
রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেশ পিছিয়ে আছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেই লক্ষ্য তারা অর্জন করতে পারেনি। এই প্রেক্ষাপটে বুধবার দেশের বিভিন্ন শপিংমলে শুরু হয়েছে এনবিআরের বিশেষ অভিযান। অভিযানে ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখবে প্রতিষ্ঠানটি।
গত মাসে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-৩অক্টোবর) মোট রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৯ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। তখনই দেখা গেছে, প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক হলেও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় পিছিয়ে আছে এনবিআর। ওই সময়ে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা। সে হিসাবে ঘাটতি দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এরকম ঘাটতির প্রেক্ষাপটে দেশের বিভিন্ন শপিংমলে থেকে এনবিআর অভিযান শুরু করেছে।
এনবিআর বলেছে, শপিংমলের দোকানগুলোর অনলাইন ভ্যাট নিবন্ধন আছে কি না অভিযানে তা যাচাই করে দেখা হবে। নিয়মিত ভ্যাট রিটার্ন দাখিল এবং ভ্যাট পরিশোধের তথ্যও খতিয়ে দেখবে তারা। কোনো প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পাওয়া গেলে জরিমানাসহ পাওনা আদায় করা হবে। ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ ৫০ লাখ টাকার বেশি হলে সেই প্রতিষ্ঠানের হিসাব জব্দ করা হবে। কোনো দোকান অনলাইন ভ্যাট নিবন্ধন না করলে তাৎক্ষণিকভাবে সেই দোকানকে ভ্যাট নিবন্ধন দেওয়া হবে। অভিযান পরিচালনার জন্য এরই মধ্যে এনবিআর একাধিক টাস্কফোর্স গঠন করেছে। টাস্কফোর্সের সদস্যরা বিনা নোটিশে সাধারণ পোশাকে শপিংমলে হাজির হয়ে অভিযান পরিচালনা করবে।
এনবিআর থেকে বলা হয়েছে, শপিংমলের দোকানগুলোর ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এই সংখ্যাটি উল্লেখযোগ্য। এভাবে কোনো কোনো দোকান মালিকের ভ্যাট পরিশোধ না করার প্রবণতা উদ্বেগজনক। গ্রাহকদের দিক থেকে অবশ্য কোনো সমস্যা নেই। তারা পণ্য কিনলেই ভ্যাটসহ মূল্য পরিশোধ করেন। কিন্তু কোনো কোনো দোকানমালিক ভ্যাটের অর্থ এনবিআরকে না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দেন। অনেকে ভ্যাট নিবন্ধন পর্যন্ত গ্রহণ করেননি। অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন না থাকায় এসব দোকান এনবিআরের নজরদারির বাইরে থেকে যাচ্ছে। এনবিআর এবার সেইসব প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করবে, তাদের ভ্যাট নিবন্ধন দেবে। এতে ভ্যাট ফাঁকির প্রবণতা যে কমবে তাতে সন্দেহ নেই।
একটা বিষয় অবশ্য বিস্মিত করছে। খবরের কাগজে প্রকাশিত বিশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, লোকবল সংকটের কারণে এই ধরনের অভিযান না কি এনবিআর নিয়মিতভাবে পরিচালনা করতে পারে না। বিস্ময়ের কারণ হলো, যে-প্রতিষ্ঠান রাজস্ব আদায়ের লাইফলাইন, অর্থ সংগ্রহের উৎস, সেই প্রতিষ্ঠান লোকবল সংকটে ভুগছে। এই অজুহাতে ভ্যাট আদায় বিঘ্নিত হবে, তা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রতিবেদনে উল্লিখিত একটা তথ্য রীতিমতো ভ্যাট আদায়ের সংকটকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। রাজধানী গুলশানের একটি শপিংমলে একবার অভিযান চালিয়ে এনবিআর দেখেছে, ৬৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ৪০টি প্রতিষ্ঠান সঠিক হিসাবে ভ্যাট পরিশোধ করে। অন্যেরা মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রদেয় ভ্যাটের সামান্যই পরিশোধ করেছে। সেখানে ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ ছিল প্রায় আড়াই শ কোটি টাকা। চট্টগ্রামের বিভিন্ন শপিংমলে অভিযান চালিয়ে দেখা গেছে, ভ্যাট ফাঁকির উৎসব চলছে। উল্লেখ্য, দোকানগুলো ক্রেতাদের পকেট কাটছে ঠিকই, কিন্তু ভ্যাটের জন্য প্রদেয় অর্থ সরকারকে দিচ্ছে না।
এক্ষেত্রে একটা বিষয়ের প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এখন উঁচু স্তরের প্রযুক্তির যুগ। ক্রয়প্রক্রিয়াকে যদি রিয়্যাল টাইমে (যখন ক্রয় তখন ভিত্তিতে) গ্রাহক-দোকান-এনবিআরের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়, তাহলে কোনো দোকানি ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ পাবে না। এরকম পদ্ধতি পৃথিবীর অনেক দেশে প্রচলিত আছে। কিন্তু এনবিআর অন্য দেশের এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কেন তাদের ভ্যাট আদায়কে আরও আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর করে তোলেনি, সেটা রহস্য বলেই মনে হয়।
আমরা আশা করব, এনবিআরের এবারের অভিযান যেমনটা বলা হচ্ছে, এ বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে না। আগামী বছরের বিভিন্ন সময়ে আকস্মিক পরিদর্শনের মধ্য দিয়ে ভ্যাটের অর্থ আদায়ে তারা আরও আন্তরিক হবে। বিষয়টি জরুরি এই জন্য যে, ভ্যাট-রাজস্ব আদায়ের মধ্য দিয়েই সরকার অর্থ সংগ্রহ করে, যা রাষ্ট্রের নানা কাজে ব্যবহৃত হয়। অর্থনীতিতে একটা কথা প্রচলিত আছে, যত রাজস্ব আদায় হবে ততই দেশের উন্নতি ঘটবে। এনবিআরের সঙ্গে যুক্ত সবাই কথাটি বিলক্ষণ জানেন। দরকার হচ্ছে এই ধরনের ফাঁকির প্রবণতাকে সম্পূর্ণ রোধ করে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা। দেশের স্বার্থে নিশ্চয়ই তারা তা নিশ্চিত করবেন।
