
৮ ডিসেম্বর, কুমিল্লা মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয়েছিল কুমিল্লা।৮ডিসেম্বর ভোরে জাতির বীর সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লার কয়েকটি প্রান্ত দিয়ে আনন্দ উল্লাস করে শহরে প্রবেশ করেন। তখন রাস্তায় জনতার ঢল নামে। কুমিল্লার জনগণ জাতির সূর্য সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে বরণ করে নিয়েউল্লাসভরে তাদের স্বাগত জানান। বিকেলে কুমিল্লা টাউন হল মাঠে বীর মুক্তিযোদ্ধা, মিত্রবাহিনী ও জনতার উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
বরাবরের মতো এবারও কুমিল্লা মুক্তদিবস উদযাপনে কুমিল্লায় নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।
‘মুক্তিসংগ্রামে কুমিল্লা’ গ্রন্থের তথ্যানুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে আইন উদ্দিনের নেতৃতা¡ধীন নবম বেঙ্গল ৫ ডিসেম্বর সকালে কুমিল্লা বালুতুপায় এসে অপেক্ষা করতে থাকে। বালুতুপা থেকে ৮ মাইল দূরে পাকসেনারা বাঙ্কার ডিফেন্স নিয়েছিল। নবম বেঙ্গলের অল্প সংখ্যক সৈন্য হওয়ায় তারা পাকিস্তানিদের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি। পাকিস্তানিসেনাদের পিছনের দিক দিয়ে ৬ ডিসেম্বর কুমিল্লা শহরে প্রবেশ করে। কুমিল্লা শহরের পূর্বদিক থেকে ঢুকে নবম বেঙ্গল কুমিলা শহরের পশ্চিম দিকে ৭ ডিসেম্বর দুপুর ১২ টার দিকে পৌঁছে যায়।
দুপুরে বারোটায় ভারতীয় শিখ জাট ব্যাটালিয়ন কমান্ডার টমসনের সঙ্গে আইন উদ্দিনের দেখা হয়। শিখ জাট বাহিনীর কাজ ছিল কুমিলা বিমান বন্দর আক্রমণ করা। শিখজাট ব্যাটালিয়ন বিমান বন্দর আক্রমণ করেছিল ৬ ডিসেম্বর রাতে। রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধ হয় সেখানে। এই আক্রমণে শিখজাট সেনাদের কয়েকজন আহত ও নিহত হয়। পাকসেনারা বিমান বন্দর ছেড়ে চলে যায়। মুলত এর মধ্য দিয়ে মুক্ত হয় কুমিল্লা শহর। নবম বেঙ্গলের কনভয় যখন শহরের পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তখন হাজার হাজার জনতা তাদের স্বাগত জানাতে সামনে আসে। আইন উদ্দিন তাদের বিশৃংখলা সৃষ্টি না করার আহবান জানান এবং বলেন, ‘আমরা আগে শহর সম্পূর্ণ মুক্ত করি’। কিন্তু কেউই তার কথা না শুনলে তিনি বল প্রয়োগ করেন। মনঃক্ষুন্ন হয়ে জনতা ফিরে যায়। ৭ ডিসেম্বর বিকাল পাঁচটায় জেনারেল অরোরা হেলিকপ্টার যোগে কুমিলা বিমান বন্দরে অবতরণ করেন। জেনারেল অরোরা আইন উদ্দিনকে শহরের সম্পূর্ণ শান্তি শৃঙ্খলা আয়ত্তে আনার দায়িত্ব দিয়ে হেলিকপ্টারের পুনরায় ফিরে যান। আইন উদ্দিন শহরে এসেই সমস্ত সোনার দোকান সীল করে দেন। যতদিন পর্যন্ত না বাংলাদেশ সরকারের কোন রকম আদেশ না আসে ততদিন পর্যন্ত পাক আমলের ডি সি নুরুন্নবী চৌধুরী ও এস, পিকে কাজ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেন।
৮ ডিসেম্বর বুধবার প্রত্যুষে কুমিলা শহরকে যেন হালকা, স্বচ্ছ ও পবিত্র বলে মনে হয়। জনগণ আনন্দে উলাসে একে অন্যের সঙ্গে আলিঙ্গন ও ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিতে থাকে। সকাল ৮টায় শহরে উত্তর পূর্ব সীমান্ত থেকে বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষিপ্রতার সঙ্গে শহরে প্রবেশ করে। আনন্দিত উলসিত জনগণ তাঁদের ফুল দিয়ে স্বাধীনতার অভিনন্দন জানায়। সে দিনই বাংলাদেশ সরকারের পূর্বাঞ্চল প্রশাসনিক পরিষদের চেয়ারম্যান জহুর আহমেদ চৌধুরী, পূর্বাঞ্চলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা কাজী রকিব উদ্দিন আহমদ যুব শিবিরের উপদেষ্টা চেয়ারম্যান এডভোকেট আহাম্মদ আলী, যুব শিবিরে পরিচালক প্রশিক্ষণ ডঃ মোঃ হাবিবুর রহমান, আবদুল আজিজ খান এম পি এ, আবদুর রশিদ ইঞ্জিনিয়ার এম পি এ, সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ কুমিলা বিমান বন্দরে পৌঁছান। সেখান থেকে শহরের শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত আইন উদ্দিনকে নিয়ে বিকালে কুমিলা টাউন হলে পৌছান। এসময় বিজয়-উলাস, আনন্দ-বিষাদ মিশ্রিত এক অবর্ণনীয় দৃশ্যের অবতারণা হয়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার মুহূর্তে জহুর আহমেদ চৌধুরী ও এডভোকেট আহাম্মদ আলী যথাক্রমে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন। সে সময় এডভোকেট আহাম্মদ আলীকে কুমিলা জেলা বেসামরিক প্রশাসক নিয়োগের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের মতে, কুমিল্লা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কৌশলগত এলাকা ছিল। কুমিল্লা মুক্ত হওয়ার পর চট্টগ্রাম ও পূর্বাঞ্চলের যুদ্ধ পরিস্থিতি বদলে যায়। মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখযুদ্ধরা বলেন, ৮ ডিসেম্বরের বিজয় চূড়ান্ত স্বাধীনতার পথকে ত্বরান্বিত করেছিল।
কুমিল্লা মুক্তিযুদ্ধকালিন কমান্ডার আবদুল মতিন বলেন, ৩০ লাখ মানুষের প্রাণ এবং বহু মা, বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীন ভূখণ্ড কে আকড়ে ধরতে নতুন প্রজন্মকে বুক চিতিয়ে লড়াই করে যেতে হবে। ১৯৭১ সালের ৯ মে ২ নম্বর সেক্টরের অধীন ক্যাপ্টেন রেজাউল আহমেদের নেতৃত্বে কুমিল্লার কটক বাজারে এক সম্মুখযুদ্ধ হয়। এটি ছিল উল্লখযোগ্য যুদ্ধের মধ্যে প্রথম। পাকিস্তানি বাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব ও ৩৯ বেলুচ রেজিমেন্টের বিরুদ্ধে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অন্তত ১৭০ জন সৈন্য নিহত হয়। বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী কুমিল্লার কটক বাজারের এ সরাসরি যুদ্ধে মুক্তিকামী বাঙালির ৭ জন বীরযোদ্ধা শহিদ হন। যুদ্ধের পরে ৩ জন বীর শহিদের লাশ সনাক্ত করা গেলেও বাকী ৪ জন শহীদের মরদেহ পাওয়া যায়নি। এ সম্মুখযুদ্ধের পর যেভাবে মুক্তকামী জনতা কুমিল্লাজুড়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছেন। পরে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখলমুক্ত হয় কুমিল্লা বিমান বন্দরের এক ঐতিহাসিক ভযাবহ যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে। হাতে ধরা দেয় বিজয়। যা আজও মনে পড়লে চোখের কোনে পানি জমাট বাঁধে।
কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরে আলম ভূঁইয়া বলেন, একাত্তরের ৮ ডিসেম্বর ভোরে কুমিল্লা হানাদার মুক্ত হয়। আগরতলা সোনামুড়া থেকে সেদিন অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পায়ে হেঁটে কুমিল্লায় প্রবেশ করি। অগ্রবর্তী দল হিসেবে ছিল নবম বেঙ্গলের মুক্তিসেনারা। আক্রমণের নেতৃত্বে ছিল ১১ গুর্খা রেজিমেন্ট। কুমিল্লার আপামর জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে মুক্তির উল্লাসে বরণ করে নেয়। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয় কুমিল্লা। এদিন বিকেলে কুমিল্লা টাউন হল মাঠে তৎকালীন পূর্বাঞ্চলের প্রশাসনিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মরহুম জহুর আহমেদ চৌধুরী দলীয় পতাকা ও কুমিল্লার প্রথম প্রশাসক অ্যাডভোকেট আহমদ আলী স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
এদিকে কুমিল্লা মুক্তদিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে কুমিল্লায় নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষ্যে ৮ ডিসেম্বর বিকেলে কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের আয়োজনে বর্ণাঢ্য আনন্দ র্যালি অনুষ্ঠিত হবে।
