কুমিল্লা টাউন হল মাঠে একই দিনে বিএনপির দুই গ্রুপের সমাবেশ ঘিরে দিনভর টানটান উত্তেজনা বিরাজ করলেও শেষ পর্যন্ত তা শান্তিপূর্ণভাবেই সমাপ্ত হয়েছে। একই দিনে কাছাকাছি সময়ে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী মনিরুল হক চৌধুরী গ্রুপের জনসভা এবং সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশী হাজী আমিন উর রশিদ ইয়াছিন গ্রুপের মিলাদ ও আলোচনা সভাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত প্রশাসনের নির্দেশনায় টাউন হল মাঠ থেকে সমাবেশস্থল সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় দুটি গ্রুপ। এরপর নগরীর পূবালী চত্ত্বর এবং কান্দিরপাড় বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে পৃথক সমাবেশ করেন দুই গ্রুপের নেতারা।
বৃহস্পতিবারের দুই পক্ষের সমাবেশকে ঘিরে বুধবার থেকেই শহরজুড়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করে। টাউন হল মাঠের দুই পাশে অবস্থান নিয়ে স্লোগান ও মিছিল করে মাঠজুড়ে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে থাকে স্ব স্ব গ্রুপের কর্মী সমর্থকরা। শহরজুড়ে তৈরি হয় ভীতিকর পরিস্থিতি। সেই প্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কায় সন্ধ্যার পর থেকেই মাঠে অবস্থান নেয় আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা। দুই পক্ষের নেতাদেরকে টাউন হল ব্যাতীত অন্য জায়গায় সমাবেশের পরামর্শ দেওয়া হলেও তারা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত মানতে অনীহা প্রকাশ করায় রাত সাড়ে ১১টার দিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয় কোনো গ্রুপই টাউন হল মাঠে সমাবেশ করতে পারবে না।
এরপর বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই টাউন হল গেইটে একে একে প্রবেশ করতে থাকে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। এদিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে টাউন হলের ভিতরে এবং বাইরে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর শতাধিক ফোর্স মোতায়েন করা হয়। এছাড়াও নগরীর গুরত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে অবস্থান নেন পুলিশ সদস্যরা। সেই সাথে শহরজুড়ে বিরামহীন টহলে থাকে সেনাবাহিনী ও র্যাব সদস্যরা।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে দুপুর বারোটার দিকে হাজী আমিন উর রশিদ ইয়াছিন সমর্থকদের পক্ষ থেকে জানানো হয় তাদের কর্মসূচি তারা পালন করবেন কান্দিরপাড় বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের সামনে। এর ঘন্টাখানেক পর মনিরুল হক চৌধুরীর সমর্থকরা ঘোষণা দেন তাদের পূর্বঘোষিত সমাবেশ টাউন হলের পরিবর্তে পূবালী চত্ত্বরে অনুষ্ঠিত হবে। এবার প্রায় ১০০ গজের মধ্যে দুটি সমাবেশ একই সময়ে ঘোষণা হওয়ায় নগরজুড়ে আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা আরো বেড়ে যায়।
বিকেল ৩টার পর থেকেই সড়কে সড়কে স্লোগান-মিছিলে নেতা-কর্মীদের স্রোত তৈরি হয় দুটি সমাবেশের দিকে। বেলা সোয়া তিনটার দিকে একটি গাড়িতে করে কান্দিরপাড় দলীয় কার্যালয়ের সামনে আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী দলের চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা হাজী আমিন উর রশিদ ইয়াছিন। এসময় তার সমর্থকদের আনন্দ-স্লোগানে মুখর হয়ে উঠে সমাবেশস্থলের চারপাশ। দলে-দলের সভাস্থলে যোগ দেন নারী-পুরুষসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষ। নেতা-কর্মীদের উপস্থিতিতে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে লিবার্টি চত্ত্বর থেকে ভিক্টোরিয়া কলেজ উচ্চমাধ্যমিক শাখা পর্যন্ত পুরো সড়ক। উপস্থিত নেতা-কর্মীরা স্লোগানে স্লোগানে হাজী আমিন উর রশিদ ইয়াছিনকে আগামী নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানান। তারা মনে করে হাজী ইয়াছিন দলের মনোনয়ন পেলে মূল্যায়িত হবেন তৃণমূলে ত্যাগী নেতা-কর্মীরা।
এদিন হাজী আমিন উর রশিদ ইয়াছিনের সমাবেশে প্রথমবারের মতো অংশ নিতে দেখা যায় কুমিল্লা মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ মোল্লা টিপুসহ দলীয় পদবীধারী অনেক নেতাকে। এর মধ্যে বিএনপি নেতা এস এ বারী সেলিম, জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহবায়ক মাহাবুব চৌধুরী, আতাউর রহমান ছুটি, মজিবুর রহমান কামাল, সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি রেজাউল কাইয়ুম, সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম রায়হান, জেলা যুবদলের আহবায়ক আনোয়ারুল হক, সদস্য সচিব ফরিদ উদ্দিন শিবলু, মহানগর যুবদলের সাধারণ সম্পাদক রোমান হাসান, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি সৈয়দ মেরাজ, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক একেএম শাহেদ পান্না, মহানগর ছাত্রদলের সভাপতি নাহিদ রানা, জেলা ছাত্রদলের সভাপতি জুবায়ের আলম জিলানী, সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক ধীমান, মহানগর ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসমাইল হোসেন, জেলা ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক রবিন খানসহ নেতৃবৃন্দ।
অপরদিকে ঠিক একই সময়ে অন্য পথ ধরে পূবালী চত্ত্বরে মনিরুল হক চৌধুরীর সমাবেশে যোগ দিতে থাকেন নেতাকর্মীরা। বিকেল সাড়ে তিনটায় একটি গাড়িতে চড়ে সমাবেশ স্থলে আসেন বিএনপির প্রার্থী দলের চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মনিরুল হক চৌধুরী। তিনি মঞ্চে প্রবেশের পরপরই নেতা-কর্মীরা বাধভাঙ্গা স্লোগানে উল্লাসে মেতে উঠেন। এসময় হাত নেড়ে নেতা-কর্মীদের শুভেচ্ছা জানান মনির চৌধুরী। কুমিল্লার পূবালী চত্ত্বর থেকে লাকসাম সড়কমুখী এ সমাবেশে কর্মী-সমর্থকদের উপস্থিতি ছিলো চোখে পড়ার মতো।
স্লোগানে মুখরিত সমাবেশে উপস্থিত নেতা-কর্মীদের দাবি মনিরুল হক চৌধুরী হচ্ছেন তাদের আস্থার প্রতীক। তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে কুমিল্লার উন্নয়নে ভূমিকা রাখবেন।
সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন বিএনপির কুমিল্লা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ সেলিম ভূইয়া। বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মনিরুল হক চৌধুরী ছাড়াও এ সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম, কুমিল্লা মহানগর বিএনপির সভাপতি উদবাতুল বারী আবু, দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান মাহমুদ ওয়াসিম, সাবেক যুগ্ম আহবায়ক আমিরুজ্জামান আমীর, জেলা জজ আদালতের পিপি এডভোকেট কাইমুল হক রিংকু, জেলা কৃষকদলের সভাপতি মোস্তাফা জামান, সদর দক্ষিণ উপজেলা বিএনপির সভাপতি এডভোকেট আক্তার হোসেনসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
দিনভর উৎকণ্ঠা শেষে হাজী আমিন উর রশিদ ইয়াছিন তার সমাবেশ থেকে ঘোষণা করেন আজ থেকে আবারো গণসংযোগে নামছেন তিনি। নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে দৃঢ়তার সাথে বলেন, ‘আমি আপনাদের সাথে ছিলাম, আছি এবং থাকবো।’
একই সময়ে পূবালী চত্ত্বরের সমাবেশ থেকে বিএনপির প্রার্থী মনিরুল হক চৌধুরী একবার তাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করার আবেদন জানিয়ে বলেন, ‘নির্বাচিত হলে এই মহানগরীর অভূতপূর্ব উন্নয়ন হবে। দল আমাকে মূল্যায়ন করেছে, দলের সম্মান আমি রাখবো।’