সৈয়দ মুজিবুর রহমান দুলাল, লাকসাম ।।
আজ
১১ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) বৃহত্তর লাকসাম মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এ দিনে
মুক্তিবাহিনী হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যদের হটিয়ে লাকসামকে শত্রুমুক্ত করেন।
দিবসটি
উপলক্ষে লাকসাম মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন।
কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকালে লাকসাম মুক্তিযোদ্ধা সংসদে জাতীয় ও
মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পতাকা উত্তোলণ, আনন্দ র্যালি, আলোচনা সভা ও বিশেষ
দোয়া মোনাজাত।
লাকসাম মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আহবায়ক ও উপজেলার কান্দিরপাড়
ইউপি'র সাবেক চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী গৃহীত কর্মসূচির
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
লাকসাম মুক্তিযোদ্ধা সংসদ'র সাবেক কমান্ডার মো.
আবদুল বারী মজুমদার জানান, বৃহত্তর লাকসাম উপজেলার (নাঙ্গলকোট,
চৌদ্দগ্রামের কিছু অংশ, সদর দক্ষিণ, মনোহরগঞ্জ ও লালমাই) উত্তরে বিজয়পুর,
পশ্চিমে চাঁদপুর, দক্ষিণে নোয়াখালী ও পূর্বে ভারত সীমান্ত জুড়ে পাকবাহিনীর
বিরুদ্ধে সন্মূখ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন মুক্তিযোদ্ধাগণ।
তিনি জানান,
পাকহানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে লাকসাম রেলওয়ে জংশন এলাকায় সশস্ত্র
বাহিনী গঠণ করা হয়। ওই বাহিনীর দায?িত্ব পালন করেন, কুমিল্লার বুড়িচং
উপজেলার সুবেদার আবদুল জলিল প্রকাশ লাল মিয়া, ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান,
মেজর এনাম আহমেদ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী ফ্লাইট সার্জেন্ট ছিদ্দিকুর
রহমান, ব্রিগেডিয়ার দিদারুল আলম প্রমূখ।
মো. আবদুল বারী মজুমদার জানান,
১৯৭১’র ১০ ডিসেম্বর রাতে ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান’র নেতৃত্বে একদল
মুক্তিযোদ্ধা পূর্বদিকের সীমান্তবর্তী চৌদ্দগ্রাম এবং নাঙ্গলকোট এলাকা দিয়ে
বাঙ্গড্ডা, গৈয়ারভাঙ্গা, হাঁড়াতলী হয়ে লাকসাম প্রবেশ করেন। ওই সময়
হাঁড়াতলীতে পাকহানাদার বাহিনীর সঙ্গে সন্মূখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ওই যুদ্ধে
দেলোয়ার হোসেন, হারুনুর রশিদ, মোখলেছুর রহমান এবং মনোরঞ্জন দাস নামে ৪ জন
মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এ সময় পাকহানাদার বাহিনীর বেশ কিছু সদস্যও মারা যায়।
পরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমনের মূখে পাক হানাদার বাহিনী পিছু হটতে
থাকে। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাগণ লাকসাম শহরে প্রবেশ করেন। ওই সময়
মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ভারতীয় সৈন্যরা যোগ দেয়।
তিনি আরো জানান,
মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সৈন্যদের সঙ্গে অশ্বতলা, মনোহরপুর, কান্দিরপাড়,
রোনোচৌঁ, নোয়াপাড়া, পাশাপুর ও মুদাফরগঞ্জ এলাকায় পাকসেনাদের তুমূল যুদ্ধ
সংঘটিত হয়। এতে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অনেক পাকসেনাও মারা পড়ে।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পাকবাহিনী পরাস্ত হয়ে চাঁদপুরের দিকে
পালিয়ে যায়।
১১ ডিসেম্বর ভোরের সূর্যোদয়ের সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধারা
'জয় বাংলা' শ্লোগাণে লাকসাম শহরে প্রবেশ করলে তাঁদের সঙ্গে মুক্তিকামী জনতা
একত্রিত হয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা নিয়ে তাঁরাও ‘জয় বাংলা’
ধ্বনিতে বিজয় উল্লাস করেন। তবে এ বিজয় উল্লাসেও তাঁদের মধ্যে ছিলো
সহযোদ্ধাদের হারানোর শোক ও বেদনাবোধ।
লাকসাম মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সূত্রে
জানা গেছে, ১৯৭১'র ১৫ই এপ্রিল পাকসেনারা লাকসামকে তাদের দখলে নিয়ে রেলওয়ে
জংশনের পাশে চাঁদপুর টোবাকো কোম্পানি (থ্রি-এ সিগারেট ফ্যাক্টরীতে) ক্যাম্প
স্থাপন করে। এ ক্যাম্প থেকে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার,
আলবদর এবং আলশামস বাহিনীর সহায়তায় বৃহত্তর লাকসামসহ ফেনী, চাঁদপুর,
নোয়াখালী ও কুমিল্লার দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় অত্যাচার, নির্যাতন,
খুন, ধর্ষন এবং ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড চালাতো।
সূত্র জানায়, উপজেলার
কামড্ডা গ্রামের আবুল খায়ের, পৌরসভার মিশ্রি গ্রামের আবদুল খালেককে
পাকহানাদার বাহিনীর দোসরদের মাধ্যমে ধরে নিয়ে লাকসাম থ্রি-এ সিগারেট
ফ্যাক্টরীতে অবস্থিত পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে অমানুষিক
অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে। পরে তাঁদেরকে বেলতলীতে (বধ্যভূমি)
গর্ত করে মাটিচাপা দেন।
সূত্র আরো জানায়, লাকসাম থ্রি-এ সিগারেট
ফ্যাক্টরীতে অবস্থিত পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে নিরীহ মানুষদের ধরে নিয়ে
অমানুষিক অত্যাচার-নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতো। হাজার হাজার নিরীহ
বাঙ্গালীকে হত্যার পর লাকসাম রেলওয়ে জংশনের দক্ষিণে বেলতলীতে মাটি চাপা
দেওয়া হতো। এটিই এখন বেলতলী বধ্যভূমি। প্রায় ১০ হাজার মুক্তিকামী নিরীহ
বাঙালিকে হত্যার পর এ বধ্যভূমিতে মাটি খুঁড়ে পুঁতে রাখা হয়।
বীর
মুক্তিযোদ্ধা মনোহর আলী তোতা জানান, ২৫ মার্চ রাতে পাকহানাদার বাহিনী ঢাকা
শহরে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর গুলি চালিয়ে হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে স্বাধীনতাকামী
লাকসামের দামাল ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পাক হানাদার বাহিনী
কুমিল্লা দখল করে সড়ক পথে লাকসামে আসার সময় মুক্তিসেনারা বিজয়পুর, লালমাই,
বাগমারা, আলীশ্বরে প্রচন্ড বাঁধার সৃষ্টি করে। এ সময় অনেকই শহীদ হন।
এদিকে
মুক্তিযুদ্ধের সময় লাকসামের আজগরা ইউনিয়নের বড়বামে পাকহানাদার বাহিনীর
সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্মূখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে দু'জন মুক্তিযোদ্ধা
শহীদ হন। এ ছাড়াও খিলা রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় চাঁদপুর জেলার হাজিগঞ্জের
দু'জন মুক্তিযোদ্ধা (ছাত্র) যথাক্রমে মো. আনোয়ার হোসেন এবং আকরাম আলী
পাকহানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন। খিলা রেলওয়ে স্টেশনের উত্তর পাশে ওই দুই
বীর সেনানীর কবর রয়েছে।
অপরদিকে লাকসাম নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজের
ছাত্র গজরাপাড়া গ্রামের (বর্তমান মনোহরগঞ্জ উপজেলা) দুই সহোদর মো. মোস্তফা
কামাল ও সোলাইমানকে ধরে নিয়ে যায় পাকহানাদার বাহিনী। আজও তাঁদের কোনো খোঁজ
মিলেনি। দুই সহোদরের স্মৃতি এখনও কেউ ভুলতে পারেননি। এ ছাড়া, কনকশ্রী
গ্রামের (বর্তমান লালমাই উপজেলা) মুক্তিযোদ্ধা খুসরুকে পাকহানাদার বাহিনীর
ধরে নিয়ে পশ্চিমগাঁও নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজের পাশে ডাকাতিয়া নদীর
তীরে গুলি করে হত্যা করেন।
লাকসাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও)
নার্গিস সুলতানা জানান, লাকসাম হানাদার মুক্ত দিবস উপলক্ষে শহীদ ও বীর
মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে এদিন সকাল ১১টায় লাকসাম মুক্তিযোদ্ধা সংসদে আলোচনা
সভা ও বিশেষ দোয়া মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে প্রত্যূষে জাতীয় ও
মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পতাকা উত্তোলণ এবং একটি আনন্দ র্যালি'র আয়োজন করা
হয়েছে।
