বৃহস্পতিবার ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫
৪ পৌষ ১৪৩২
প্রগতির প্রতিকৃতি
জুলফিকার নিউটন
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১২:২৪ এএম আপডেট: ১৮.১২.২০২৫ ১:১৮ এএম |

 প্রগতির প্রতিকৃতি

চিন্তানায়ক শান্তিরঞ্জন ভৌমিকের চিন্তার মধ্যে কোন অন্ধকার শব্দ নেই। তিনি ভাবেন আলোর মতো, যে আলো সব অন্ধকার দূর করে দেয়। তিনি সারা জীবন জিজ্ঞাসার মধ্যে বসবাস করেছেন, যাতে সকল সমালোচনা উদ্ভাসিত হয়। তিনি কোন রাজনৈতিক তত্ত্ব প্রচার করেননি, কিংবা কোন মতাদর্শিক পুরুষ হিসেবে দেখা দেননি। তিনি প্রচারক নন। বরং বিপরীত তাঁর ভূমিকা: তিনি শিক্ষক দর্শক, বিশ্লেষক এবং ঘটনামাত্রার বর্ণনাকারী। তাঁর জীবনের লক্ষ্য জানা। তাঁর অন্বেষার উদ্দেশ্য জগৎ-সংসার সম্বন্ধে অনিৎশেষ বহুবাদিতা স্পষ্ট করা। সে জন্য কি তিনি বিভিন্ন গ্রন্থের লেখনীর মধ্যে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন? এক্ষেত্রে তিনি ব্যবহার করেছেন তাঁর নিরাসক্ত ব্যক্তিবাদ, যুক্ত করেছেন তাঁর হৃদয়ের ও মননের উষ্ণ সারা, এ সবই মানুষী অবস্থার স্থিতিশীলতা তৈরি করার দিকে তাঁর অভিযান। বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠ করার মধ্য দিয়ে তিনি পৌঁছেছেন বিভিন্ন গন্তব্যে, একাধিক জীবনচর্যায়। এখানেই তাঁর মানস গতিতের রহস্য: তাঁর বুদ্ধিবাদিতার কেন্দ্রে জ্বলজ্বল করেছে হীরকের দ্যুতি, বিভিন্ন গ্রন্থ তিনি পাঠ করেছেন, আর আমাদেরকেও তিনি পাঠ করতে শিখিয়েছেন জীবনচর্যার বহুবাদিতা। সে জন্য তাঁর সাহিত্য কর্ম অপ্রতিরোধ্য। যেন তিনি হাসতে হাসতে বলেছেন: দ্যাখো দ্যাখো জীবনে কত কিছু শেখার আছে।
আমাদের সময়টা সঙ্কীর্ণ ডগমায় ভরপুর হয়ে আছে। আমাদের ডগমা ছাড়িয়ে যেতে হবে। আমাদের হতে হবে মুক্ত পুরুষ। সেই বিশ্বাস থেকে শান্তিরঞ্জন ভৌমিক স্পষ্ট, ঋজু শানিত পুরুষ হয়ে উঠেছেন। তিনি যা ভাবেন তা বলেন, যা বলেন তা লিখেন আর লেখার সঙ্গে, ভাবনার সঙ্গে তিনি যুক্ত করেছেন একঝাঁক তরুণকে। কারণ তরুণারাই সমাজটাকে, রাষ্ট্রটাকে বদলাবার অধিকারী। এই বিশ্বাস থেকে তিনি ঋদ্ধ ও শাণিত হয়ে উঠেছেন: চিরন্তন মানবিক সমস্যার হয়ত কোন সমাধান নেই, কিন্তু লড়াই তো করে যেতে হবে। যৌবনে তিনি সাম্যবাদী চিন্তার সংস্পর্শে এসেছেন, সেখান থেকে তিনি সরে যাননি। যে কোন অবস্থায় আমাদের লড়াই করে যেতে হয়, লড়াই ছাড়া চিন্তা শাণিত করা যায় না, শাণিত চিন্তা ছাড়া সমাজ ও রাষ্ট্র বদলের ভাবনা ছড়িয়ে দেয়া যায় না। সার্থক হওয়াটা বড় নয়, লড়াই করাটা বড়। সে জন্য তাঁর চিন্তা অমোঘভাবে মানবিক হয়েছে আর মানবিক হওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি স্পর্শ করেছেন আকাশ।
শান্তিরঞ্জন ভৌমিকের মধ্যে দেখি বুদ্ধি আর কল্যাণবোধ একসঙ্গে মিলেছে। এই দুইয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আমি কখনোই খুব নিশ্চিন্ত নই। বুদ্ধি খাপখোলা তলোয়ারের মতো, খুব নৈর্ব্যক্তিক। নিষ্ঠুরতার সঙ্গে, আক্রোশের সঙ্গে, বিদ্বেষ বা দখলদারিত্বের সঙ্গে তা যে কখনোই যায় না, তা নয়। বরং দুর্ভাগ্যের কথা, একটু বেশিই যায়। পৃথিবীতে বুদ্ধিমান নিষ্ঠুর কিংবা নিষ্ঠুর বুদ্ধিমান যথেষ্ট দেখা গিয়েছে, আজও যায়। বরং তাদের সংখ্যাই বেশি। সেজন্যেই ভাবি, বুদ্ধির সঙ্গে কল্যাণ কিংবা নৈতিকতার যোগ কি সম্ভবই নয়? শান্তিরঞ্জন ভৌমিককে দেখলে মনে হয়, তা সম্ভব হয়েছে। এই মানুষটি কল্যাণমুখী বুদ্ধির অধিকারী। মৃদু প্রসন্ন হাসিটি তাঁর বুদ্ধির গায়ে লেগেই থাকে। বড় স্নিগ্ধ তাঁর ব্যক্তিত্বের আভা, অনেকটা দূর পৌঁছায় সেই আভা, বিক্ষোভের জালা জুড়িয়ে দেয়, সংকটে-বিপদে অভয় মেলে, কঠিনকে অজান্তেই সহজ করে দেয়। তাঁর বুদ্ধি-যুক্তি সামাজিকভাবেই ধাতস্থ। আমি স্থিরনিশ্চয় যে নৈতিকতার ঔজ্জ্বল্যেই তাঁর বৃদ্ধির ঔজ্জ্বল্য।
যদি বলি আমরা শান্তিরঞ্জন ভৌমিকের অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি, তাহলে খুব বেশি ভুল বলা হবে না। তাঁর সৌজন্যে অভ্যস্ত, তাঁর সহৃদয়তায় অভ্যন্ত। তাঁর নীরব দার্জ আর অনুষ্কার সাহসিকতায় অভ্যস্ত। শোষণে-পীড়নে দলিত মথিত মানুষের কাছে তাঁর নিত্য উপস্থিতিতে অভ্যস্ত। এক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক পরিমণ্ডলে আমরা এমনই অভ্যন্ত যে প্রয়োজন পড়লেই ছুটে যাই সেখানে; আর বুঝতে পারি ওখানে স্থানাভাব নেই।
কবে শান্তিরঞ্জন ভৌমিককে প্রথম দেখেছি এখন আর মনেও পড়ে না। মনে হয় তাঁকে তো বরাবরই দেখে আসছি। আরও মনে হয় শুধু আমি কেন কুমিল্লাবাসীসহ পুরো দেশই তাঁকে দেখে আসছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে, আন্দোলনে, সংগ্রামে, রাষ্ট্রবিপ্লবে। পিছুটান কখনোই দেননি। তিনি মহাভারতের অর্জুনের মতো সবাই তাঁকে ভালোবাসে, শক্তি আর আশীর্বাদ দিয়ে অভিষিক্ত করে। এই সৌভাগ্য তাঁর ছাত্রজীবন থেকে। কিন্তু একইসঙ্গে একথাও সত্য যে, আজ আমরা যে সৎ ও সত্য মানুষটাকে দেখছি, তাঁকেও বড় কঠিন দামে, বিপরীত ও বিষম স্রোত ঠেলে, হয়ে উঠতে হয়েছে। এই কথাটি ভোলার নয়। মনে হয়, শান্তিরঞ্জন ভৌমিকের মৃদু ও শান্তভাব, তাঁর বিনয় ও সৌজন্য আমাদের এতটাই মোহিত করে ফেলে যে তাঁর স্বভাবের অন্যদিকটা, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের আগুন লোহার সংহত দিকটা যেন আমাদের চোখে পড়তে চায় না। তাঁর প্রতিবাদ যুক্তিনির্ভর, সেজন্যে উচ্চকণ্ঠ নয়। কারণ সবাই জানে যুক্তির সঙ্গে বুদ্ধির সম্পর্ক আছে, গলাবাজির সঙ্গে তাঁর তেমন সম্পর্ক নেই। অন্যদিকে প্রতিরোধ প্রধানত কর্ম-নিয়ন্ত্রিত, বাকচাতুর্য তাকে শক্তিহীনই করে ফেলে। শান্তিরঞ্জন ভৌমিক যখন প্রতিবাদ করতে গেছেন, এমনকি প্রতিরোধও করেছেন, তখনও মুখের মৃদু হাসিটি বিসর্জন দেননি, হারিয়ে ফেলেননি তাঁর মালিন্যহীন রসবোধ। শাস্তিরঞ্জন ভৌমিকের লেখা পড়লেই বোঝা যায় রসবোধই মৌলিকভাবে জীবনবোধ। বাংলাভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি, সারা পৃথিবীর যে কোনো দেশের যে কোনো ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে একই সমতলে দাঁড়ানো বাংলাদেশের অতি সাধারণ মানুষটির পাশে তিনি দাঁড়াবেন, হাড় দেবেন না এতটুকু, বোধহয় প্রাণটিকে দিয়ে দিতেও পিছপা হবেন না কিন্তু মুখের হাসিটি ত্যাগ করে নয়। শুরু থেকেই এইভাবে গত হয় দশক ধরে তিনি গড়ে তুলেছেন তাঁর নিজস্ব প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ইতিহাস। এই ইতিহাস কখনো বদলায়নি তার নিজস্ব চরিত্র- শুধু দেশকাল ঘটনাপ্রবাহের পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাতে যোগ হয়েছে নতুন নতুন নানা মাত্রা। কখনো বাংলাভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কখনো বাঙালি জাতিসত্তা, কখনো রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, তারপর বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামের শেষ লক্ষ্য-মুক্তিযুদ্ধ- সংগ্রামের এইসব নানা মাত্রায় শান্তিরঞ্জন ভৌমিকের নিজস্ব কর্মজগৎটি আজ পূর্ণ ঋদ্ধ।
শান্তিরঞ্জন ভৌমিকের আদর্শ ও জীবনকর্ম আমাদের গর্বিত করে। দেশের প্রগতিশীল আন্দোলনের অন্যতম অগ্রবর্তীজন শান্তিরঞ্জন ভৌমিকের অর্জনের ঝুলি পূর্ণ। দেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অনেক দায়িত্বভার তাঁর ওপর বর্তেছে এবং সব ক্ষেত্রেই তিনি নিষ্ঠার পরিচয় দিয়ে কর্মযজ্ঞ চালিয়েছেন, সম্পন্ন করেছেন দায়িত্ব। শান্তিরঞ্জন ভৌমিক সৃষ্টিশীলতা-সৃজনশীলতার পথে হেঁটে গেছেন দৃঢ়-দৃপ্ত পায়ে। একজন গুণী মানুষের পূর্ণাঙ্গতা নিয়ে তিনি যে আলো ছড়িয়ে গেছেন তা আমাদের যুগ যুগ অনুপ্রাণিত করবে। মুক্তচিন্তক, বহুত্ববাদী, সংস্কৃতজন, ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক-বাহক ও প্রগতিশীল চিন্তাল্লাত এই জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবানকে আমরা যত বেশি চর্চায় রাখব ততই সমৃদ্ধ হবো।

সাহিত্যে আমরা জীবনের গানই শুনতে পাই। কেননা সাহিত্যের উৎসই হচ্ছে জীবন। জীবনের ভাব-চিন্তা-প্রয়াসই অভিব্যক্তি পায় সাহিত্যে। জীবনের গান অবশ্য সুর-তাল-লয়ে ও বক্তব্যে বিচিত্র। কারণ জীবনে রয়েছে আনন্দ ও যন্ত্রণা, ভয় ও ভরসা এবং আশা ও নৈরাশ্য। যেখানে বিকার সেখানেই
বিচলন। এই বিচলন থেকেই আসে গানে-গাথায়, গল্পে-উপন্যাসে, কাব্যে-নাটকে, রম্য-রচনায় ও প্রবন্ধে বিচিত্র সুরে জীবনের শ্রেয় ও প্রেয়, উল্লাস ও বেদনা, প্রয়োজন ও সমস্যা প্রকাশ পায়।
সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো প্রবন্ধ সাহিত্যের আবেদন পরোক্ষ নয়। উচ্ছ্বাস, কল্পনা এবং অলৌকিকতার ভার প্রবন্ধ সাহিত্য সয় না বলেই বাস্তব জীবন-প্রতিবেশে উদ্বৃত্ত ভাব ও চিন্তা, তত্ত্ব ও তথ্য, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, সম্পদ ও আপদ, প্রয়োজন ও সমস্যা, কল্যাণ ও দুর্ভোগ প্রভৃতিই প্রবন্ধ সাহিত্যের বিষয়। অতএব দুনিয়ার যাবতীয় ভাব ও বস্তুই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় হতে পারে, যা গল্প-উপন্যাস কিংবা নাটক-কবিতার আঙ্গিকে সম্ভব নয়।
আমাদের ভাষায়ও প্রবন্ধ বিভিন্ন বিষয় উপজীবী। বিজ্ঞান-দর্শন-ইতিহাস, রাষ্ট্র-সমাজ-ধর্ম, সাহিত্য-শিল্প-বাণিজ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি-ভাষা, রীতি-নীতি-আদর্শ প্রভৃতি চিরন্তন ও সাময়িক সব বিষয়েই অল্প-বিস্তর রচনা চোখে পড়ে। যদিও গুণগত কিংবা সংখ্যাগত দৈন্য আজো ঘোচেনি।
যেহেতু সমকালীন দৈশিক ও জাতিক জীবনের আনন্দ ও উদ্বেগ, প্রয়োজন ও সমস্যা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, ইতিহাস ও দর্শন, শিক্ষা ও সম্পদ ধর্ম ও রাষ্ট্র প্রভৃতি সম্বন্ধেই প্রবন্ধগুলো লেখা হয়, সেহেতু প্রবন্ধ সাহিত্য নাগরিক চেতনারই প্রসূন এবং তাই প্রবন্ধ সাহিত্যে দেশের শিক্ষিত মননশীল কল্যাণকামী মানুষের বিদ্যা-বুদ্ধি, জ্ঞান-প্রজ্ঞা, মন-মনন রুটি-সংস্কৃতি, আদর্শ-উদ্দেশ্য, ভাব-চিন্তা প্রভৃতি প্রতিবিম্বিত হয়।
এ কারণেই প্রবন্ধ সাহিত্যে দেশগত ও কালগত জীবনের ভাব-চিন্তা-কর্মের প্রতিচ্ছবি যতটা পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে, এমনটি গানে-নাটকে-কবিতায় কিংবা কথা-সাহিত্যে কখনো সম্ভব হয় না। প্রবন্ধ সাহিত্যেই বিশেষ দেশের ও কালের মানুষের জীবন-দৃষ্টির একটি সামগ্রিক পরিচয় মেলে। এ জন্যে সাহিত্যের জাতীয় রূপ প্রবন্ধ সহিত্যেই থাকে সুপ্রকট। স্থানিক ও কালিক প্রতিবেশ, শৈক্ষিক যোগ্যতা, নৈতিক চেতনা, আর্থিক অবস্থা সাংস্কৃতিক মান, সামাজিক পরিবেশ, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, ধার্মিক প্রত্যয়, আদর্শিক প্রেরণা প্রভৃতির সামষ্টিক প্রভাবে ও প্রতিক্রিয়ায় গড়ে উঠে যে-মন ও রুচি এবং যে-প্রবণতা ও অভিপ্রায়, তা-ই অভিব্যক্তি পায় প্রাবন্ধিকের রচনায়। প্রজ্ঞা, চিন্তা, যুক্তি, তথ্য, তত্ত্ব ও সামগ্রিক জীবন-দৃষ্টি প্রবন্ধ সাহিত্যের প্রাণ বলেই লেখকের ব্যক্তিত্ব ঐ প্রবন্ধের প্রাণ বায়ু।” সুলিখিত প্রবন্ধ বুদ্ধিকে জাগ্রত ও তৃপ্ত করে এবং জ্ঞান ও বিচারকে দেয় প্রাধান্য। সব প্রবন্ধ সাহিত্য হয় না। পাকা লিখিয়ের হাতেই প্রবন্ধ সাহিত্য-শিল্প হয়ে ওঠে জ্ঞান-যুক্তি প্রয়োগ-পরিবেশনের দুর্লভ নৈপুণ্যে।
সমকালীন বাংলায় শান্তিরঞ্জন ভৌমিকের প্রকাশিত গ্রন্থঃ বাংলা সাহিত্যে বিহারীলাল (১৯৯৯), নজরুলের উপন্যাস (১৩৯৯), নজরুলের বিদ্রোহী (১৪১২), আমি শচীনকর্তা (২০১৮), অন্তর্লোকে আপনজন (২০০২), নজরুল চর্চা: প্রসঙ্গ কুমিল্লা (২০০৩), নজরুল ও প্রমীলা-পরিবার (২০০৫), চিঠিপত্রে নজরুল (২০১৪), অঞ্জলি লহ মোর (২০১৪), নজরুল ও কুমিল্লা (২০২১), কুমিল্লায় রবীন্দ্রনাথ (২০০৩), রবীন্দ্র পরিক্রমা (১৪১৮), বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ (২০২০), শক্তিধর বঙ্গবন্ধু (২০২০), কুমিল্লার উপভাষা পরিক্রমা (২০১৮), ফয়জুন্নেসার রূপজালাল (২০২২), আমি নজরুল, (২০১৭), যুবরাজ যখন কুমিল্লায়, (১৪২২), নজরুল ও প্রমীলা পরিবার, (২০০৫), নজরুল-চর্চা: প্রসঙ্গ কুমিল্লা (২০০৩), পান্থজনের সখা, (১৪২২), নজরুলের বিদ্রোহী, (২০০৫), নজরুলের উপন্যাস, (১৯৯২), চিঠিপত্রে নজরুল (১৪২১) নজরুল সন্ধানে (১৪১৫), সমকালে রবীন্দ্র-নজরুল (২০০৭), নজরুল কথন, (১৪১৩), শতবর্ষ আগে কুমিল্লায় নজরুলের আগমন: (২০২১), নজরুলের নার্গিস ও প্রমীলা (নাটক) রবীন্দ্র-পরিক্রমা (১৪১৮), ত্রিপুরার রাজন্যবর্গ ও রবীন্দ্রনাথ, (২০০১), ভানুসিংহের কুমিল্লা আগমন, (১৪২২), কুমিল্লায় রবীন্দ্রনাথ, (২০০৩), মহাকবি কালিদাস (২০১০), অন্তর্লোকে আপনজন (২০০২), চর্যাপদ পরিচয়, (১৯৯১), বৈষ্ণব পদাবলী পরিচয়, (১৯৯১), প্রাচীন ও মধ্যযুগের কাব্য, (২০০২) সাহিত্য সুহৃদ (১৯৭৩), বাংলা ছন্দ ও সাহিত্যতত্ত্ব, (১৯৭৪), বাংলা রূপ-রস-অলংকার-ছন্দ, (২০০৩), কাছের মানুষ নিজের কথা (২০০৭), তুচ্ছ কথা, (২০০৮), আপনবোধে দেখা, (২০১১), আমার যতকথা (২০১২), ফিরে দেখা আমার কুমিল্লা (১৪১৯), অবুঝ মনের কথা (২০১৬), আমার শহর কুমিল্লা (২০২২), ঐতিহ্যের ঠিকানা: কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ (২০২১), একজীবনে আত্মজীবনী (১৪২৫), সময়ের বহতা নদী (২০২১), অবলোকন: ব্যক্তি (২০২২), অন্তর্গত অনুসন্ধান (২০২২), উপলব্ধি ও বিশ্বাস, কথা ও কবিতা (১৪১৫), বৃহত্তর কুমিল্লার নীতিমান ও কীর্তি (২০১৩), ঝরা পাতা (১৪৩০), দেখা মানুষ (১৪৩০), দক্ষিণ দুয়ার খোলা (১৪৩১), খেরো খাতা (২০২৫), প্রভৃতি গ্রন্থাবলী বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য হয়ে উঠেছে।
শান্তিরঞ্জন ভৌমিক কখনই নিছক লেখক নন, তার চেয়ে বড়, তিনি সমাজ সংস্কারক; না তার চেয়েও বড়, সাহিত্যশাস্ত্রী, চিন্তা নায়ক ও বিদগ্ধ বিবেক। জীবন, শিল্প, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি নানা বিষয় নিয়ে ভাবেন তিনি, লেখেন তিনি, তার ভাবনা চিন্তাকে জীবনের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করেন তিনি। আশি বছরে যতটা কাজ তিনি করেছেন তার মূল্য স্বীকৃতভাবে প্রচুর ও সুস্থায়ী। ব্যপ্তিতে, বৈশদ্যে, পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষনে, প্রতিপাদ্যের মৌলিকতায়, বিন্যাসের সংযুক্তি ও মননের সুবেদী ক্ষিপ্রতায় শান্তিরঞ্জন ভৌমিকের প্রবন্ধাবলী বাংলা সাহিত্যে প্রায় তুলনাহীন।
শান্তিরঞ্জন ভৌমিকের প্রবন্ধ সাহিত্য অসাধারণ রুচি, বুদ্ধি, যুক্তি, মনন, মনস্বিতা ও ব্যক্তিত্বের প্রকাশ। এই মনন কোন নীরস, নির্জীব, খন্ড উপাদান মাত্র নয়, তা এক অদ্ভুত সরসতা, সপ্রাণতা ও সৃষ্টিশীলতায় স্পন্দিত। শান্তিরঞ্জন ভৌমিক রাজনৈতিক ভাবে, অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে, নান্দনিকভাবে সমস্ত দিক থেকেই একজন মুক্তলেখক, ঋৎবব ডৎরঃবৎ। আর দার্শনিকদের মতে ঋৎববফড়স রং ৎবংঢ়ড়হংরনরষরঃু। শান্তিরঞ্জন ভৌমিকর প্রবন্ধে সেই দায়িত্বেরই প্রতিফলন ঘটেছে। যদিও আনন্দময় লেখা যে হাত দিয়ে হয়েছে সেই হাতে আর কিছু লিখতে সাধ হয় না, তবুও কর্তব্যপ্রসূত লেখা লিখে ওঠাই অনেক সময় হয়ে ওঠে মুখ্য কাজ। রাজনীতি নিয়ে আর কিছু লিখতে অ্যালার্জিক বোধ হলেও রাজনীতি নিয়েই লিখতে হয়। জাতীয় জীবন এখন এত জটিল হয়ে পড়েছে যে, তা নিয়ে লেখা নিছক সাহিত্যিকের কর্ম নয়, তার জন্য কিছুটা সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিকও হতে হয়। শাস্তিরঞ্জন ভৌমিক তা অনেকাংশে হতে পেরেছেন। এই ব্যাপক ও দূর প্রসারী দৃষ্টিভঙ্গিীর জন্যই লেখকের অনেক সমসাময়িক প্রবন্ধও যুগোত্তীর্ণ হতে পারে।

গল্প-কবিতা-উপন্যাস-নাটকের মতো প্রবন্ধ-নিবন্ধেরও একটা লাক্ষণিক সংজ্ঞা রয়েছে বটে, তবে সে সংজ্ঞায় প্রবন্ধের পরিচিতি প্রকৃষ্ট হয়ে ওঠে না। তার কারণ সৃষ্টিশীল বা সৃজনমূলক রচনা ছাড়া অন্য সব গদ্য রচনাই প্রবন্ধ-নিবন্ধ লক্ষণাত্মক, এমন কি চিঠিপত্র এবং রম্য রচনাও। এক অর্থে বিভিন্ন বিষয়ক গ্রন্থও প্রবন্ধ সমষ্টি মাত্র। পৃথিবীতে হেন বিষয় নেই যা প্রবন্ধে আলোচ্য নয়। আবার প্রবন্ধের রকমফেরও রয়েছে। যেমন ভাবমূলক, বর্ণনামূলক, বিবৃতিমূলক, বিশ্লেষণ বা মূল্যায়নমূলক। তত্ত্ব ও তথ্যভিত্তিক বৈষয়িক, রাজনীতিক, অর্থনীতিক, শৈক্ষিক, সামাজিক, শাস্ত্রিক, নৈতিক, দার্শনিক, ঐতিহাসিক, বৈজ্ঞানিক, আধ্যাত্মিক, মনস্তাত্ত্বিক, সাহিত্যিক, সম্পাদকীয় প্রভৃতি স্বল্প পরিসরের সর্বপ্রকার ক্ষুদ্র ও খণ্ড রচনাই প্রবন্ধ।
তবে অনুভবের স্থূলতায়, ভাষার দৈন্যে, উপলব্ধির অপূর্ণতায়, মননের হ্রস্বতায়, মন-মত-মন্তব্যের তুচ্ছতায় ও যুক্তি-বুদ্ধির অপপ্রয়োগে মানে-মাপে-মাত্রায় অকিঞ্চিৎকর হওয়ায় অনেকের লেখাই পাঠযোগ্য হয় না। গুরুত্ব নেই বলে সেসব আলোচনার যোগ্যও নয়। তার পরেও জীবনদৃষ্টি এ শ্রেয়োবোধ প্রসূত মতে-মন্তব্যে পার্থক্য ও অবহেলা করা যায় না। তাই প্রবন্ধ-সাহিত্যের রচনা যেমন, তেমনি পরিচিতি আর মূল্যায়নও কখনো ব্যক্তির জ্ঞান-প্রজ্ঞা-যুক্তিবুদ্ধি-রুচি-মত-পথ নিরপেক্ষ হতে পারে না।
জগৎ ও জীবন, শাস্ত্র ও সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতি, শিল্প ও সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতা, বিজ্ঞান ও দর্শন, নীতি ও নিয়ম, রীতি ও পদ্ধতি প্রভৃতি নানা বিষয়ে অনুভব ও মনন জড়িত, ঋদ্ধভাষায় অভিব্যক্ত, আবেগমিশ্রিত ও যুক্তিপূর্ণ কথার পারম্পর্য রক্ষা করে সুস্পষ্ট বর্ণনে, বক্তব্যে বা অভিমতে পরিসমাপ্ত গাঁথা বাকক্কালার নাম প্রবন্ধ।
আমাদের প্রবন্ধ সাহিত্যের দৈন্য ঘুচতে মনে হয় আরো দেরি আছে। অবশ্য পত্র-পত্রিকার প্রয়োজনে প্রবন্ধও প্রায় গল্প-কবিতার মতোই অজস্র লিখিত হয়। বিশেষ বিশেষ সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রিক উৎসব পার্বণ উপলক্ষে স্কুলের ছাত্র থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের অধ্যাপক অবধি সবাই প্রবন্ধ লেখেন। কিন্তু এঁদের প্রবন্ধ কৃচিৎ রচনার স্তর অতিক্রম করে। তার কারণ প্রবন্ধ যে প্রতিবেশ-সচেতন লেখকের জ্ঞান, মন, প্রজ্ঞা ও ব্যক্তিত্বের সমন্বিত অভিব্যক্তির ধারক, তা তাঁরা বোঝেন না। তাই বক্তব্যহীন বাচালতা কেবলই আবর্তিত হয়: চিন্তা, রুচি কিংবা দৃষ্টিতে কোন পরিবর্তন ঘোষণা করে না। সাময়িক আনন্দ কিংবা যন্ত্রণাজাত নতুন চিন্তা, রুচি ও অনুভব প্রসূত কোন নতুন বক্তব্য না থাকলে প্রবন্ধ লিখবার অধিকার জন্মায় না। পুরোনো কথার রোমন্থনে আবশ্যক কি! যেমন ধরা যাক রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, ঈদ ও পূজাপার্বন সম্বন্ধীয় একগাদা রচনা প্রতি বছরেই পার্বণিক প্রয়োজনে লিখিত হয়। কারো কোন নতুন বক্তব্য নেই, অথচ ম্যাগাজিন ও পত্রিকার প্রয়োজনে কিংবা রেডিয়ো-টেলিভিশনের তাগিদে তাঁরা লেখেন। ফলে সব লেখাই হয় নিম্নমান ও নির্বিশেষ। প্রবন্ধে যদি লেখকের ব্যক্তিত্বের ছাপ না রইল, অর্থাৎ কে বলছে ও কি বলছে- এ দুটোর সমন্বয় না হল, তা হলে পাঠক মনে সে-লেখার কোন প্রভাবই পড়েনা। যে-কথা কেজো নয়- সে কথা পাগলে ছাড়া কেউ বলে না। বক্তব্য মাত্রেরই উদ্দিষ্ট থাকে শ্রোতা, যে-বক্তব্য বিভিন্ন মুখে বহুশ্রুত, তা তাৎপর্যহীন ও আটপৌরে। বহু মনের স্পর্শে তা মলিন ও তুচ্ছ।
প্রবন্ধ যে সবসময় সাহিত্য হবে তা নয়, কিন্তু শোনার মতো বক্তব্য হবে তার প্রাণ। স্বদেশের ও স্বকালের জীবন-প্রতিবেশের আনন্দ ও যন্ত্রণার, সম্পদ ও সমস্যার অভিঘাত যদি মন-বুদ্ধিকে বিচলিত করে, প্রাগ্রসর চেতনায় উল্লাস কিংবা যন্ত্রণা এনে দেয় অথবা কোন পুরোনো ভাব-চিন্তা-কর্ম বা তত্ত্ব, তথ্য ও বস্তু নতুন তাৎপর্যে চমকপ্রদ হয়ে উঠে অথবা চেতনায় নতুন দৃষ্টি দান করে, তখনই কেবল বলবার মতো বক্তব্য প্রকাশের আবেগ সৃষ্টি হয়। এবং তেমন প্রবন্ধই কেবল পাঠকের প্রত্যাশা পূরণ করে।।
স্বদেশের স্বকালীন মানুষের জীবন ও জীবিকার, সাহিত্য ও সংস্কৃতির, মত ও পথের ধর্ম ও সমাজের কিংবা রাষ্ট্রের সমস্যা ও সংকট যাঁদের চেতনায় জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে, যন্ত্রণা জাগিয়েছে অথবা গভীর উল্লাস ও আবেগ সৃষ্টি করেছে, তাঁরাই কেবল সার্থক প্রবন্ধ রচনা করতে পেরেছেন। তেমন প্রবন্ধের মাধ্যমে প্রবন্ধকারেরা দেশে চিন্তা-নায়কের ভূমিকা গ্রহণ করেন, অতুল জ্ঞান-প্রজ্ঞা-তত্ত্বের, ভাব-চিন্তা-কর্মের ও মত-পথের দিশা দিয়ে তাঁরা জাতিকে যুগোপযোগী ও কল্যাণভিসারী করে তোলেন।
প্রবন্ধ-সাহিত্যে আমাদের দৈন্যের মধ্যেও আশ্বস্ত হই যখন দেখি আমাদের সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সমস্যা ও সঙ্কট সচেতন অন্তত কয়েকজন প্রবন্ধকার আমরা পেয়েছি, যাঁরা শোষিত পীড়িত নির্যাতিত ও মূঢ় দেশবাসীর জন্যে বেদনা-ক্লিষ্ট হৃদয়ে উদ্বিগ্ন চিত্তে প্রতিকার-পন্থা সন্ধানে সদানিরত। তাঁরা অজ্ঞের অজ্ঞতা, অন্ধের অন্ধতা, মূঢ়ের মোহ, পথভ্রষ্টের যন্ত্রণা ঘুচানোর কাজে তাঁদের মন-মনন নিয়োজিত করেছেন। অবশ্য পিছুটান দেবার লোকেরও অভাব নেই। তাঁদের সর্ব প্রযত্নও যে প্রায়ই অসাফল্যে বিড়ম্বিত- তার মূলে রয়েছে তাঁদের প্রতিক্রিয়াশীলতা ও পশ্চাৎমুখিতা।
প্রবন্ধ সুচিন্তিত, সুযৌক্তিক ও সুলিখিত হবে বটে, কিন্তু সাহিত্য হওয়া জরুরি নয়। কেননা প্রবন্ধ হচ্ছে চিন্তার ও যুক্তির প্রসূন-গরজের সৃষ্টি। তাই সমকালীন সমাজজীবনের ও জীবিকার যে-কোন বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ রচিত হতে পারে এবং হয়ও। জ্ঞান-গর্ভ ও নৈতিক-তাত্ত্বিক প্রবন্ধই কেবল দীর্ঘায়ুর দাবীদার।
শান্তিরঞ্জন ভৌমিক প্রবন্ধ একই সঙ্গে সামাজিক ও সাহ্যিত্যিক, সমসামায়িক ও যুগোত্তীর্ণ, সাবজেকটিভ ও অবজেকটিভ, সাহসী ও মরমী। স্বজ্ঞা ও যুক্তির দীপ্ত সহাবস্থান সেখানে। তাঁর অধিকাংশ প্রবন্ধে লেখকের আদর্শ হলো সবচেয়ে কম কথায় সবচেয়ে বেশি ভাব সবচেয়ে সহজ ও সরস ভাবে প্রকাশ। রাট্রান্ড রাসেলের গদ্যের আদর্শও তাই। শুধু সহজ সামান্য কথায় জটিল প্রশ্ন গুলির আলোচনাই যথেষ্ট নয়, প্রবন্ধে যুক্তি ও তর্কের সঙ্গে, বুদ্ধির পাশাপাশি রসের উপস্থিতিও জরুরি। একাধিক লেখনিতে লেখক প্রবন্ধে সরসতার প্রতি তাঁর বিশেষ মনোযোগের কথা বলেছেন। সরসতা সত্বেও তাঁর প্রবন্ধ রম্যরচয়িতার মেজাজে লেখা নয়, তথ্যনিষ্ঠ রচনা, বিদগ্ধ মানসের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে লেখা, মোহমুগ্ধের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে নয়। এই ধরনের সৎ ও সাহসী, সরস ও স্বচ্ছন্দ রচনার জন্য দরকার দৃঢ় প্রত্যয় ও সুশোভন সৃষ্টিশীলতার। একদিক থেকে দেখলে প্রবন্ধ সাহিত্যই শান্তিরঞ্জন ভৌমিকের ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে স্পষ্ট প্রকাশ তীক্ষ্ম ও খুজু। তাঁর প্রবন্ধ একই সঙ্গে সামাজিক ও সাহিত্যিক, সমসাময়িক ও যুগোত্তীর্ণ, সাবজেকটিভ ও অবজেকটিভ, সাহসী ও মরমী, স্বজ্ঞাযুক্ত ও যুক্তিপূর্ণ।
বাঙালি জীবনে সততা, মননশীলতা ও উদারতার প্রতিষ্ঠা যাঁদের কাম্য, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পুষ্টি যাঁদের অভিষ্ট, বিবেকী শিল্পী শান্তিরঞ্জন ভৌমিকের প্রতি তাদের সমবেতভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করা উচিত। বিবেকিতা, শাস্তিরঞ্জন ভৌমিকের জীবনের, চরিত্রের, গদ্যরীতির কেন্দ্রে। অনিঃশেষ তাঁর কৌতূহল, অনারত তাঁর জীবনজিজ্ঞাসা, প্রমিতাক্ষর তাঁর বাচনকলা, নিস্কম্প দীপশিখার মত তাঁর বিবেকিতা। চারপাশের ঘনয়ামান অন্ধকার আর অনালম্ব, অনাত্মজ্ঞ, ব্যালোল মুরতা গর্জনের মাঝখানে শান্তিরঞ্জন ভৌমিকের ঋজু, প্রোজ্জ্বল, সুপ্রতিষ্ঠ উপস্থিতি আলোকস্তম্ভ প্রতিম। এখন অন্ধকার গাঢ়তর হয়েছে, কিন্তু আশি বছর পার হবার পরও তাঁর মনীষা, তাঁর বিবেকিতা, তাঁর বিশ্বনাগরিকতা সমানভাবে দীপ্তোজ্জ্বল। জীবন এবং শিল্প, সমাজ এবং সংস্কৃতি, স্বদেশ ও বিশ্বজগৎ সব কিছু নিয়েই এখনো তাঁর মনন যেমন গভীর এবং তন্নিষ্ঠ্য, তাঁর লেখায় সেই মননের প্রকাশ তেমনি স্পষ্ট, নির্মেদ, সুবিদ্ধ সংবাদী।
শান্তিরঞ্জন ভৌমিকের রচনায় একই সঙ্গে মিশে থাকে যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ, দার্শনিক মনন ও হার্দিক সংবেদন। তাঁর দেখার ধরন স্বতন্ত্র, লেখার ভঙ্গি স্বচ্ছ। গভীর কথাকেও নিতান্ত সহজ করে বলতে পারেন তিনি। যে প্রসঙ্গেই কিছু বলুন না তিনি তাঁর বক্তব্য শুনতেই হয়। তাঁর চিন্তা ঋজু ও যুক্তিপূর্ণ, মতামত দ্বিধাহীন ও অভিজ্ঞতাপুষ্ট। প্রসঙ্গ সাময়িক হলেও জীবনবোধ থেকে উৎসারিত বলে প্রতিটি মতামত অমূল্য। চিন্তার স্পষ্টতায়, ভাষার স্বচ্ছতায়, বিশ্লেষণের ব্যাপকতায়, উপলব্ধির গূঢ়তায়, প্রত্যয়ের দৃঢ়তায় শান্তিরঞ্জন ভৌমিকের প্রবন্ধগুলি আক্ষরিক অর্থেই প্রবন্ধ। তাঁর একটি লেখাকেও অস্বীকার করা যায় না। এক কথায় নস্যাৎ করে দেওয়া যায় না তাঁর চিন্তার যুক্তি পরম্পরাকে। তিনি সেই বিরল প্রাবন্ধিকদের একজন যার রচনা পরবর্তীকালের হারায় না প্রাসঙ্গিকতা, যার চিন্তা আমাদের বহু ভাবনাচিন্তার সমস্যা সংকটের জট ছাড়াতে, কর্মপন্থা নির্বাচন করতে সহায়ক হয়ে উঠে।
শান্তিরঞ্জন ভৌমিকের প্রবন্ধে প্রায় সর্বত্রই অসামান্য অর্ন্তদৃষ্টি ও ভাষার নিপুণতা লক্ষণীয়। তাঁর বৈদগ্ধ এবং সংবেদনশীলতা, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিকতা এবং যুক্তিবিন্যাসের দৃঢ়তা, তাঁর ভাষার গতিশীলতার লাবণ্য পাঠক হিসাবে আমাদের অভিভূত করে।
শান্তিরঞ্জন ভৌমিক বিশ্বাস করেন: আমরা নিজেদের বদল করি আমাদের যুগ এবং সংস্কৃতির সমস্যাগুলো বুঝবার মধ্য দিয়ে। এই বোঝার চেষ্টাটাই আমাদের অনবরত সৃষ্টি করে নতুন মানব হতে। এটা সত্য, ভবিষ্যত সমস্যা এবং প্রয়োজন নীতিগতভাবে বলা সম্ভব না, আগামী দিন কেমন হবে বলা সম্ভব না, কিন্তু শান্তিরঞ্জন ভৌমিক শান্তভাবে-নম্রভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন প্রতিটি প্রজন্মের সামাজিক-রাজনৈতিক মতাদর্শিক ব্যবস্থার পথ উন্মুক্ত করে দেবে ভবিষ্যত চাহিদার, ভবিষ্যত প্রয়োজনের। তাঁর বহুবাদিতা আমাদের চিন্তার ইতিহ্যকে, একটি সাহসী ও আশা উদ্দীপনার সংযোজন। তাঁর বহুবাদিতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিবাদী ও কল্পনাকুশল চ্যালেঞ্জ: সংস্কারবর্তী দেশে এ কথা বলতেই হয়। সে জন্য তাঁর এই নৈতিক আদর্শবাদ তরুণদের আকর্ষণ করেছে। এই দৃষ্টিকোণ, একই সঙ্গে দয়াবান এবং মানবিকতাসম্পন্ন, জীবনযাপনে হাজার সমস্যা সত্ত্বেও বাঁচতে সাহায্য করে। ব্যক্তির দায়িত্ব সর্বক্ষেত্রে, ঐতিহ্যক ধর্মের পতনের পর, এই দৃষ্টিভঙ্গি সহনশীলতা, বোধগম্যতা তৈরি করে ব্যক্তি ও সমষ্টির ক্ষেত্রে, তৈরি করে মানুষের ক্ষেত্রে পরিপক্বতা, তৈরি করে সভ্যতা।
প্রগতির প্রতিকৃতি শান্তিরঞ্জন ভৌমিক, আমাদের দিয়েছেন সবচেয়ে পরিপক্ব মানুষের ইতিহাস পাঠের বোধ, মানুষের স্বভাব বুঝবার অন্ধকারের মধ্যে জাতি সময়ের চ্যালেঞ্জ সহ্য করার শক্তি। তাঁর চিন্তা আমাদের উপহার দিয়েছে, ভাবনা অনুভবময়তা, আকাক্ষা এবং দুঃখ সহ্য করার ক্ষমতা। ইতিহাস মানুষের ক্ষেত্রে ফ্রিডমের বোধ এবং দায়িত্বের বোধ তৈরি করে: শান্তিরঞ্জন ভৌমিক এই কাজটাই আমাদের জন্য করেছেন।












http://www.comillarkagoj.com/ad/1752266977.jpg
সর্বশেষ সংবাদ
কুমিল্লায় ২৪ প্রার্থীর পক্ষে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ
কুমিল্লায় অটোমেটেড পেট্রোলিয়াম ডিপোর উদ্বোধন
নানান আয়োজনে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় কুমিল্লায় মহান বিজয় দিবস উদযাপন
কুমিল্লা মহানগর জামায়াতের যুব র‌্যালী অনুষ্ঠিত
‘এক’শ বছরে ক্ষমতার ধারে কাছেও যেতে পারবে না জামায়াত ’
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
এখনও সংকটাপন্ন হাদির অবস্থা, চিকিৎসকদের চোখ ‘টাইম উইন্ডোতে’
৯ কোটি ২০ লাখে কলকাতায় মুস্তাফিজ
মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে কটাক্ষ করলে সাধারণ মানুষই উপযুক্ত জবাব দেবে : টুকু
খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিশ্চিতে সব ধরনের সহযোগিতা দিচ্ছে সরকার
মনোহরগঞ্জে জামায়াতে ইসলামীর বর্ণাঢ্য বিজয় র‍্যালি অনুষ্ঠিত
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২