
১ মার্চ
ছিল ঝকঝকে নীল আকাশ আর রৌদ্রকরোজ্জ্বল। পূর্ব পাকিস্তানে কর্মজীবন আরম্ভ
হয়েছিল- ‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল,’ ‘আকাশে সোনার রবি পূব দিকে উঠে’ এবং
‘শিশুগণ দাও মন নিজ নিজ পাঠে’র দৃশ্য ও শ্রুতি দিয়ে। মধ্যাহ্নের কিছু আগে
রেডিও পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মো. ইয়াহিয়া
খানের বরাতে (স্বকণ্ঠে নয়) এক বিবৃতিতে ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয়
পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার কথা বলা হলে সারা পূর্ব পাকিস্তান ক্ষোভ ও
হতাশায় ফেটে পড়ে। সব কর্মস্থল থেকে মানুষ রাস্তায় নেমে এসে স্লোগানে রাজপথ
প্রকম্পিত করে তোলে। এর দুই দিন আগে সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবকে গভর্নর ভবনে (বর্তমানে মহামান্য রাষ্ট্রপতির বাসভবন) চায়ের
নিমন্ত্রণ জানান গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল আহসান (দাক্ষিণাত্য) ও পূর্ব
পাকিস্তানের উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল সাহেবজাদা মো. ইয়াকুব
খান (রামপুরের নবাব)। এরা দুজন মুজিবকে এই অধিবেশন স্থগিত করে আগাম
সিদ্ধান্তের কথা অবহিত করেছিলেন। সংক্ষুব্ধ জনতাকে শান্ত থাকার আহ্বান
জানিয়ে মুজিব হোটেল ইডেনে আওয়ামী লীগের এক সভা ডাকেন। তাতে দলীয় কর্মসূচি
স্থির হয়। প্রদেশের প্রত্যেকটি শহরে ইয়াহিয়াবিরোধী বিক্ষোভ হতে থাকে।
পুলিশ
ও বিচার বিভাগ অকার্যকর করে দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এসব স্থানে জনতার
ওপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে। সান্ধ্য আইন জারি করে বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা চলতে
থাকে। ৩ মার্চ ইয়াহিয়া মন্ত্রিসভার সব বেসামরিক সদস্যকে বিদায় দেওয়া এবং
পূর্ব পাকিস্তানের ভাইস অ্যাডমিরাল আহসান ও লে. জেনারেল ইয়াকুবকে বরখাস্ত
করা হয়। এরা দুজন বল প্রয়োগ না করে বরং পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা
মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে মত দিয়েছিলেন। ৭ মার্চ রেসকোর্সে
মুজিব বেলা ৩টা ১ মিনিটে এক জনসভায় ভাষণে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির
সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। দেশের মানুষের ট্যাক্সের
অর্থ দিয়ে যে অস্ত্র কেনা হয় বহিশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য,
আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে আমার দেশের মানুষকে হত্যা করার জন্য।
রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ
(উদ্ধৃতি ক্রমানুসারে নয়)। সভাস্থলের বাইরে পূর্ব পাকিস্তানের ১৪তম পদাতিক
ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা (লায়ালপুর)-৩ কোম্পানি সৈন্য
নিয়ে অপেক্ষমান ছিলেন।
মুজিব একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে ফেললে
খাদিম আশপাশের সবকিছু ধ্বংস করে দিতেন। পরদিন পশ্চিম পাকিস্তানের ওয়াহ
সেনানিবাস থেকে লে. জেনারেল টিক্কা খান, কোর কমান্ডার, ঢাকায় বদলি হয়ে আসেন
গভর্নরের পদে। প্রধান বিচারপতি কালিয়াকৈরের বি এ সিদ্দিকী নতুন গভর্নরকে
শপথ না দেওয়ার দুঃসাহস দেখিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। ৮ মার্চ থেকে সারা
প্রদেশে পাকিস্তান সরকার অচল হয়ে পড়ে মুজিবের মুখের নির্দেশে চলতে থাকে।
সেনানিবাস ও গভর্নর হাউস ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তানি পতাকা দেখা যায়নি।
অবসরপ্রাপ্ত সব সরকারি চাকুরেরা মুজিবের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেন। পল্টন
ময়দানে প্রাক্তন পুলিশ, আনসার, সশস্ত্র বাহিনী ও সিভিল ডিফেন্স সদস্যরা
আগ্নেয়াস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিতে আরম্ভ করেন। ১০ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের
উপ-রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড ভিয়েতনাম হত্যাকাণ্ডের একজন বিশেষজ্ঞকে নিয়ে ঢাকা
এসে টিক্কা খানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে একটি গণহত্যার পরিকল্পনা নিয়ে
আলোচনা করেন।
এ সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আইএসআই প্রধান লে. জেনারেল
মু. উমর (আম্বালা) তাদের কারিগরি সহায়তা দেন। পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক
বিষয়ক মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী (রোহটাক) ও এই সভায় যোগদান করেন। পাক
সেনাবাহিনীর অস্ত্রের ভীতি জাগানিয়া পরিবেশের মধ্যেও বাঙালিরা সংগঠিত হয়ে
সাহসী ভূমিকা রাখতে থাকেন এবং ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’
জাতীয় স্লোগানে প্রদেশকে মুখরিত করতে থাকেন। এই অবস্থায় ইয়াহিয়া মুজিবকে
এই মর্মে খবর দেন যে তিনি ঢাকায় এসে তার সঙ্গে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের
অধিবেশন অনুষ্ঠানের বিষয়ে আলোচনা করবেন। ১৮ মার্চ তিনি ঢাকায় আসেন। টিক্কা
খান তাকে তেজগাঁ (বর্তমান পিএসসির পরিত্যক্ত ভবন এবং বিমানবাহিনীর
মালিকানায় নেওয়া) বিমানবন্দরে স্বাগত জানান। ইয়াহিয়ার সঙ্গে অন্যদের মধ্যে
ছিলেন এম এম আহমদ, বিচারপতি কর্নেলিয়াস, এ কে ব্রোহি লে. কর্নেল মাসুদ
(বাঙালি)। পরদিন সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা সিন্ধুর জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় আগমন
করলে মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা আরম্ভ হয়। মিন্টো রোডে (বর্তমানে ফরেন সার্ভিস
একাডেমি ভবনে) পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশ এবং
কেন্দ্রের মধ্যে ভবিষ্যৎ ক্ষমতা বণ্টন নিয়ে এই আলোচনা হয়।
পূর্ব
পাকিস্তানের ওপর পশ্চিমা মহলের দীর্ঘদিনের শোষণ বন্ধের লক্ষ্যে মুজিব
প্রতিরক্ষা ছাড়া প্রায় সব বিষয় অর্থাৎ কর আদায়, পররাষ্ট্র চুক্তি,
আধা-সামারিক বাহিনী ইত্যাদি বুনিয়াদি বিষয়গুলোর ক্ষমতা প্রদেশের হাতে ছেড়ে
দেওয়ার কথা বলেন। ইয়াহিয়া একপর্যায়ে বলেন, এত দেখছি এক কনফেডারেশনের
ব্যবস্থা। তবে জাতির পিতা জিন্নাহ যেখানে এমন ব্যবস্থায় সম্মত ছিলেন,
সেখানে আমি না করার কে? কিন্তু এতে শোষণ বন্ধ হয়ে যাবে বলে ভুট্টো ও এম এম
আহমদ আপত্তি করেন। ইয়াহিয়া আবার পিছু হঠেন। রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তিকে
পরামর্শ দেওয়ার পদ্ধতিটি সুষ্ঠু না হলে তার পরিণতি মারাত্মক হতে পারে।
যেমন, মণি সিং মুজিবকে একদল গঠন করার পরামর্শ দিয়েও বাংলাদেশের এবং আওয়ামী
লীগের রাজনীতির জন্য দুই দশকব্যাপী এক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
পাকিস্তান
সেনাবাহিনীর উচ্চতম কর্তা জেনারেল মিঠা, হামিদ (ভুপাল), পিএসও লে. জেনারেল
পীরজাদা ইয়াহিয়াকে চাপ দিতে থাকেন এতে সম্মত না হয়ে বরং বল প্রয়োগ করে
বাঙালিদের রুদ্ধ করে দিতে। ইয়াহিয়াও তখন বাইরে এসে বলতে থাকেন, মুজিব বেশি
দাবি করছে এবং ভালো ব্যবহার করছে না। তবে মুজিব সাংবাদিকদের বলতে থাকেন,
অগ্রগতি না হলে আলোচনা করছি কেন? এই দিনগুলোতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে
কিছুসংখ্যক সশস্ত্র বাহিনীর ইউনিটকে বদলি করে পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে আসা
হয়। ২৪ মার্চও আলোচনা অব্যাহত থাকে। ২৫ তারিখে আলোচনা হওয়ার কথা থাকলেও
প্রেসিডেন্টের টিম উপস্থিত হয়নি। এদিন সকালে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে
কর্নেল এসডি আহমদকে ঢাকায় এনে তার কমান্ডো ইউনিট সদস্যদের দিয়ে মুজিবের ৩২
নম্বর রোডের বাড়ি রেকি করা হয়। ইয়াহিয়া বিকালে সেনা মেস-এ চলে যান।
সেনাপ্রধান
হামিদের সঙ্গে পানাহার শেষে তিনি তাকে বলেন, ‘ঝড়ৎঃ ঃযব নধংঃধৎফং ড়ঁঃ বিষষ
ধহফ ঢ়ৎড়ঢ়বৎ.’ এর পর একটি ছদ্মবেশী গাড়িতে করে তেজগাঁও এয়ারপোর্ট থেকে
করাচিগামী পিআইএ ফ্লাইটে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী
শুরু করে তাদের অপারেশন সার্চলাইট নামের বাঙালি নিধন অভিযান। খাদিম হোসেন
রাজা টিক্কার নির্দেশে এটি পরিচালনা করেন। এদিকে আহমদের বাহিনী মুজিবকে
গ্রেপ্তার করতে যায় মেজর বেলালের নেতৃত্বে। এর ঠিক আগে মুজিব ১২টা ১ মিনিটে
ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর এক বেতার যন্ত্রের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে
স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করেন। পূর্ব পাকিস্তানের একটি ছাড়া আর সব
সামরিক ইউনিটের অধিনায়ক ছিলেন পাকিস্তানি। বাঙালি কর্তাটি ছিলেন লে. কর্নেল
রেজাউল জলিল, যশোর সেনানিবাসে। তিনি আত্মসমর্পণ করেন। ওদিকে খাদিমের
পরিচালনায় ঢাকাসহ সারা দেশে ৩২, ১৮, ৪৮ পাঞ্জাব, ২০, ২২ ও ২৪ ফ্রন্টিয়ার
ফোর্স, ২০ বালুচ, ৪৩ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি, ৪ ক্যাভালরি ও ২১ নম্বর
ব্যাটারি ইউনিট পিলখানায় ইপিআর সদর দপ্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ
পুলিশ লাইন, নীলক্ষেত এবং ঢাকা সেনানিবাসের বাঙালিদের গণহত্যা শুরু করে।
ঢাকায় মূলত বেসামরিক জনতা এর শিকার হলেও চট্টগ্রামের ভাটিয়ারিতে ৮ বেঙ্গল ও
ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে ১৭০৪ জন সৈন্য হত্যা করে। এসবের নেতৃত্বে
ছিলেন খাদিম ছাড়াও আনছারি, আতিফ মোহাম্মদ, মজিদ, ইকবাল শফি, জাহান জেব
আবরার, রাজা সুলতান মাহমুদ, শেরওয়ানি, সেঘাল, জাভেদ, সিদ্দীক রাজা, মনজুর
হোসাইন, মো. খান, আমির গুলিস্তান জানজুয়া, ইয়াকুব মালিকি, আলী কুলি খান,
দুররানি, খিজির খান, বশির, শওকত রিজভি নামে মেজর থেকে ব্রিগেডিয়ার পদবির
সামরিক কর্তারা। হত্যা ছাড়াও নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের ভয়ে ১
কোটি মানুষ ক্রমে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। বিদেশি সরকারগুলোর এক
বিরাট অংশ ইয়াহিয়াকে আলোচনার মাধ্যমে মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের
পরামর্শ দেন। মুজিবকে পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবের লায়ালপুর জেলা কারাগারে
বন্দি করে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। ১৭
এপ্রিল, মেহেরপুরের মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠিত হয় সৈয়দ নজরুল
ইসলামের নেতৃত্বে। পাকিস্তান সরকার হত্যাকাণ্ডের কথা অস্বীকার করতে থাকলেও
সংবাদমাধ্যমগুলো তা ফাঁস করে দিতে থাকে। ৫ আগস্ট ইয়াহিয়া সরকার এক
শ্বেতপত্র প্রকাশ করে দাবি করে যে, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। লাখ লাখ
বাঙালি যারা ভারতে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন
তাদের দুষ্কৃতকারী আখ্যা দিয়ে এই শ্বেতপত্রে তাদের সাধারণ ক্ষমার আওতায় আনা
হয়।
পদগর্নি ও হ্যারল্ড উইলসদের মতো বিশ্বনেতারা ইয়াহিয়াকে শান্তি
স্থাপনের কথা বলতে থাকেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সনসহ বিশ্বনেতাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন যে,
এই শরণার্থী ভারতের জন্য এক বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরা নির্যাতিত এবং
এদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করানো এ অঞ্চলে শান্তির জন্য প্রয়োজন। এতে কোনো
সুফল মিসেস গান্ধী আনতে পারেননি। তবে ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মিসর তাকে
সমর্থন দেয়। বাংলাদেশের এই সংগ্রামে বিশ্ব সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে বিদেশে
খুব ভালো পরিশ্রম করেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। দেশের ভেতর সামান্য
প্রশিক্ষণ পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের এবং নিয়মিত সৈন্যদের হাতে ভারী অস্ত্রের
অভাব থাকায় যুদ্ধে খুব অগ্রগতি সাধিত হয়নি। কোনো থানা বা মহকুমা মুক্ত করা
তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে কাদের সিদ্দিকী অন্য যেকোনো নিয়মিত
সৈন্যের চেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে থাকেন। টিক্কা খানের কার্যকলাপে ইয়াহিয়া
বিরক্ত হয়ে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে লে. জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান
নিয়াজিকে পূর্ব পাকিস্তানের অধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ দেন। এ মাসেই বাঙালি নেতা
এবং আওয়ামীবিরোধী এমএনএ নুরুল আমীন ইয়াহিয়াকে বলেন, আপনার ঢাকায় গিয়ে
জনসভা করা উচিত। তাতে পরিস্থিতি ভালো হবে।’ বাংলায় কথা বলতে পারি না। আমি
ওখানে কী করতে পারি বলে ইয়াহিয়া এটা এড়িয়ে যান। এদিন রাওয়ালাপিন্ডিতে এক
সংবাদ সম্মেলনে ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক বলে দাবি
করেন।
বিশিষ্ট অভিনেত্রী শর্মিলী ঠাকুরের চাচাশ্বশুর লে. জেনারেল শের
আলী খান পতৌদি নিয়াজির আগে ঢাকায় পদায়িত হলে তিনি ইয়াহিয়া খানকে পূর্ব
পাকিস্তানে স্বদেশবাসীর ওপর নির্যাতন চালানো বন্ধের জন্য পরামর্শ দেন।
কিন্তু এই বিবেকবান সেনাপতির কথা ইয়াহিয়া শোনেননি। শের আলী তার পদায়নের
আদেশ বাতিল করতে সক্ষম হন। আগের এক নির্দেশে প্রেসিডেন্ট হাউসে ঝাড়ামোছা ও
আলোকসজ্জার কাজ চলছিল। তা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। গণহত্যা পরিস্থিতি, শরণার্থী ও
প্রায় ৪৫০ জন বাঙালি আইন প্রণেতার দেশত্যাগের ঘটনায় পাকিস্তান ক্রমশ
কোণঠাসা হয়ে পড়তে থাকে। সেপ্টেম্বর মাসেই ইউএনএইচসিআর, শরণার্থীরা পূর্ব
পাকিস্তান না ফিরে আসার কারণ হিসেবে পাক সৈন্যদের নৃশংসতাকে দায়ী করে
বিবৃতি দেয়। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষে বিশ্ব দুভাগে বিভক্ত
হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং মুসলিম বিশ্বের প্রায় সবাই বিপক্ষে এবং
সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপ, ব্রিটেন, পশ্চিম ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া পক্ষে
অবস্থান নেয়। নিয়াজি বলে বেড়াতে লাগলেন যে, এই যুদ্ধ ভারতীয় হিন্দুদের
চাপিয়ে দেওয়া, মুক্তিফৌজ নামে কোনো কিছু নেই এবং তিনি প্রতিটি সৈন্য ও
প্রতিটি বুলেট শেষ হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন। ইতোমধ্যে অর্থাৎ আগস্ট
মাস থেকে মেজর জেনারেল জামশেদের সহায়তায় বাঙালি ও বিহারি পাকপন্থি
পুরুষদের নিয়ে আলশামস, আলবদর ও রাজাকার নামে তিনটি খুনি বাহিনী তৈরি হয়ে
তাদের হাতে মুক্তিকামী বাঙালি নিহত হতে থাকেন। তারা বিশেষ করে সনাতনী
সম্প্রদায়ের মানুষ হত্যা ও তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করতে থাকে।
মুক্তিযোদ্ধারা
পুল, কালভার্ট, ট্রেন ও বিদ্যুৎকেন্দ্র উড়িয়ে দিয়ে পাকবাহিনীর চলাচলকে
বিপর্যস্ত করে দিতে থাকেন। ২২ নভেম্বর রোজার ঈদের আগে নিয়াজি হুংকার দিয়ে
বলেন, এবারের ঈদের নামাজ পড়া হবে কলকাতার গড়ের মাঠে। তিনি অসহায় অবস্থা
বুঝতে পেরে পিন্ডির কাছে নতুন নতুন সেনা ইউনিট চেয়ে পাঠাতে থাকেন। কিন্তু
তা ক্রমশ অসম্ভব হয়ে পড়ায় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নিরাপত্তা নাজুক হয়ে ওঠায়
ইয়াহিয়া, সেনাপ্রধান হামিদ ও অন্য কর্তারা চালাকি করে নিয়াজিকে শুধু
সান্ত্বনা আর সাহস দিতে থাকেন। সীমান্ত চৌকিতে মুক্তিযোদ্ধার আক্রমণ বাড়তে
থাকে। পাকসেনা ইউনিটগুলো সেনানিবাসকেন্দ্রিক হতে থাকে। এর আগে উপমহাদেশের
সামরিক উত্তেজনা পর্যবেক্ষণ করে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সেপ্টেম্বর
মাসে এক সামরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করে। ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানে
তার পজিশন অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে একটি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরিকল্পনা
করেন, যাতে করে জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো প্রয়োগ করে যুদ্ধবিরতি
আনিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে চিরতরে রুদ্ধ করে দেওয়া যায়। তিনি ৩
ডিসেম্বর ’৭১-এ তাই অতর্কিতে ভারতের পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত আম্বালা,
লুধিয়ানা, পাঠানকোর্ট, অমৃতসর ও জলন্ধর বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণ চালান। ভারত
সরকার আত্মরক্ষার্থে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত পাকসৈন্য, বিমানবাহিনী ও
নৌ-ঘাঁটিতে ব্যাপক আক্রমণ চালায়। যুদ্ধ দুই সীমান্তে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের
ভেতর তো বটেই, পশ্চিম পাকিস্তানেও পাকিস্তানিদের পরাজয় ঘটতে থাকে।
তারা
সেখানে পাঞ্জাব-রাজস্থান সেক্টরে ৫৫০০ সৈন্যের প্রাণ এবং ৫৬০০ বর্গমাইল
ভূমি হারায়। পাকিস্তানের নেতা ভুট্টো জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আনলেও
পোলান্ড ও সোভিয়েতের দক্ষ কূটনীতির ফলে তা ব্যর্থ হয়ে যায়। চীন ও
যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে কার্যকরভাবে এগিয়ে আসে না। ভারতীয় বাহিনীর
প্রচণ্ড আক্রমণে পূর্ব পাকিস্তানের পতন অবশ্যম্ভাবী দেখতে পেয়ে নিয়াজি,
ইয়াহিয়ার কাছে নির্দেশনা চান। তিনি উত্তরে প্রতারণাপূর্ণ কথা বলে সিদ্ধান্ত
তারই ওপর ছেড়ে দেন। উল্লেখ্য, ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো সেক্টরই
স্বাধীন হয়নি। কিন্তু ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বরে সম্পূর্ণভাবে
হানাদারমুক্ত হয়। এতে ভারতীয় বাহিনীর ১৭৬৪ জন সৈন্য ও অফিসার শহিদ হন।
ভারতীয় কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার (রাওয়ালাপিন্ডি) নেতৃত্বে
মিত্রবাহিনী ঢাকার কাছে এগিয়ে এসে নিয়াজির আত্মসমর্পণের সময় বেঁধে দেয়।
নিয়াজি ১৬ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার ঢাকায় বিকেল ৫টা ১ মিনিটে অরোরার কাছে চরম
অপমানজনকভাবে আত্মসমর্পণ করেন। তার সঙ্গে ৯৩ হাজার নানা শ্রেণির সৈন্য,
পুলিশ, সীমান্তরক্ষী, রেঞ্জার ও স্কাউট ছিল। এদের মধ্যে ৭৪ জন বাঙালি সেনা
ছিলেন, যারা পাকবাহিনীর সঙ্গে থেকে স্বজাতির বিরুদ্ধে ৯ মাস যুদ্ধ করেছেন।
এদের মধ্যে একজন হলেন ক্যাপ্টেন আশরাফুল হুদা।
তিনি একটি ফৌজদারি
মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি। আর একজন পুলিশ কমিশনার মির্জা রফিকুল হুদা।
ঢাকায় আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে নিয়াজি ও অরোরা স্বাক্ষর করলেও তখন সেখানে
উপস্থিত ছিলেন মেজর জেনারেল জ্যাকব, ভাইস অ্যাডমিরাল কোহলী, এয়ার মার্শাল
পি সি লাল, ব্রিগেডিয়ার ত্রিলোকনাথ, ব্রিগেডিয়ার বকর সিদ্দিকী প্রমুখ
পাকিস্তানি ও ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তারা। মিসেস গান্ধী দিল্লির লোকসভায়
ঘোষণা দেন যে, ভারতীয় সময় বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে এই আত্মসমর্পণ চুক্তি
স্বাক্ষরিত হয়েছে। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন সেনা ও নৌ-ঘাঁটিতে আত্মসমর্পণ করেন
কমোডোর মুজাফফর, ব্রিগেডিয়ার জিকরুল্লাহ, দুররানি, তোজাম্মল মালিক, শওকত
হায়াত, এয়ার কমোডোর মাসুদ। এর আগে খাদিম পশ্চিম পাকিস্তানে বদলি হন। লে.
কর্নেল আলী কুলি খান বার্মা হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে যান। পূর্ব
পাকিস্তান থেকে পলাতক বাঙালি সৈন্য, সীমান্তরক্ষী ও পুলিশ এবং
নবপ্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর কোনো
ঘাঁটির ধ্বংস বা আত্মসমর্পণ ঘটানো সম্ভব হয়নি। কারণ এর জন্য প্রয়োজনীয়
অস্ত্র ও গোলাবারুদ তাদের ছিল না। জেনারেল ওসমানির বিশেষ সহকারী মেজর (অব.)
খালেক তার বইতে লিখেছেন যে, কেবল দলছুট এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অল্পকিছু সংখ্যক সৈন্য বাঙালি যোদ্ধাদের হাতে নিহত
হয়। তার পরও মুক্তিযুদ্ধের দলিলের কোথাও এই পাকিস্তানি সৈন্যদের নাম, পদবি,
ইউনিট ও ঘটনাস্থলের বর্ণনা প্রায় নেই বলা চলে। কিন্তু ৩ ডিসেম্বরের পর
থেকে পাকিস্তানের চেয়ে ৪ গুণ শক্তিশালী ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর প্রচণ্ড
আক্রমণে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত পাকিস্তানের সব সামরিক ঘাঁটির পতন ঘটতে
থাকে। ১৬ ডিসেম্বর তারা ঢাকায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাবেক কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল
