কুমিল্লার চান্দিনায় প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও মাদ্রাসা পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে দীর্ঘ দিনের শিক্ষক সংকটে শিক্ষা ব্যবস্থায় নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ওই তিন স্তরের অফিসগুলো পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় সুষ্ঠু তদারকির অভাবে শিক্ষা ব্যবস্থায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। দিনে দিনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে পাশের হার কমে যাওয়ারও প্রবণতা দেখা দিয়েছে। কয়েক বছর আগে জাতীয়করণ করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতেও বেহাল দশা সৃষ্টি হয়েছে। নতুন বছরে ছেলে-মেয়েদের ভর্তি নিয়ে অভিভাবকদের মনে শংসয় দেখা দিয়েছে।
১৩টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত ২০২ বর্গ কিলোমিটার চান্দিনা উপজেলায় ১৩৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৩৫টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ২৭টি মাদ্রাসা রয়েছে। উপজেলার ১৩৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৪৪টিতে নেই প্রধান শিক্ষক। সহকারী শিক্ষক পদেও শূন্যপদ ৪২টি। উপজেলার ৩৫টি উচ্চ বিদ্যালয়ের মধ্যে ১০টিতে প্রধান শিক্ষক নেই। প্রশাসনিক শূন্যতার কারণে এসব বিদ্যালয়ের কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরে ভারপ্রাপ্তদের ওপর নির্ভরশীল। এছাড়া মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসেও নেই সহকারী মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, যার ফলে বিদ্যালয় তদারকি, পাঠ্যসূচি বাস্তবায়ন এবং ফলাফল বিশ্লেষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো পুরোপুরি ব্যাহত হচ্ছে। ২৭টি মাদ্রাসার মধ্যে ৪টিতে নেই সুপার।
উপজেলার ৩৫টি উচ্চ বিদ্যালয়ের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উপজেলা সদরের চান্দিনা সরকারি মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। যে বিদ্যালয়টিতে বছরের শুরুতে ৩-৪শ নতুন শিক্ষার্থী ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হতো, দুই থেকে আড়াইশ শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে উপজেলা পর্যায়ের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতো, সেই প্রতিষ্ঠানটি জাতীয় করণ করার পর এখন ধুকে ধুকে চলছে! ওই বিদ্যালয়টিতে এমপিও ভূক্ত শিক্ষক ছিল ৩০-৩৫ জন, বর্তমানে ওই বিদ্যালয়ে আছে মাত্র ৫ জন ও কারিগরি শাখায় আছেন ৬জন । প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য প্রায় ১১ বছর।
প্রাথমিক শিক্ষা অফিসেও জনবল সংকট প্রকট। নেই একজন সহকারী শিক্ষা অফিসার। পাশাপাশি নেই পিয়ন, হিসাবরক্ষক ও এলডিএ। ফলে নথিপত্র, পরিদর্শন, প্রশিক্ষণ কার্যক্রমসহ অফিসের নিয়মিত কাজ ব্যাহত হচ্ছে। মাঠপর্যায়ে নজরদারি কমে যাওয়ায় বিদ্যালয়গুলোর অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা আরও প্রকট হয়ে উঠছে।
শিক্ষক নিয়োগ না হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষককেই একাধিক শ্রেণির দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এতে ক্লাস নেওয়ার গতি কমে যাচ্ছে এবং শেখার মান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
করতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা সাথী রাণী দেবনাথ বলেন, “প্রধান শিক্ষক না থাকায় আমি একাধারে শিক্ষকতা ও প্রশাসনিক কাজ দুইটাই করতে হয়। এতে ক্লাসে পুরো মনোযোগ দেওয়া যায় না, শিক্ষার্থীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
চান্দিনা সরকারি মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নিখিল চন্দ্র ভৌমিক জানান- একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হচ্ছে অভিভাবক। উপজেলা সদরের গুরুত্বপূর্ণ এই বিদ্যালয়টিতে ১১ বছর যাবৎ প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন একাধিক সহকারী শিক্ষক! অপরদিকে বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ করার পর অনেক শিক্ষক অবসরে গেছেন। এখন বিদ্যালয়টিতে চরম শিক্ষক সংকটে পাঠদানে আমাদের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।
মাদ্রাসা স্তরেও একই চিত্র। উপজেলার ২৭টি মাদ্রাসার মধ্যে ৪টিতে নেই সুপার। প্রয়োজনীয় শিক্ষক সংকট, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও তদারকির সীমাবদ্ধতার কারণে মাদ্রাসা শিক্ষার মানও ক্রমশ নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে।
চান্দিনা উপজেলা সদরের বাসিন্দা ফিরোজা বেগম জানান- আমরা উপজেলা সদরেই বসবাস করি। আমার ছেলে এবছর ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হবে। কিন্তু চান্দিনা উপজেলা সদরের পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়টিতে মাত্র ৬০ জন ছেলে ভর্তি করানো হয়। তাও আবার লটারীতে! কিন্তু এ বিদ্যালয়ের লেখাপড়া আগের তুলনায় সিকি আনাও নেই। যে বিদ্যালয়ে শিক্ষক নেই সেখানে তো লেখাপড়া হবে না এটাই স্বাভাবিক। এখন ছেলেকে কোথায় ভর্তি করাবো এ নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় আছি।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা মনে করেন- জনবল শূন্যতার কারণে নিয়মিত পাঠদান, মূল্যায়ন, ক্লাসপরিকল্পনা এবং শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি নিরীক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। অভিভাবকেরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, শিক্ষক সংকটের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব তাদের সন্তানদের শেখার পরিবেশ পুরোপুরি নষ্ট করে দিচ্ছে।
এদিকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চান্দিনায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষার ফলাফল ধারাবাহিকভাবে নিম্নমুখী। শিক্ষক সংকট, তদারকির অভাব এবং প্রশাসনিক দুর্বলতাকে ফলাফল খারাপ হওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।শিক্ষাবিদদের মতে, জরুরি ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ, শূন্যপদ পূরণ, প্রশাসনিক কাঠামো শক্তিশালীকরণ এবং তদারকির পরিধি বাড়াতে না পারলে চান্দিনার শিক্ষা ব্যবস্থা আরও পিছিয়ে পড়বে।
কুমিল্লা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার তাপস কুমার পাল জানান- শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি অধিদপ্তর থেকে হয়। সার্কুলেশন হয়েছে, লিখিত ও ভাইবা শেষে শূন্যপদে নিয়োগ হবে। প্রধান শিক্ষকের প্রমোশন পিএসসি থেকে অনুমোদন লাগে। আর সারা বাংলাদেশের শিক্ষা অফিসগুলোতে শূন্য পদ রয়েছে।আমরা চাহিদা পাঠিয়েছি। আশা করছি, দ্রুত সমাধান হবে।
