
অপরিকল্পিত নগরায়ণ দখল আর দূষণের
কষাঘাতে রাজধানীর পার্কগুলো। প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের একটু মানসিক স্বস্তি ও
প্রশান্তির ঠিকানায় ছিল যে জায়গাটি সেগুলোও দখল, দূষণ ও অবহেলায় হারিয়ে
যেতে বসেছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, তদারকির ঘাটতি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে
অধিকাংশ পার্কই পরিত্যক্ত, জরাজীর্ণ ও অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। জীববৈচিত্র্যও
হুমকির মধ্যে পড়েছে। সম্প্রতি আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লক্ষ্য করেছি,
কংক্রিটের শহর ঢাকায় বাসাবাড়িতে ভয়ংকর বিষধর সাপের সন্ধান পাওয়া গেছে।
এমনকি অভিজাত এলাকাগুলোতেও দেখা মিলছে সাপের। গত তিন মাসে ৩ শতাধিক সাপ
উদ্ধার করা হয়েছে। একটি দৈনিকের প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশ অ্যানিমেল
ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন গত তিন মাসে ৩২২টি সাপ উদ্ধার করেছে। অর্থাৎ গড়ে
প্রতিদিন তিনটি করে সাপ উদ্ধার করেছে তারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক
ভারসাম্যহীনতার ফল এটি। নগর যত বাড়ছে গাছপালা ও জলাশয় তত কমছে। সবুজ
পার্কগুলো ধ্বংস করা হচ্ছে। ফলে খাদ্য ও আশ্রয়ের খোঁজে সাপ মানুষের
বসতবাড়িতে ঢুকে পড়ছে। নগর করতে গিয়ে আমরা প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের
আবাসভূমি নষ্ট করছি। পরিবেশবিদরা বলছেন, দখল ও অপরিচ্ছন্নতায় শুধু মানুষ
নয়, শহরের ছোট প্রাণী, পাখি, মৌমাছি ও প্রজাপতির জীবনেও তৈরি হয়েছে
মারাত্মক সংকট। ঢাকার সবুজ পরিবেশ এখন সবচেয়ে বড় হুমকির মুখে। পরিবেশবিদরা
উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, যদি দ্রুত সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ, দখলমুক্তকরণ ও
নিরাপত্তাব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে শহরের জনজীবন ও পরিবেশগত ভারসাম্য
দুই-ই মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি)
তথ্য মতে, তাদের আওতায় রয়েছে ২৩টি পার্ক, চারটি শিশু পার্ক ও আটটি খেলার
মাঠ। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অধীনে রয়েছে ২০টি পার্ক ও ১৯টি
খেলার মাঠ। এগুলোর বেশির ভাগই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে বা পড়ছে। এসব
পার্কে প্রায়ই নোংরা পানি ও ময়লার স্তূপ চোখে পড়ে। উন্নয়নের নামে
ক্ষতবিক্ষত হয়েছে পার্কগুলো। ব্যবহারের অনুপযোগী পার্কে কিশোর গ্যাং,
মাদকসেবী ও অপরাধীদের আড্ডাস্থলে পরিণত হচ্ছে। রাত যত গভীর হয় তত বাড়তে
থাকে অনৈতিক কার্যকলাপ। কারওয়ানবাজার, পান্থপথ, বাংলামোটর, কাঁঠালবাগান
অঞ্চলের মাঝের এলাকায় পান্থপুঞ্জ পার্ক অবস্থিত। দীর্ঘদিন জনসাধারণের
ব্যবহারের অনুপোযোগী হওয়ায় অপরাধীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে
পান্থকুঞ্জ পার্কটি। এ পার্কের আশপাশের এলাকার মানুষ সব সময়
নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। ছিনতাইকারী এবং মাদকসেবীদের জন্য অভয়ারণ্য এলাকা।
অজানা কারণে প্রায় আট বছর ধরে পার্কটি বন্ধ রয়েছে। রাজধানীর ফুসফুস বলে
পরিচিত ওসমানী উদ্যানেও একই অবস্থা। ধানমন্ডি শিশু পার্কও বেহাল হয়ে পড়েছে।
তাহলে আমাদের শিশুরা বিনোদনের জন্য কোথায় যাবে। পার্কের ঠিক গা-ঘেঁষে বড়
ময়লার ভাগাড় তৈরি করেছে সিটি করপোরেশন। এসব আবর্জনা থেকে দুর্গন্ধে পুরো
এলাকা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। মশা-মাছির প্রকোপ বেড়েছে। ফলে পার্কে বেড়াতে আসা
মানুষ ও পথচারীরা নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। জিয়া উদ্যানেও বিভিন্ন
স্থানে পর্যাপ্ত আলো নেই। রাত নামলেই উদ্যানটি অন্ধকারে ঢেকে যায়। ফলে
সেখানে চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পার্কের এ অবনতি
ধীরে ধীরে শহর ধ্বংসের সূচনা। যেখানে আগে বিভিন্ন জাতের পাখি, প্রজাপতি,
মৌমাছিসহ নানা প্রাণীর দেখা পাওয়া যেত, সেখানে এখন তাদের অস্তিত্ব ক্রমশ
কমছে। সবুজের হ্রাস মানে বায়ুদূষণের হার বেড়ে যাওয়া। আর এতে করে মানুষের
স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব
প্ল্যানার্স (বিআইপি)-এর সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ বলেন,
অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে আমাদের পার্কগুলো ধ্বংসের মুখে। উদ্যান
প্রকল্পের ডিজাইন কখনোই জনসাধারণের সামনে প্রকাশ করা হয় না। রাষ্ট্রের
আগ্রহ থাকার প্রয়োজন, যা অনুপস্থিত। ঢাকায় যেখানে সবুজ এলাকা অত্যন্ত কম,
সেখানে একটি উদ্যানের উন্নয়ন ডিজাইন করতে ৮-১০ বছর লাগানো কোনোভাবেই
ইতিবাচক নয়।
সবুজ বাঁচানোর দায়িত্ব আমাদের সবার। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক
নেতা-কর্মী ও জনসাধারণকে সচেতন হতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে
দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। উন্নয়নের নামে প্রকল্প বরাদ্দের সুষ্ঠু
তদারকি নিশ্চিত করতে হবে। পরিবেশ সুরক্ষায় যতটুকু সবুজ থাকা প্রয়োজন সেটি
নিশ্চিত করতে হবে। অবাধে ঢাকার ফুসফুস ধ্বংসের চেষ্টা বন্ধ করতে
দল-মতনির্বিশেষে সবাইকে একত্র হয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
