
দেশে মানুষের মধ্যে ভয়াবহ অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। সম্প্রতি রাজশাহী মহানগর দায়রা জজ আব্দুর রহমানের বাসায় ঢুকে তার স্কুলপড়ুয়া ছেলেকে হত্যার যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে তা সচেতন মহলে আলোচনার ঝড় তুলেছে। পরিবার বা সমাজব্যবস্থার নিরাপত্তা আজ কোন পর্যায়ে রয়েছে সেটিই এখন প্রধান আলোচ্য বিষয়। রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পরও বিচার বিভাগের সদস্য ও তাদের পরিবার আজ অরক্ষিত। তাহলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা সরকার কীভাবে দেবে। এদিকে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন সব আদালত, বিচারকদের বাসস্থান ও যাতায়াতের সময় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বাহিনী নিয়োগের দাবি জানিয়েছে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এ দাবি বাস্তবায়ন না হলে দেশজুড়ে বিচারকরা একযোগে কলমবিরতি পালন করবেন বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে সংগঠনটি। এ ছাড়া গত রবিবার সারা দেশের বিচারকরা কালো ব্যাজ কর্মসূচি পালন করেন। সংগঠনের দাবি, রাজশাহীতে বিচারকের ছেলেকে হত্যার ঘটনায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অবহেলা করেছেন সংশ্লিষ্টরা। গ্রেপ্তার আসামিকে আইনবহির্ভূতভাবে গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করে অপেশাদার আচরণ দেখানোর অভিযোগও আনা হয়েছে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে। বিবৃতিতে বলা হয়, সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, অভিযুক্ত ব্যক্তি বিচারকের স্ত্রীর পূর্বপরিচিত এবং আর্থিকভাবে সাহায্যপ্রাপ্ত। একসময় ওই পরিচিতি ব্ল্যাকমেইলিং ও প্রাণনাশের হুমকিতে পরিণত হয়। হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে সিলেটে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) এবং পরে রাজশাহীতে সেই জিডির কপি দেওয়ার পরও আইনি পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। যার চূড়ান্ত অধ্যায় ১৫ বছরের কিশোরকে নৃশংস হত্যা।
হানি ট্র্যাপ বা মধুর ফাঁদ। অদ্ভুত এক প্রতারণার ফাঁদ এটি। এ চক্রের সূক্ষ্ম পরিকল্পনার হানি ট্র্যাপে পা দিচ্ছেন এক শ্রেণির সহজ-সরল বা লোভী প্রকৃতির মানুষ। এই ফাঁদে পড়ে কেউ সর্বস্ব খোয়াচ্ছেন আবার অনেকেই প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছেন। এ জাতীয় চক্রের ছোবল থেকে রক্ষা পেতে সচেতনতা ও সাবধানতার দিকেই নজর দিতে বলেছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। এরকম এক ফাঁদে ফেলেই রংপুরের কাঁচামাল ব্যবসায়ী মো. আশরাফুল হককে হত্যা করা হয়েছে। পরে তার লাশ টুকরো টুকরো করে ড্রামে ভরে ফেলে দেওয়া হয় রাজধানীর হাইকোর্ট-সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ মাঠের গেটের কাছে। এ মামলায় প্রধান আসামি জরেজুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। পাশাপাশি এ মামলার অন্য আসামি জরেজুলের বান্ধবী (প্রেমিকা) শামীমাকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-৩-এর একটি দল। ফেনীতে শেফালী আক্তার নামে এক নারীকে উত্ত্যক্ত ও মারধরের অভিযোগের তদন্ত করতে গিয়ে আসামিদের হামলায় এক এসআইসহ তিন পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হয়েছেন। পরে স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে পরশুরাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। দেশের যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করবেন তারা যখন নিজেদের নিরাপত্তাহীনতাই ভোগেন তখন সমস্যা দেখা দেয় চরমে। ছাত্রের করা মামলায় যৌন নিপীড়নের অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক এরশাদ হালিমকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। আমরা জানি, শিক্ষক হলেন মানুষ গড়ার কারিগর। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে শিক্ষকের এমন আচরণ যদি সত্যি প্রমাণিত হয়ে থাকে তাহলে এসব শিক্ষকের কাছ থেকে আমরা কী বা আশা করতে পারি। এসব ঘটনা আমাদের সমাজের জন্য খুবই বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ।
সামাজিক অবক্ষয় রোধে এখনই কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে সংক্রামক ব্যাধির মতো এগুলো সমাজে ছড়িয়ে পড়বে। অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে সাজা নিশ্চিত করতে হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় অপরাধীরা আটক হওয়ার পর জামিনে মুক্তি নিয়ে বের হয়ে এসে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে এবং আরও বেশি নৃশংসতা ঘটানোর সুযোগ পায়। এজন্য জিডিকে হালকাভাবে নেওয়া যাবে না বরং ভুক্তভোগীর আইনি সুরক্ষা জোরদার করতে হবে। আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। মানুষ কেন এ ধরনের অপরাধে যুক্ত হচ্ছে তা নিয়ে গবেষণা করে মনোবিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও সচেতনতা জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে। প্রাথমিক থেকে উচ্চতর শিক্ষা পর্যন্ত নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ চর্চায় মনোযোগ দিতে হবে। সর্বোপরি, সরকারকে অপরাধ নির্মূলে এবং সুস্থ-কার্যকর সমাজ গঠনে জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর তাগিদ দিতে হবে। প্রত্যাশা করছি, সরকার সামাজিক অবক্ষয় রোধে জনগণকে সংগঠিত করে একটি সুষ্ঠু, সুন্দর সমাজ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
