মনির
হোসেন(৩৮)। দুই মেয়ে সন্তানের জনক। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার চিওড়া
ইউনিয়নের হস্তিমৃতা গ্রামের মরহুম মোখলেছুর রহমানের ছেলে। ঝরাজীর্ণ টিনসেড
ঘরে বসবাস করতেন। ২০২১ সালের ৭ মার্চ জীবিকার তাগিদে বৈধভাবে সংযুক্ত আরব
আমিরাতের আবুধাবি গিয়েছিলেন। তিনি সেখানে রুটির কারিগর হিসেবে চাকরি করতেন।
তাঁর পাঠানো রেমিট্যান্সে ভালোই চলছিল দেশে থাকা স্ত্রী ও দুই মেয়েসহ
স্বজনরা। চলতি বছরের গত ২৯ অক্টোবর আবুধাবিতে নিজ বাসায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া
বন্ধ হয়ে মনির হোসেন ইন্তেকাল করেছেন। হঠাৎ তাঁর সংসারে নেমে এলো আকাশ
ভাঙা শোক। দুর্ভাগ্যের বিষয়, প্রবাসীদের আর্থিক সহযোগিতায় দেশে আনা হয় মনির
হোসেনের লাশ। স্বজন ও সচেতন মহলের প্রশ্ন, সরকার কি এতই গরীব, বৈধভাবে
বিদেশ যাওয়া রেমিট্যান্সযোদ্ধার লাশ প্রবাসীদের থেকে সহযোগিতা করা টাকায়
আনতে হবে? অনেকে মন্তব্য করেন, বিদেশে মরেও শান্তি নেই প্রবাসীদের।
সরেজমিন
পরিদর্শনকালে মনির হোসেনের স্ত্রী আফরোজা আক্তার রুজিনা বলেন, মনির হোসেন
দেশে ছুটিতে এসে ২০২৪ সালের ২৭ জুলাই আবার আবুধাবি যান। তাঁর পাঠানো টাকায়
আমাদের সংসার ভালোই চলছিল। গত ২৯ অক্টোবর আবুধাবি নিজ বাসায় হৃদযন্ত্রের
ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান। লাশ দেশে আনতে স্বজনরা বাংলাদেশ দূতাবাসে
যোগাযোগ করলে কোন ফান্ড নেই বলে জানায়। পরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থানরত
চৌদ্দগ্রামের প্রবাসীদের সহায়তায় ৫ নভেম্বর মনির হোসেনের লাশ দেশে আনা হয়।
সেদিন নামাজে জানাযা শেষে তাঁর লাশ স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়। মনির
হোসেন মারা যাওয়ার সাথে সাথে বন্ধ হয়ে গেছে পরিবারের টাকা উপার্জনের পথ।
তাঁর বড় মেয়ে সাবরিনা আক্তার(১৪) ধোড়করা জামেয়া আমেনা মহিলা মাদরাসার সপ্তম
শ্রেণীতে ও ছোট মেয়ে হাবিবা আক্তার হস্তিমৃতা দারুল উলুম মাদরাসার প্রথম
শ্রেণীতে পড়ে। মনির হোসেনের মৃত্যুর পর অর্থনৈতিক সঙ্কটে তাদের পড়ালেখা
বন্ধের পথে। তিনি অভিযোগ করেন, স্বামীর লাশ দেশে আনতে দূতাবাসের
কর্মকর্তারা আমার ভাইকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা করেনি।
একইভাবে সৌদিআরব,
ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, জর্ডান, লেবাননসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ
থেকে লাশ আনতে প্রবাসী ও এলাকাবাসীর সহযোগিতা চায় অধিকাংশ নিহতের পরিবার।
কারণ, পরিবারের সর্বশেষ ইচ্ছা হলো লাশটি একবার দেখা ও এলাকায় কবর দেয়া।
সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তর বলছে, লাশ দেশে আনতে সরকার পর্যাপ্ত
সহযোগিতা করে। কিন্তু নিহতদের অধিকাংশের পরিবার সরকারের সহযোগিতা না চাওয়ায়
সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা।
দুবাই প্রবাসী ব্যবসায়ী ও জাহাঙ্গীর আলম
সাহেদ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা আবুল কালাম আজাদ রাসেল বলেন, বিদেশের
মাটিতে কোন রেমিট্যান্সযোদ্ধা মারা গেলে নিজস্ব খরচেই লাশ দেশে নিতে হয়।
যাদের স্বজন বা নিজের পরিবারের টাকা নেই, তারা বিদেশে মারা গেলে বেওয়ারিশ
হিসেবেই সে দেশের মর্গে লাশ পড়ে থাকে। তবে লাশ দেশে আনতে বাংলাদেশের
দূতাবাস কোন ব্যবস্থা নেয় না। দূতাবাস কর্মকর্তারা বলেন, লাশ নেয়ার জন্য
সরকারের কোন ফান্ড নেই। এদিকে বৈধভাবে রেমিট্যান্স আহরণ করতে বিদেশ গিয়ে
মারা গেলে লাশ দেশে আনতে সরকারের উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানান প্রবাসী রাসেল।
চৌদ্দগ্রাম
সম্মিলিত স্বেচ্ছাসেবী ফোরামের মোহাম্মদ হোসেন নয়ন বলেন, বিদেশের মাটিতে
বছরের পর বছর কঠোর পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করে থাকেন প্রবাসী
বাংলাদেশিরা। আর প্রবাসীরা তাঁদের কষ্টের রেমিট্যান্স বাংলাদেশে পাঠিয়ে
দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন। কিন্তু সেই প্রবাসীদের মধ্যে যদি কেউ
বিদেশের মাটিতে মারা যান, তখন সেই লাশ বিদেশের কোনো না কোনো হাসপাতালের
মর্গে অবহেলায় দিনের পর দিন ও মাসের পর মাস পড়ে থাকে। যেন বিদেশে মরেও
শান্তি নেই প্রবাসীদের। মারা যাওয়ার পর প্রবাসীর লাশ হয়ে ওঠে ভোগান্তির অপর
নাম। আর পরিবারের কাছে উৎকণ্ঠা আর আহাজারি। বিদেশ থেকে একজন প্রবাসীর লাশ
দেশে ফেরত আনতে ফ্লাইট খরচের টাকা জোগাড়, নিজের দেশ ও দূতাবাসের কাগজপত্র
সংগ্রহ, জমা দেওয়া এবং অনেক নিয়মকানুন শেষ করে লাশ দেশে আসতে পেরিয়ে যায়
অনেকটা সময়। নিজ দেশের পরিবার পরিজনের কাছে ততক্ষণে ওই মৃত্যু সংবাদ হয়তো
অনুভূতিশূন্য একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আবার কখনো কখনো বিদেশের মাটিতে
বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হয়ে যায় হতভাগ্য প্রবাসীর লাশ।
ইমপ্রুভ
সাসটেইনবেল রিইন্টিগ্রেশন অব বাংলাদেশ রিটার্নি মাইগ্রেন্টস্ এর ফিল্ড
সুপারভাইজার মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, প্রবাসী কর্মীরা মারা গেলে মৃতদেহ
দেশে আনার জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় সরকার। বিমানবন্দরে লাশ
হস্তান্তরের সময় সেটি পরিবহন ও দাফনের খরচ হিসেবে দেওয়া হয় সরকারি অনুদান।
এছাড়া মৃত প্রবাসী কর্মীর পরিবারের জন্য আর্থিক অনুদান আর মৃত্যুজনিত
ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যবস্থাও করে থাকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান
মন্ত্রণালয়। তাদের অধীন সংস্থা ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মাধ্যমে এসব
সুবিধা পান প্রবাসী কর্মীর স্বজনরা। তবে নিহতের স্বজনদের আবেদনের
প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রবাসীদের পক্ষে কাজ করে। নিয়ম না জানার
কারণে অনেকেই সরকারি এই সুবিধা আদায় করতে পারছে না। সরকারের উচিত, এ নিয়ে
প্রচার-প্রচারণা বাড়ানো।
কুমিল্লা জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি রপ্তানি
অফিসের জনশক্তি জরিপ কর্মকর্তা মোঃ তাজুল ইসলাম বৃহস্পতিবার বলেন, বিদেশে
রেমিট্যান্সযোদ্ধা মারা গেলে পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে লাশ দেশে আনতে
সর্বাত্মক সহযোগিতা করে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। এজন্য সরকারের টোল
ফ্রি ১৬১৩৫ ও +৮৮০৯৬১০১০২০৩০ নাম্বারে কল করে জীবিত প্রবাসী ও মৃত প্রবাসীর
পরিবার সর্বাত্মক সহযোগিতা পেতে পারে।
