মঙ্গলবার ১ জুলাই ২০২৫
১৭ আষাঢ় ১৪৩২
বায়ুদূষণে বাংলাদেশ এবং স্বাস্থ্যঝুঁকির উচ্চমাত্রা
ড. এম এ ফারুখ
প্রকাশ: রোববার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫, ১:১০ এএম আপডেট: ০৭.০৩.২০২৫ ২:০৯ এএম |

 বায়ুদূষণে বাংলাদেশ এবং স্বাস্থ্যঝুঁকির উচ্চমাত্রা
বাংলাদেশে বায়ুদূষণ একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান ও গবেষণার আলোকে এই সমস্যার গভীরতা ও এর প্রতিকার নিয়ে বিষদ আলোচনা করা অতি প্রাসঙ্গিক। আইকিউএয়ারের ২০২৩ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। এ দেশের বাতাসে পিএম ২ দশমিক ৫-এর গড় উপস্থিতি প্রতি ঘনমিটারে ৭৯ দশমিক ৯ মাইক্রোগ্রাম, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানের চেয়ে প্রায় ১৬ গুণ বেশি। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে বায়ুদূষণের মাত্রা অত্যন্ত বেশি। ২০২৩ সালে নয়াদিল্লির পরেই ঢাকা দ্বিতীয় দূষিত বায়ুর শহর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যেখানে পিএম ২ দশমিক ৫-এর মাত্রা ছিল ৮০ দশমিক ২ মাইক্রোগ্রাম। একই বছর পাকিস্তান ও ভারতে পিএমের মাত্রা ছিল যথাক্রমে ৭৩ দশমিক ৭ ও ৫৪ দশমিক ৪ মাইক্রোগ্রাম। ২০২২ সালে বিশ্বে দূষিত বায়ুর দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পঞ্চম অবস্থানে এবং ভারত অষ্টম অবস্থানে ছিল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, বাতাসে পিএম ২ দশমিক ৫-এর মাত্রা ৫ মাইক্রোগ্রামের অধিক হওয়া উচিত নয় এবং প্রবহমান বাতাসে এর মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি সরাসরি ফুসফুস ও রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে থাকে। ২০২৩ সালে শুধু অস্ট্রেলিয়া, এস্তেনিয়া, ফিনল্যান্ড, গ্রানাডা, আইসল্যান্ড, মরিশাস ও নিউজিল্যান্ড বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড বজায় রাখতে পেরেছিল। বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, ঢাকা ও শিল্পনগরী গাজীপুরে বিদ্যমান বাতাসের গুণগত মান ২০২১ বা ২০২২ সালের কোনো একটি মাসেও ‘ভালো’ স্কোরে ছিল না। বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। ২০২৪ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বায়ুদূষণের কারণে এ দেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় পাঁচ বছর কমে গেছে। বিশেষ করে শিশুদের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রণীত সর্বশেষ ২০২১ সালের গ্লোবাল এয়ার কোয়ালিটি নির্দেশিকা অনুযায়ী বাংলাদেশের জাতীয় গড় দূষণ পরিমাপ করে অনুমান করা হয় যে দূষণের কারণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৪ দশমিক ৮ বছর কমে গেছে। বিশেষ করে ঢাকার নিকটবর্তী জেলা গাজীপুর ও নরসিংদীতে গড় আয়ু হ্রাসের পরিমাণ ছয় বছরেরও বেশি। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে শিশুদের মধ্যে বায়ুদূষণজনিত রোগের প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে, যা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। দ্রুত নগরায়ণ, অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজ এবং পরিবর্তিত জলবায়ুর প্রভাবে তীব্র শ্বাসযন্ত্রের রোগ বেড়েই চলছে, সেই সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে অর্থনৈতিক ব্যয়ভার। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে পরিবেশগত কারণে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের অকালমৃত্যু ঘটেছে, যার মধ্যে বায়ুদূষণ ৫৫ শতাংশ অকালমৃত্যুর জন্য দায়ী।
বাংলাদেশে পুরোনো ও অপরিচ্ছন্ন যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া বায়ুদূষণের একটি বড় উৎস। এ ছাড়া ইটভাটা ও বিভিন্ন শিল্প-কারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া বায়ুদূষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। নগরায়ণের কারণে চলমান নির্মাণকাজ ও রাস্তার ধুলো বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে। পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে আবর্জনা ও প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বায়ুতে বিষাক্ত কণার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ ৬৮ হাজার নিবন্ধিত যানবাহনের ফিটনেস সনদ ছিল না।
পুরোনো যানবাহনে অসম্পূর্ণ জ্বালানি দহনের কারণে বেশি দূষণ ঘটে থাকে এবং পুরোনো যানবাহন থেকে বিপজ্জনক বায়ুদূষণকারী নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়। ‘দ্য স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার-সাউথ এশিয়া’ তাদের ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে এক গবেষণায় বলেছে, ঢাকার বাতাসে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড-এর ক্রমবর্ধমান ঘনত্ব এখন ঢাকাবাসীর জন্য গুরুতর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, গ্রামের ৭৭ শতাংশ পরিবার এখনো রান্নার জন্য পাতা, কাঠ, শুকনো গোবর ইত্যাদি ব্যবহার করে, যা গ্রামীণ এলাকায় বায়ুদূষণের প্রধান উৎস।
বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশবান্ধব যানবাহন যেমন, ইলেকট্রিক ও হাইব্রিড যানবাহনের ব্যবহার বৃদ্ধি করা এবং পুরোনো যানবাহনের নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করা অতি আবশ্যক। শিল্প-কারখানায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্গমন কমানো এবং নিয়মিত মনিটরিং করা জরুরি। নির্মাণকাজের সময় ধুলো নিয়ন্ত্রণে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং পরিবেশ সুরক্ষায় জনগণকে উৎসাহিত করার কোনো বিকল্প নেই। আন্তর্দেশীয় বায়ুদূষণ সমস্যার সমাধানে দেশের ভেতর ও বাইরে উভয় ক্ষেত্রেই উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। সর্বোপরি, বায়ুদূষণ বাংলাদেশের জন্য একটি জটিল সমস্যা; যার সমাধানে সরকার, শিল্প খাত ও সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। পরিবেশ সুরক্ষা, দূষণরোধ ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের জন্য দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য।
লেখক: অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ













সর্বশেষ সংবাদ
ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়াই ছিলো নিপীড়নকারীদের উদ্দেশ্য?
পর্নোগ্রাফি মামলার আসামিদের রিমান্ডে চায় পুলিশ
কুমিল্লায় প্রকৃতি ও জীবন ক্লাবের উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের মাঝে গাছের চারা বিতরণ
সেনাবাহিনীর অভিযান কুমিল্লায়৩ হাজার ইয়াবা ও ৩০ লাখ টাকাসহ আটক ১
এবি পার্টি মহানগরের উদ্যোগে চাউল বিতরণ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
চালের ড্রাম ছিলো ৩ হাজার ইয়াবা ও ৩০ লাখ টাকা; জব্দ করল সেনাবাহিনী
লালমাইয়ে দুই মাদকসেবীকে সাজা
কে এই ফজর আলী
অভিযুক্ত ফজর আলীসহ গ্রেপ্তার ৫
নির্মাণাধী ভবনে রাজমিস্ত্রীর হাত-পা বাঁধা লাশ
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২