
১৯৭১
সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে এই বিতর্ক নতুন মাত্রা পেয়েছে যখন বিভিন্ন মহল থেকে মৃতের
সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমিয়ে ‘মাত্র কয়েক হাজার’ বা ‘কয়েক লাখে’ নামিয়ে আনার
প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। অথচ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্র, তৎকালীন
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন, জনমিতিক পরিসংখ্যান এবং শরণার্থী শিবিরের ভয়াবহ
চিত্র ভিন্ন কথা বলে। আজ আমরা আবেগের ঊর্ধ্বে উঠে, কঠোর একাডেমিক
দৃষ্টিভঙ্গি, গাণিতিক বিশ্লেষণ এবং তুলনামূলক জেনোসাইড স্টাডিজের আলোকে
বোঝার চেষ্টা করব, শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখ এই দাবি কতটা আলঙ্কারিক আর কতটা
বাস্তবিক-যা নিয়ে আগেও লিখেছি আমি এবং আবারও লিখতে বাধ্য হচ্ছি।
সংখ্যার রাজনীতি বনাম রক্তের ইতিহাস
বাংলাদেশের
অভ্যুদয়ের ইতিহাসের সঙ্গে ‘ত্রিশ লাখ’ সংখ্যাটি অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে।
কিন্তু স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরেও আমাদের এই মৌলিক সংখ্যাটি নিয়ে প্রশ্ন
তোলা হয়। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন আলোচনায় দাবি করা
হচ্ছে, ১৯৭১ সালে নিহতের সংখ্যা ছিল মাত্র দুই হাজার, অনেকে সংখ্যাটা এত কম
মনে না করলেও তিন লাখের ওপরে উঠতে রাজি নন। এইসব দাবির পক্ষে যুক্তি
হিসেবে কখনো পাকিস্তানি কমিশনের রিপোর্ট, কখনো বা বিদেশি সাংবাদিকদের
খণ্ডিত প্রতিবেদনকে সামনে আনা হয়।
‘১৯৭১ সালের যুদ্ধটা নিয়ে সব সময়ই
একটু বেশি বাড়াবাড়ি করা হয়। সে সময় এমন বড় কিছুই হয়নি...’-এজাতীয় বয়ান যারা
তৈরি করেন, তারা মূলত ইতিহাসের একটি ‘রিভিশনিস্ট‘ বা সংশোধনবাদী ধারা তৈরি
করতে চান। তাদের প্রধান যুক্তি নির্মিত হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে। বলা
হয়, তিনি পাকিস্তান থেকে ফিরে বিমানবন্দরে ভুল করে ‘থ্রি লাখ’ বলতে গিয়ে
‘থ্রি মিলিয়ন’ বলে ফেলেছিলেন এবং সেখান থেকেই নাকি এই মিথের জন্ম। কিন্তু
ইতিহাস কি আসলেই তাই বলে? নাকি ৩০ লাখের এই পরিসংখ্যানের পেছনে রয়েছে গভীর
জনমিতিক ও সামরিক বাস্তবতা?
‘স্লিপ অব টাং’ তত্ত্ব: তথ্য কি বলে?
সমালোচকদের
বহুল প্রচলিত তত্ত্ব হলো-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের জানুয়ারি
মাসে পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে ফেরার পথে আবেগের বশবর্তী হয়ে বা ইংরেজি
জ্ঞানের অভাবে তিন লাখকে তিন মিলিয়ন বলেছিলেন। কিন্তু দালিলিক প্রমাণ এই
তত্ত্বকে সরাসরি নাকচ করে দেয়। প্রথমত, তিনি দেশে ফেরার আগেই
বিশ্বগণমাধ্যমে ৩০ লাখ বা তার কাছাকাছি সংখ্যার উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৯৭১
সালের মার্চেই পাকিস্তানি জান্তা প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান সদম্ভে ঘোষণা
করেছিলেন, ‘‘ওদের ত্রিশ লাখ হত্যা কর, বাকিরা আমাদের থাবার মধ্যে থেকেই
নিঃশেষ হবে।’ (রবার্ট পেইন, ম্যাসাকার, ১৯৭৩)। অর্থাৎ, হত্যার টার্গেট বা
নির্দেশক সংখ্যাটি পাকিস্তানিরাই নির্ধারণ করে দিয়েছিল।
মাওলানা ভাসানী
যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়েই দশ লাখ মানুষ হত্যাকাণ্ডের কথা বলেছিলেন। সেক্টর
কমান্ডার খালেদ মোশারফ একাত্তরের সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে কানাডার গ্রানাডা
টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দশ লক্ষ মানুষের হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ
করেন। কবি আসাদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় লিখেছেন বেশ কয়েকটি কবিতা। সেসব
কবিতায় বারবার এসেছে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর কথা। আসাদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধ
চলকালীন সময়ে লেখা তার ‘রিপোর্ট ১৯৭১’ কবিতায় বলেছিলেন ১০ লাখ গলিত লাশের
কথা:
‘জনাব উথান্ট,
জাতিসংঘ ভবনের মেরামত অনিবার্য আজ।
আমাকে দেবেন, গুরু, দয়া করে তার ঠিকাদারী?
বিশ্বাস করুন রক্তমাখা ইটের যোগান
পৃথিবীর সর্বনিম্ন হারে একমাত্র আমি দিতে পারি
যদি চান শিশু ও গলিত খুলি, দেওয়ালে দেওয়ালে শিশুদের রক্তের আল্পনা
প্লিজ, আমাকে কন্ট্রাক্ট দিন।
দশ লক্ষ মৃতদেহ থেকে
দুর্গন্ধের দুর্বোধ্য জবান শিখে রিপোর্ট লিখেছি-পড়, পাঠ কর।’
মুক্তিযুদ্ধের
সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হতো ‘চরমপত্র’। সেই
চরমপত্রের শেষ প্রচার দিবস অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বরের কিছু অংশ সরাসরি তুলে
দিচ্ছি: ‘...২৫ মার্চ তারিখে সেনাপতি ইয়াহিয়া খান বাঙ্গালিগো বেশুমার
মার্ডার করনের অর্ডার দিয়া কি চোটপাট! জেনারেল টিক্কা খান সেই অর্ডার পাইয়া
৩০ লাখ বাঙ্গালির খুন দিয়া গোসল করল। তারপর বঙ্গাল মুলুকের খাল-খন্দক,
দরিয়া-পাহাড়, গেরাম-বন্দরের মইদ্দে তৈরি হইল বিচ্ছু...’ (চরমপত্র; পৃ:
৩২৫)।
এবার আসি সংবাদপত্রে। শেখ মুজিবুর রহমানই যদি ভুলটি করে থাকেন
তাহলে ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ থেকে ৯ জানুয়ারি, ১৯৭২ পর্যন্ত সংবাদ
প্রতিবেদনগুলোতে ত্রিশ লাখ শহীদের কথা কী করে এল? যেমন ‘দৈনিক পূর্বদেশ’
সম্পাদক তার পত্রিকায় ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর ‘ইয়াহইয়া জান্তার ফাঁসি দাও’
শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় লেখেন। সেখানে পরিষ্কার লেখা হয়, ‘হানাদার দুশমন
বাহিনী বাংলাদেশের প্রায় ৩০ লাখ নিরীহ লোক ও দুশতাধিক বুদ্ধিজীবীকে
নির্মমভাবে হত্যা করেছে...’। এরপর রাশিয়ার দপ্রাভদা’, ৩ জানুয়ারি, ১৯৭২
ত্রিশ লাখের কথা উল্লেখ করে। দমর্নিং নিউজ’, ৫ জানুয়ারি ১৯৭২ ত্রিশ লাখের
কথাই আবার উল্লেখ করে সেই সংখ্যাটা পৃথিবীময় ছড়িয়ে দেয়। ঢাকার পত্রিকা
দৈনিক ‘অবজারভার’ শিরোনাম করে এভাবে, ‘পাক আর্মি কিল্ড ওভার ৩০ লাখ পিপল’,
যেটা প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালের ৫ জানুয়ারি, ৪ জানুয়ারি আজাদ পত্রিকাও
‘প্রাভদা’র কথা উল্লেখ করে তাদের সংবাদে। আবার বাংলাদেশের ‘দৈনিক বাংলা’
পত্রিকার ৬ জানুয়ারি, ১৯৭২ ‘জল্লাদের বিচার করতে হবে’ শিরোনামে করা প্রবন্ধ
ত্রিশ লাখ শহীদের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। যেটা প্রকাশিত হয় ৮ তারিখের আগে।
সবগুলো খবরই শেখ মুজিব দেশে আসার আগে প্রকাশিত হয়েছে।
সুতরাং, এটি
স্পষ্ট যে ‘৩০ লাখ’ সংখ্যাটি কোনো আকস্মিক উদ্ভাবন বা ভুল উচ্চারণ নয়। বরং
যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ এবং পাকিস্তানি বাহিনীর
নৃশংসতার মাত্রা দেখে এই সংখ্যাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
এবার আসুন দেখা যাক এত কিছুর পরও বিভিন্ন টাইমলাইনে আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রগুলো কী লিখেছে মুক্তিযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে:
১. একাত্তরের এপ্রিলের শুরুতেই ‘টাইমস’ লিখেছে নিহতের সংখ্যা ৩ লাখ ছাড়িয়েছে এবং বাড়ছে।
২. এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে ‘নিউজউইক’ লিখেছে সাত লাখ।
৩. ১৪ মে দ্য ‘বাল্টিমোর সান’ লিখেছে ৫ লাখ।
৪. ‘দ্য মোমেন্টো’, কারাকাস জুনের ১৩ তারিখে লিখেছে ৫ থেকে ১০ লাখ।
৫. ‘কাইরান ইন্টারন্যাশনাল’ ২৮ জুলাই লিখেছে ৫ লাখ।
৬. ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ ২৩ জুলাইয়ে রিপোর্ট করেছে, সংখ্যাটা ২ থেকে ১০ লাখ।
৭. সেপ্টেম্বরে বলছে ‘টাইমস’ ১০ লক্ষাধিক।
৮. ‘দ্য হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড হাইগেট এক্সপ্রেস’, লন্ডন ১ অক্টোবর বলেছে ২০ লাখ।
৯. ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফি’ সেপ্টেম্বরে লিখেছে নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ।
সংবাদপত্রের
ওপর জোর দিচ্ছি, কারণ যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০ লাখ শহীদের ব্যাপারটা
বাড়াবাড়ি মনে করেন, দাবি করেন সংখ্যাটা অনেক কম এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে
বানানো, তাদের কাছে তুলে ধরতে যে সংখ্যাটা হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠেনি।
আন্তর্জাতিক দৈনিক বলছে এপ্রিলে সাত লাখ, জুলাইতে দশ লাখ, সেপ্টেম্বরে বিশ
লাখ তাহলে ডিসেম্বরে তিরিশ লাখ শহীদ আকাশ থেকে আসা সংখ্যা মনে হওয়ার কোনো
কারণ নেই।
আন্তর্জাতিক গবেষণায় মৃতের সংখ্যা: একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ
মুক্তিযুদ্ধে
নিহতের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা
করেছে। তাদের ফলাফলগুলো ভিন্ন ভিন্ন হলেও, প্রায় সব গবেষণাই ইঙ্গিত দেয় যে
মৃতের সংখ্যাটি বিশাল। এখন আমরা জানব মুক্তিযুদ্ধের ওপর করা বিভিন্ন বিদেশি
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা। যেখানে গণহত্যার পর হতাহতের সংখ্যা
বের করার গাণিতিক সূত্র মেনে মৃত মানুষের সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হওয়া অনেকগুলো গবেষণা থেকে কয়েকটি নিয়ে আলোচনা করা যাক।
১.
‘সেন্টার ফর সিস্টেমেটিক পিস’-এর ডিরেক্টর মার্শাল জোবি, ‘মেজর এপিসোডস অব
পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স ১৯৪৬-২০১৪’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন বাংলাদেশের
মুক্তিযুদ্ধে ১০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে।
২. টেড রবার্ট গার ও বারবারা
হার্ফ দুজন গণহত্যা গবেষক। এদের মাঝে টেড রবার্ট গার বর্তমানে
ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর বারবারা হার্ফ ইউএস নেভি
একাডেমিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক। তারা দুজনই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দিকপাল
হিসেবে পরিচিত। তাদের বিখ্যাত গবেষণা, যেটা পরবর্তী সময়ে পুস্তক হিসেবেও
সমাদৃত হয়, ‘টুয়ার্ড অ্যাম্পিরিক্যাল থিওরি অব জেনোসাইডস অ্যান্ড
পলিটিসাইডস’, প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে। সেই বইতে উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৭১ সালে
বাংলাদেশে ১২ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৩০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে।
৩. মিল্টন
লিটেনবার্গের গবেষণাপত্র, যেটা প্রকাশিত হয় কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে,
‘ডেথস ইন ওয়ারস অ্যান্ড কনফ্লিক্টস ইন দ্য ২০ত সেনচুরি’ শীর্ষক সেই
প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ১.৫ মিলিয়ন অর্থাৎ
১৫ লাখ।
৪. জ্যাক নুস্যান পোর্টার একজন লেখক, গবেষক, সমাজকর্মী এবং যিনি
ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্সের সাবেক ভাইস
প্রেসিডেন্ট, তার সাড়া জাগানো বই ‘জেনোসাইড অ্যান্ড হিউমেন রাইটস’। এই বইতে
গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে শহীদের সংখ্যা ১০
থেকে ২০ লাখ।
৫. ১৯৪৫ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে ৩০০টি আন্তর্জাতিক সংঘাত
সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফ্লিক্ট: আ ক্রোনোলজিক্যাল
এনসাইক্লোপিডিয়া অব কনফ্লিক্টস অ্যান্ড দেয়ার ম্যানেজমেন্ট, ১৯৪৫-১৯৯৫’
বইটিতে। লেখকদ্বয় জ্যাকব বারকোভিচ ও রিচার্ড জ্যাকসন দুজনেই আন্তর্জাতিক
সংঘাত বিশেষজ্ঞ।
৬. গণহত্যা গবেষক টম হার্টম্যান ও জন মিচেল তাদের লেখা
‘আ ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস অব মিলিটারি হিস্টিরি, ১৯৪৫-১৯৮৪’ বইতে বলেছেন
একাত্তরের যুদ্ধে ১০ লাখ মানুষ মারা যায়।
৭. ওয়ার্ল্ড অ্যালামন্যাক,
যাদের বলা হয়ে থাকে তথ্যপঞ্জির জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ, তারা তাদের বেস্ট সেলার
১৯৮৪ সালের সংখ্যায় বলেছে, ১৯৭১ সালের সংঘাতে নিহতের সংখ্যা ১০ লাখ।
৮. কম্পটনস এনসাইক্লোপিডিয়া তাদের গণহত্যা পরিচ্ছদে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা লিখেছে ৩০ লাখ।
৯.
এনসাইক্লোপিডিয়া অ্যামেরিকানা তাদের ২০০৩ সালের সংস্করণে বাংলাদেশ নামক
অধ্যায়ে একাত্তরে নিহত মানুষের সংখ্যা উল্লেখ করেছে ত্রিশ লাখ।
১০. গণহত্যা গবেষক লিও কুপার তার বিখ্যাত ‘জেনোসাইড’ বইতে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে।
১১.
১৯৮১ সালের জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ৩৩তম বছর উপলক্ষে
প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে ‘মানব ইতিহাসে যত গণহত্যা হয়েছে এর মধ্যে
বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের গণহত্যা স্বল্পতম সময়ে সর্ববৃহৎ। গড়ে প্রতিদিন ৬,০০০
থেকে ১২,০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এটি হচ্ছে গণহত্যার ইতিহাসে
প্রতিদিনে সর্বোচ্চ নিধন হার। এই ঘোষণা যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার
প্রায় দশ বছর পরে দেওয়া হয়েছে, সুতরাং গণহত্যা যে ২৬৬ দিন চলেছিল তারা সেটা
জানত। রাউন্ড ফিগার ২৬০ দিন ধরে বাঙালি নিধন হয়েছে ১৫ লাখ ৬০ হাজার থেকে
৩১ লাখ ২০ হাজার পর্যন্ত।
১২. পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী ‘আ প্রোবলেম ফ্রম
হেল: অ্যামেরিকা অ্যান্ড দ্য এইজ অব জেনোসাইড’ গ্রন্থের লেখিকা সামান্তা
পাওয়ার পৃথিবীর বিভিন্ন গণহত্যার খতিয়ান বের করেছেন। বেস্ট সেলার এই বইটিতে
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নিহত মানুষের সংখ্যা বলা হয়েছে ১০ থেকে ৩০ লাখ।
১৩.
বিশিষ্ট রাজনীতিবিজ্ঞানী রুডল্ফ জোসেফ রুমেলের ‘স্ট্যাটিসটিকস অব
ডেমোসাইড’ বইটিকে দাবি করা হয়ে থাকে বিশ্বে গণহত্যা নিয়ে সংখ্যাগতভাবে
অন্যতম কমপ্রিহেনসিভ বই। বইটির অষ্টম অধ্যায়ে ‘স্ট্যাটিসটিকস অব
পাকিস্তান’স ডেমোসাইড এস্টিমেইটস, ক্যালকুলেশনস অ্যান্ড সোর্সেস’ নিবন্ধে
তিনি দেখিয়েছেন বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মুক্তির সংগ্রামে ১৫ লাখ তিন হাজার
থেকে ৩০ লাখ তিন হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি
বিভিন্ন সময় সংখ্যাটা ১৫ লাখ বলেই উল্লেখ করেছেন।
অনেকের মনে খটকা লেগে
থাকতে পারে যে বেশির ভাগ গবেষকের মতে, সংখ্যাটা ১০ থেকে ১৫ লাখের ভেতরে
ঘুরপাক খাচ্ছে। তাদেরকে বলছি, গল্পটা এখানেই শেষ হয়নি। শরণার্থী শিবিরে
নিহত মানুষের বেশির ভাগ গবেষক গণনায় আনেননি। এক কোটি বিশ লাখ মানুষের
স্থানান্তরে প্রচুর মানুষের মৃত্যু অনিবার্য। অনেক গবেষক মনে করেন কেবল
শরণার্থী শিবিরে নিহত মানুষের সংখ্যাই ৬ থেকে ১২ লাখ হতে পারে। এ ছাড়া
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক স্বাস্থ্য এবং জনসংখ্যা বিভাগের অধ্যাপক
রিচার্ড ক্যাশ বলেছেন: ‘আমরা পাবলিক হেলথের লোক হিসাবে যুদ্ধের সরাসরি
প্রাণহানি ছাড়াও কোল্যাটারাল ড্যামেজের দিকে নজর রাখতে চাই এবং এই যুদ্ধের
ফলে প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষকে ঘরছাড়া হয়ে ভারতে পালাতে হয়েছিল, পাঁচ লাখ
মানুষ যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে মারা গিয়েছিল’। এই সব অতিরিক্ত প্রাণহানির দায়
কার, সবই ঈশ্বরের লীলা? নাকি যারা এই যুদ্ধ এনেছিল তাদের?’
সমালোচকরা
প্রায়শই উপসালা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের (বিএমজে)
দোহাই দেন। আসুন, এই গবেষণাগুলোর মেথডোলজি বা পদ্ধতিগুলো ব্যবচ্ছেদ করা
যাক।
সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কনফ্লিক্ট ডেটা প্রোগ্রাম’
অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে নিহতের সংখ্যা প্রায় ৫৮ হাজার। কিন্তু তাদের মেথডোলজির
বড় সীমাবদ্ধতা হলো, তারা কেবল ‘ব্যাটল রিলেটেড ডেথ’ বা সম্মুখ সমরে নিহতদের
গণনা করে। গণহত্যা, বাড়িঘরে আগুন দিয়ে মারা কিংবা নারীদের ওপর সহিংসতা ও
পরবর্তী মৃত্যু-এগুলোকে তারা এই ক্যাটাগরিতে ধরে না। উপসালার ওই একই
গবেষণায় ১৯৯৪ সালের রুয়ান্ডা গণহত্যার বিষয়ে বলা হয়েছে নিহতের সংখ্যা ছিল
১০০০, যেখানে জাতিসংঘের দাবি রুয়ান্ডায় নিহতের সংখ্যা ৯ লাখের বেশি।
অন্যদিকে,
ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল (২০০৮) একটি জরিপ পরিচালনা করে যেখানে বলা হয়
বাংলাদেশে একাত্তরে নিহতের সংখ্যা দুই লাখ ৬৯ হাজার (তিন লাখের কাছাকাছি)।
তাদের পদ্ধতি ছিল ‘সিবলিং হিস্ট্রি’ বা ভাই-বোনের মৃত্যুর ইতিহাস জানা।
পাঁচ হাজার ৫১৫টি পরিবারের ওপর চালানো এই জরিপের মূল সমস্যা হচ্ছে
গণহত্যাপ্রবণ এলাকা এবং গণহত্যা হয়নি এমন এলাকায় জরিপ হলে পুরো ফলাফলে তা
প্রভাব ফেলতে পারে, তাছাড়া যুদ্ধের ৩৭ বছর পর অনেক পরিবারই নিশ্চিহ্ন হয়ে
গেছে বা স্মৃতিভ্রম ঘটেছে। তাছাড়া, যারা পুরো পরিবারসহ নিহত হয়েছে, তাদের
তথ্য দেওয়ার মতো কেউ বেঁচে ছিল না। ফলে এই সংখ্যাটি একটি ‘লোয়ার বাউন্ড’ বা
সর্বনিম্ন সীমা হিসেবে বেশ ভালো গবেষণা হিসেবে গণ্য হতে পারে, কিন্তু
পূর্ণাঙ্গ চিত্র নয়। বরং এই মেথডোলজিতে সারা বাংলাদেশে সাড়ে পাঁচ হাজার
পরিবারের জায়গায় যদি এক লাখ পরিবারের ওপর জরিপ চালানো যায় তাহলে এই
পদ্ধতিতেই সংখ্যাটা দুই মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা যায়।
জনমিতিক পরিসংখ্যান: হারিয়ে যাওয়া ৬৫ লাখ মানুষ
সবচেয়ে
শক্তিশালী প্রমাণ মেলে জনমিতিক উপাত্ত বা ডেমোগ্রাফিক ডেটা বিশ্লেষণে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মৃত্যুর হার নাটকীয়ভাবে বেড়ে গিয়েছিল এবং জনসংখ্যা
বৃদ্ধির হার অস্বাভাবিকভাবে কমে গিয়েছিল।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক রিপোর্ট অনুযায়ী:
১৯৫০-৫৫ সালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১৪.৬ শতাংশ।
১৯৬০-৬৫ সালে ছিল ১৫.৩ শতাংশ।
অথচ ১৯৭০-৭৫ সালে এই হার হঠাৎ কমে দাঁড়ায় মাত্র ৫.৫ শতাংশে।
লন্ডনের
বলস্টেট ইউনিভার্সিটির পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক রহমতুল্লাহ ইমনের
বিশ্লেষণ এবং জাতিসংঘের ডেটা প্রজেকশন অনুযায়ী, ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে
স্বাভাবিক বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশে যে জনসংখ্যা থাকার কথা ছিল, তার চেয়ে
বাস্তবে প্রায় ৬৫ লাখ মানুষ কম পাওয়া যায়। এই ‘মিসিং পপুলেশন’ বা হারিয়ে
যাওয়া ৬৫ লাখ মানুষ কোথায় গেল?
এই ৫ বছরে তিনটি বড় দুর্যোগ ছিল:
১৯৭০-এর জলোচ্ছ্বাস (মৃত ৩-৫ লাখ), ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ (মৃত ১০-১৫ লাখ) এবং
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। জলোচ্ছ্বাস ও দুর্ভিক্ষের সর্বোচ্চ মৃতের সংখ্যা
(পোস্ট-ফেমিনসহ) বাদ দিলেও প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ লাখ মানুষের কোনো হদিশ পাওয়া
যায় না। এই বিশালসংখ্যক মানুষ কেবল যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণেই
হারিয়ে যেতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে সরাসরি হত্যা, শরণার্থী হিসেবে ভারতে
গিয়ে আর ফিরে না আসা এবং যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট মহামারী ও অপুষ্টিতে মৃত্যু।
এই গাণিতিক হিসাব ৩০ লাখের বাস্তবতাকে জোরালোভাবে সমর্থন করে।
শরণার্থী শিবির: যুদ্ধের অদৃশ্য বধ্যভূমি
মুক্তিযুদ্ধে
শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কে প্রায়শই শরণার্থী শিবিরে মারা যাওয়া মানুষদের
হিসাবের বাইরে রাখা হয়। অথচ আন্তর্জাতিক আইন ও যুদ্ধের সংজ্ঞা মতে, যুদ্ধের
কারণে বাস্তুচ্যুত হয়ে অনাহারে বা বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুও ‘যুদ্ধজনিত
মৃত্যু’।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রের (যেমন: নিউজউইক, টাইম, দ্য
গার্ডিয়ান) রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রায় ১ কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল।
সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করে মার্কিন
সিনেটে যে রিপোর্ট পেশ করেন, তাতে তিনি উল্লেখ করেন—শরণার্থীদের মধ্যে শিশু
ও বৃদ্ধের সংখ্যা ছিল ৫০ শতাংশ এবং তাদের মধ্যে মৃত্যুর হার ছিল ভয়াবহ।
মেডিকেল
জার্নাল ‘দ্য ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে (১৯৭২) দেখা যায়,
শরণার্থী শিবিরগুলোতে কলেরার প্রকোপ এবং অপুষ্টির কারণে মৃত্যুর হার ছিল
স্বাভাবিকের চেয়ে বহুগুণ বেশি। জন সার নামক সাংবাদিক লাইফ ম্যাগাজিনে
লিখেছিলেন, ‘শরণার্থীদের পিছে মৃত্যু, সামনে মৃত্যু... শিবিরে কলেরায়
আক্রান্ত হয়ে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে।’
গবেষকদের মতে, শরণার্থী
শিবিরে এবং যুদ্ধের পরোক্ষ প্রভাব তথা কোলাটার্যাল ড্যামেজে ৬ থেকে ১০ লাখ
মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এই মানুষগুলোর মৃত্যুর প্রত্যক্ষ কারণ পাকিস্তানি
বাহিনীর আগ্রাসন। সুতরাং, ৩০ লাখের হিসাবে এই ৬ থেকে ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু
অন্তর্ভুক্ত করা যৌক্তিক ও আবশ্যক।
উইলিয়াম ড্রুমান্ডের ‘২০০০ মৃত্যু’ ও শর্মিলা বসুর বিভ্রান্তি
সম্প্রতি
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত সাংবাদিক উইলিয়াম
ড্রুমান্ডের ‘দ্য মিসিং মিলিয়নস’ (৬ জুন ১৯৭২) নিবন্ধটি উদ্ধৃত করে বলা
হচ্ছে, ১৯৭১ সালে মাত্র ২০০০ মানুষ মারা গেছে। এই দাবিটি ইতিহাসের আংশিক ও
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পাঠের ফল।
ড্রুমান্ড তার নিবন্ধে লিখেছিলেন, মার্চ
১৯৭২-এর তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাধারণ
মানুষের পক্ষ থেকে প্রায় ২০০০ অভিযোগ জমা পড়েছে। এটি ছিল যুদ্ধের মাত্র ৩
মাস পরের চিত্র এবং তখনো প্রশাসনিক কাঠামো পুরোপুরি দাঁড়ায়নি। গ্রামবাংলার
হাজারো মানুষ ঢাকায় এসে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করার মতো অবস্থায় ছিল না। একটি
সদ্য স্বাধীন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে, যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংসপ্রাপ্ত,
সেখানে থানায় বা মন্ত্রণালয়ে জমা পড়া অভিযোগের সংখ্যা দিয়ে মোট মৃতের
সংখ্যা বিচার করা চরম মূর্খতা।
একইভাবে, শর্মিলা বসু তার ‘ডেড রেকনিং’
বইয়ে নিহতের সংখ্যা ৫০ হাজার থেকে ১ লাখের মধ্যে দাবি করেছেন। তার গবেষণার
প্রধান ত্রুটি হলো-তিনি পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকারকে
‘প্রাইমারি সোর্স’ হিসেবে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন এবং ভিকটিম বা তাদের
পরিবারের বয়ানকে ‘আবেগপ্রসূত’ বলে এড়িয়ে গেছেন। এমনকি চুকনগর গণহত্যার মতো
ঘটনায় তিনি প্রত্যক্ষদর্শীদের চেয়ে পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের অস্বীকারসূচক
বক্তব্যকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। তার এই গবেষণা পদ্ধতিগতভাবে
পক্ষপাতদুষ্ট বলে আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচিত হয়েছে।
৯৩ হাজার সৈন্যের পক্ষে কি ৩০ লাখ হত্যা সম্ভব?
একটি
বহুল প্রচলিত যুক্তি হলো—মাত্র ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের পক্ষে ২৬৬
দিনে ৩০ লাখ মানুষ মারা সম্ভব নয়। এই যুক্তিটি গাণিতিকভাবে ও ঐতিহাসিকভাবে
অসার।
১. সহযোগী বাহিনী: শুধু ৯৩ হাজার নিয়মিত সৈন্য নয়, তাদের সঙ্গে
ছিল হাজার হাজার রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্য। তারা স্থানীয়
পথঘাট চিনত এবং হত্যাযজ্ঞে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল।
২. আধুনিক সমরাস্ত্র
বনাম নিরস্ত্র জনতা: স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রধারী একটি বাহিনীর পক্ষে
নিরস্ত্র হাজারো মানুষকে হত্যা করতে খুব বেশি সময় বা জনবলের প্রয়োজন হয় না।
তুলনামূলক জেনোসাইড
-রুয়ান্ডা
(১৯৯৪): মাত্র ১০০ দিনে হুতু উগ্রবাদীরা প্রায় ১০ লাখ তুতসি ও উদারপন্থী
হুতুকে হত্যা করে। তাদের প্রধান অস্ত্র ছিল চাপাতি ও সাধারণ আগ্নেয়াস্ত্র।
যদি ১০০ দিনে ১০ লাখ হত্যা সম্ভব হয়, তবে ২৬৬ দিনে (প্রায় ৯ মাস) ভারী
অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে ৩০ লাখ হত্যা গাণিতিকভাবে অসম্ভব
নয়।
-ন্যানকিং ম্যাসাকার (১৯৩৭): জাপানি বাহিনী মাত্র ৬ সপ্তাহে ৩ লাখ চীনা নাগরিককে হত্যা করেছিল।
-কম্বোডিয়া (১৯৭৫-৭৯): খেমাররুজরা তাদের শাসনামলে মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ মানুষকে হত্যা করেছিল।
বাংলাদেশে
নিহতের হার ছিল মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪ শতাংশ (৭.৫ কোটির মধ্যে ৩০ লাখ)।
রুয়ান্ডা বা কম্বোডিয়ার তুলনায় এই অনুপাতটি অবিশ্বাস্য কিছু নয়।
সংখ্যার ঊর্ধ্বে জেনোসাইডের স্বরূপ
পরিশেষে,
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি করা হয়, তা
কেবল সংখ্যাতাত্ত্বিক নয়, বরং রাজনৈতিক। আমরা যদি সর্বোচ্চ বৈজ্ঞানিক
পদ্ধতি মেনেও নিহতের সংখ্যা নিরূপণ করি-যেমন আর জে রামেলের ১৫-৩০ লাখ,
কিংবা আইসিডিডিআর,বি-এর প্রজেকশন অনুযায়ী ৫-১০ লাখ-তবুও এটি আধুনিক
ইতিহাসের অন্যতম জঘন্যতম গণহত্যা।
৩০ লাখ সংখ্যাটি কেবল একটি অঙ্ক নয়,
এটি পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তির বর্বরতার প্রতীক। আপনি যদি শরণার্থী
শিবিরে কলেরায় মৃত শিশুটিকে, কিংবা বধ্যভূমিতে নাম না জানা কঙ্কালগুলোকে,
কিংবা ধর্ষণের শিকার নারীর যুদ্ধপরবর্তী মৃত্যুকে ‘শহীদ’ বা ‘যুদ্ধজনিত
মৃত্যু’ হিসেবে গণ্য করেন, তবে ৩০ লাখের সংখ্যাটি কোনো মিথ নয়, বরং নিষ্ঠুর
বাস্তব।
যারা আজ ২,০০০ বা ২৬,০০০-এর তত্ত্ব নিয়ে হাজির হন, তারা মূলত
ভিকটিমদের ট্রমাকে অস্বীকার করেন। হলোকাস্টের মৃতের সংখ্যা নিয়ে যেমন
বিতর্ক করাকে অপরাধ ও অমানবিক মনে করা হয়, বাংলাদেশের জেনোসাইড নিয়েও এ
ধরনের লঘুচটুল মন্তব্য ইতিহাস বিকৃতির শামিল। আমাদের উচিত বিদ্যমান
আন্তর্জাতিক গবেষণা ও জনমিতিক উপাত্তগুলোকে সঠিকভাবে অনুধাবন করা। কারণ,
দেশের হাজারো বধ্যভূমি, শহীদ পরিবারে হারানো স্বজনের হাহাকার এবং জনমিতির
‘মিসিং মিলিয়নস’ মিথ্যে বলে না।
লেখক: হেড অফ রিসার্চ, ঢাকা স্ট্রিম। দর্শন, সুফিবাদ ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করেন। লিখিত বইয়ের সংখ্যা ১০।