অনেক ক্ষেত্রে স্কুল, হাসপাতাল, রাস্তা
ইত্যাদি অবকাঠামো নির্মাণেও অংশগ্রহণ করেন শান্তিরক্ষীরা। এসব কাজ করতে
গিয়ে তাঁদের নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যেও পড়তে হয়। বিশ্ব পরিমন্ডলে পরম
আরাধ্য শান্তিরক্ষা ও প্রতিষ্ঠার মতো বিপদসংকুল, সংঘাতপূর্ণ ও প্রতিকূল
পরিস্থিতিতে নিজের জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালনকালে এ পর্যন্ত ১৬৮
জন বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী প্রাণ হারিয়েছেন (যার মধ্যে সেনাবাহিনীর ১৩১ জন,
নৌ বাহিনীর ৪ জন, বিমানবাহিনীর ৯ জন ও পুলিশের ২০ জন)। এ ছাড়াও ২০০ এরও
অধিকজন আহত হয়েছেন।
জাতিসংঘের অভিযানে বাংলাদেশি সৈন্যদের সবচেয়ে বড়
সম্পদ স্থানীয় জনগণের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা
স্বাগতিক দেশের জনগণের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক বজায় রাখতে সর্বদা সচেষ্ট
থাকে। এ দেশের শান্তিসেনাদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ও কাজ, মানবিক গুণাবলি,
শৃঙ্খলা এবং স্থানীয় জনগণের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এই সুনামের পেছনে
সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশ
মৈত্রী স্কুল, বাংলাদেশ সেন্টার। অনেক দেশে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের এখন
বীর হিসেবে দেখা হয়। শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষীদের ভালোবাসায়
সিক্ত হয়ে আইভরি কোস্ট এবং সিয়েরা লিওন বাংলা ভাষাকে সেসব দেশের দ্বিতীয়
রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান করেছে, যা পুরো জাতির জন্য সম্মানের এবং
গর্বের। অন্যদিকে শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে শন্তিরক্ষীরা
বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান
রাখছেন। বর্তমানে, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মোতায়েনের মাধ্যমে জাতির জন্য ২
হাজার কোটিরও বেশি টাকা রেমিট্যান্স এনেছে। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা বিশ্বে
সর্বত্র দক্ষতা ও পেশাদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশের ইতিবাচক
ভাবমূর্তি তৈরিতে সাহায্য করেছেন এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক
জোরদারে ভূমিকা রাখছেন। শান্তিরক্ষা কূটনীতি এখন জাতীয় কূটনীতির অংশ হয়ে
দাঁড়িয়েছে। প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি শান্তিরক্ষীই বিদেশে বাংলাদেশের শান্তিদূত
হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন।
সংঘাত ও যুদ্ধ কখনই কোনো জাতির জন্য উপকারী
হতে পারে না। শান্তি বজায় রাখতে হলে যুদ্ধ ও সংঘাত বন্ধ করতে হবে। জাতিসংঘ
জন্মলগ্ন থেকেই বিশ্বশান্তি, মানবকল্যাণ ও সমৃদ্ধির জন্য নিরলসভাবে কাজ করে
যাচ্ছে। জাতিগত, দেশে দেশে যেখানেই যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়, জাতিসংঘে
কূটনৈতিক পদক্ষেপে তা নিরসনের জোর প্রচেষ্টা চালায়। বিশ্বব্যাপী ' টেকসই
উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০' অর্জনে জাতিসংঘের যে প্রচেষ্টা তা মূলতঃ
বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠারই অংশ। আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য একটি
সুখী সমৃদ্ধশালি, শান্তিময়, টেকসই ও নিরাপদ বিশ্ব গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয়ে
আমাদের যার যার অবস্থান থেকে কাজ করে যেতে হবে। আসুন সবাইকে নিয়ে, সবার
জন্য শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়ে তুলতে সচেষ্ট হই। আগামী প্রজন্মের জন্য
বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখি।
লেখকঃ পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত।