সোমবার ৮ ডিসেম্বর ২০২৫
২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
স্কুলে শুরু হোক নাগরিক সচেতনতার পাঠ
অধ্যক্ষ মহিউদ্দিন লিটন
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৯ অক্টোবর, ২০২৫, ১:৩৪ এএম আপডেট: ০৯.১০.২০২৫ ২:০১ এএম |

 স্কুলে শুরু হোক নাগরিক সচেতনতার পাঠ
আমরা প্রতিদিন এমন কিছু দৃশ্য দেখি, যা আমাদের মনকে ভাল থাকতে দেয় না। রাস্তার ধারে আবর্জনার স্তূপ, ট্রাফিক নিয়ম ভাঙা, ফুটপাত দখল, শব্দ দূষণ কিংবা সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করা যেন সামাজিক বাস্তবতার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলো কেবল প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি নয়, বরং নাগরিক সচেতনতার অভাবই বেশি। আর এই অভাব পূরণ করার জন্যই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নাগরিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি অপরিহার্য। 
শিক্ষা কেবল তথ্য আহরণের নাম নয়, এটি ব্যক্তিত্ব গঠনের এক প্রক্রিয়া। গণিত শেখায় যুক্তি, বিজ্ঞান শেখায় অনুসন্ধিৎসা, ভাষা শেখায় প্রকাশভঙ্গি, আর নাগরিক শিক্ষা শেখাতে পারে সমাজে কীভাবে দায়িত্ববান হয়ে চলতে হয়। শিশুদের ছোটবেলা থেকে যদি শেখানো যায় পরিচ্ছন্নতা, শৃঙ্খলা, সহমর্মিতা ও সামাজিক সম্পদের মর্যাদা রক্ষা করা, তাহলে তারা বড় হয়ে এক নতুন সামাজিক পরিবেশ গড়তে পারবে। 
একটি শিশু যখন জানবে ময়লা কেবল ড্রাস্টবিনে ফেলার জন্য, রাস্তায় নয়, তখন সে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে আর আবর্জনা ফেলে সমাজকে অস্বাস্থ্যকর করবে না। যখন সে জানবে লাল সিগন্যাল মানা কেবল আইন নয়, বরং সবার জীবনের নিরাপত্তা, তখন সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাড়াহুড়ো করে নিয়ম ভাঙবে না।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখি নাগরিক শিক্ষাকে তারা শিক্ষার অপরিহার্য অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছে। অনেক দেশে পরিচ্ছন্নতা কেবল আইনের ভয় থেকে নয়, বরং এক গভীর সামাজিক সংস্কৃতি থেকে এসেছে। জাপানের স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীরাই ক্লাসরুম পরিষ্কার করে, যাতে তাদের মধ্যে দায়িত্ববোধ এবং সম্মিলিত সচেতনতা তৈরি হয়। 
দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্রদের শেখানো হয় কীভাবে ছোট কাজের মাধ্যমেও সমাজে বড় পরিবর্তন আনা যায়। এসব দেশ আজ উন্নত, কারণ তারা নাগরিক চেতনাকে কেবল পাঠ্যপুস্তক নয়, জীবনযাপনের অংশে পরিণত করেছে।
বাংলাদেশে এখনো স্কুল পর্যায়ে এই ধরনের শিক্ষা তেমন গুরুত্ব পায় না, শুধুমাত্র যারা স্কাউটের সাথে সম্পৃক্ত থাকবে তারাই কয়েক মাস পরপর তাদের স্কুল ও কলেজ পরিস্কার পরিছন্নতার কাজ করে থাকে, বাকী শিক্ষার্থীদের যেন কোন দায়িত্ববোধ নেই।
আমাদের দেশে শিশুদের পড়াশোনা সীমাবদ্ধ থাকে ভালো ফলাফল, কিছু প্রতিযোগিতা এবং পরীক্ষার চাপের ভেতর। অথচ তারা প্রতিদিনই সমাজে নানা ধরনের অসংগতি দেখে। রাস্তার পাশে ময়লা ফেলতে দেখে, গাড়ি উলটো পথে চলতে দেখে, ফুটপাতে দোকান বসতে দেখে। এসবের বিরুদ্ধে তাদের ভেতরে কোনো প্রশ্ন জাগে না, কারণ তারা শেখেনি যে, এগুলো তাদের ভবিষ্যতের জন্য কতটা ক্ষতিকর। নাগরিক শিক্ষা যদি স্কুলেই শুরু না হয়, তাহলে সেই শিশুরা শিখবে কীভাবে নিজেরা দায়িত্বশীল হবে এবং অন্যকে দায়িত্ববান হতে উৎসাহিত করবে।
কেউ কেউ বলেন নাগরিক বোধ জন্মগত। কিন্তু বাস্তবতা অন্য কথা বলে। একজন মানুষ পরিবেশের ভেতরেই গড়ে ওঠে। শিশুরা যা দেখে, তা-ই অনুসরণ করে, আর যা শেখে তা-ই জীবনভর বহন করে। যদি তারা শেখে জনসম্পদ নষ্ট না করতে, ফুটপাত ব্যবহার করতে, ময়লা ডাস্টবিনে ফেলতে এবং অন্যের অধিকারকে সম্মান করতে, তাহলে তা তাদের জীবনের স্বাভাবিক অভ্যাস অভ্যাসে পরিণত হবে, স্কুলে নাগরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করলে এই চর্চা সহজেই বিস্তার লাভ করবে। অন্যদিকে নাগরিক শিক্ষা কেবল সামাজিক আচরণ শেখাবে না, বরং তাদের মধ্যে গড়ে তুলবে নৈতিকতা ও মানবিকতা। 
আজকের শিশু আগামীকালের নেতা। তারা রাষ্ট্র পরিচালনা করবে, নীতি নির্ধারণ করবে, সমাজকে বদলে দেবে। কিন্তু যদি তাদের ভেতরে সহমর্মিতা না থাকে, যদি তারা না শেখে কীভাবে দুর্বলকে সাহায্য করতে হয়, কিংবা কীভাবে পরিবেশকে রক্ষা করতে হয়, তাহলে উন্নয়ন কেবল কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ থাকবে। প্রকৃত উন্নয়ন হলো যখন একটি সমাজ মানুষের অন্তরে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়।
এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, নাগরিক শিক্ষা মানে কেবল নিয়ম শেখানো নয়, বরং অনুশীলনের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করা। স্কুলে শিক্ষার্থীদের দিয়ে ছোট ছোট প্রকল্প করানো যেতে পারে। যেমন একটি শ্রেণি তাদের এলাকার পার্ক পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব নিতে পারে, আরেকটি শ্রেণি ট্রাফিক সচেতনতা কার্যক্রম মাঝে মাঝে চালাতে পারে। এসব কার্যক্রম শুধু জ্ঞান দেবে না, বরং হাতে কলমে কাজ করার অভিজ্ঞতা তৈরি করবে। একইভাবে বিতর্ক প্রতিযোগিতা বা আলোচনায় তাদের যুক্ত করা যেতে পারে, যাতে তারা শেখে কীভাবে সমস্যার সমাধান করতে হয়। এই ধরনের অভিজ্ঞতা তাদের জীবনের পরবর্তী প্রতিটি ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
 আমাদের সমাজে নাগরিক বোধের অভাবের কারণে প্রতিদিনই আমরা ভোগান্তি পোহাই। ট্রাফিক জ্যাম থেকে শুরু করে পরিবেশ দূষণ, ডেঙ্গুর বিস্তার থেকে শুরু করে শব্দদূষণ-সবকিছুর মূলেই রয়েছে সচেতনতার ঘাটতি। উন্নত অবকাঠামো বা কঠোর আইন দিয়ে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সমাধান কেবল শিক্ষার ভেতর থেকেই আসতে পারে। যদি স্কুল থেকে নাগরিক শিক্ষা শুরু হয়, তবে পরবর্তী প্রজন্ম আইন মানতে অভ্যস্ত হবে এবং নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকবে।
বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার পথে। এ যাত্রায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেমন জরুরি, সামাজিক উন্নয়নও তেমনি অপরিহার্য। আমরা যদি কেবল উঁচু ভবন, আধুনিক সড়ক বা শিল্পকারখানা গড়ে তুলি অথচ নাগরিক সচেতনতা গড়ে না তুলি, তবে উন্নয়নের ভিত দুর্বল হয়ে যাবে। একটি পরিচ্ছন্ন, সুশৃঙ্খল এবং দায়িত্ববান সমাজই প্রকৃত উন্নয়নের প্রতীক। আর সেই সমাজ গড়তে হলে স্কুল থেকেই নাগরিক শিক্ষার পাঠশুরু করতে হবে।
এখন সময় এসেছে, আমরা উপলব্ধি করি যে শিক্ষা কেবল চাকরির জন্য প্রস্তুত করার হাতিয়ার নয়। শিক্ষা হলো মানুষকে মানুষ করে তোলার এক মহৎ প্রক্রিয়া। যে শিক্ষা আমাদের শেখাবে নিজের পাশাপাশি অন্যকেও ভালো রাখতে, যে শিক্ষা আমাদের মনে করিয়ে দেবে সমাজের প্রতি আমাদের দায়িত্ব রয়েছে, সেই শিক্ষাই আমাদের জাতিকে আলোকিত করতে পারে। নাগরিক শিক্ষা ছাড়া উন্নয়নের স্বপ্ন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
আমাদের সন্তানরা যদি ছোটবেলা থেকেই শিখে যায় যে, দেশ, সমাজ, পরিবেশ তাদেরও, তাহলে তারা আর কখনো অন্যের ক্ষতি করে নিজের স্বার্থ খুঁজবে না। তারা জানবে সম্মিলিত স্বার্থই প্রকৃত সুখের উৎস। তারা গড়ে তুলবে এমন একটি বাংলাদেশ, যেখানে পরিচ্ছন্নতা থাকবে প্রতিটি রাস্তায়, শৃঙ্খলা থাকবে প্রতিটি কাজে, আর সহযোগিতা থাকবে প্রতিটি সম্পর্কে।
নাগরিক শিক্ষা তাই কেবল একটি বিষয় নয়, এটি জাতি গঠনের অন্যতম ভিত্তি। আজ যদি আমরা এটিকে শিক্ষাব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করি, তাহলে কাল আমরা একটি এমন প্রজন্ম পাব, যারা কেবল জ্ঞানী নয়, বরং দায়িত্ববান, সৎ এবং মানবিক। তারা আমাদের সমাজকে বদলে দেবে এবং আমাদের দেশকে উন্নত করবে।
একজন সচেতন নাগরিক রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও সুশাসনের মূল চালিকাশক্তি। তাই এই চেতনা গড়ে তোলার সঠিক সময় হলো শৈশব, আর সঠিক স্থান হলো বিদ্যালয়। বিদ্যালয় শুধু পড়াশোনার জায়গা নয়; এটি হলো চরিত্র গঠনের কারখানা। এখান থেকেই শিশু শেখে কীভাবে নিয়ম মানতে হয়, কিভাবে অন্যকে সম্মান করতে হয়, কীভাবে সমাজের জন্য কাজ করতে হয়। যদি বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে দায়িত্ববোধ, কর্তব্যবোধ এবং নৈতিকতা সঞ্চারিত করা যায়, তাহলে তারা বড় হয়ে সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে।
নাগরিক সচেতনতার মূল শিক্ষা হলো আইন মেনে চলা, অন্যের অধিকারকে সম্মান করা, পরিবেশ রক্ষা করা, দুর্নীতিকে না বলা এবং সামাজিক দায়িত্ব গ্রহণ করা।
আজকের শিশু আগামী দিনের রাষ্ট্রনায়ক, বিজ্ঞানী, শিক্ষক কিংবা উদ্যোক্তা। তাদের মাঝে যদি ছোটবেলা থেকেই সৎ, দায়িত্বশীল ও সচেতন মানসিকতা তৈরি করা যায়, তবে আগামী সমাজ হবে দুর্নীতি ও অবহেলা মুক্ত এক সুন্দর বাংলাদেশ। তাই নাগরিক সচেতনতা গড়ে তোলার যাত্রা শুরু হোক বিদ্যালয় থেকেই, যেন শিক্ষার্থীরা শুধু ভালো মানুষ নয়, বরং প্রকৃত সচেতন নাগরিক হিসেবেও নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। 
বাংলাদেশের আগামী দিনের স্বপ্ন এভাবেই বাস্তবায়িত হবে। আর এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের শুরুটা ঘটাতে হবে স্কুলের পাঠশালায়। কারণ শিক্ষা হলো সেই অগ্নিশিখা, যা মনকে আলোকিত করে, আর নাগরিক শিক্ষা হলো সেই আলো, যা পুরো সমাজকে আলোকিত করতে পারে।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ, বাগিচাগাঁও, কুমিল্লা।














http://www.comillarkagoj.com/ad/1752266977.jpg
সর্বশেষ সংবাদ
৮ ডিসেম্বর মুক্ত হয় কুমিল্লা রাস্তায় নামে জনতার ঢল
সংসদ নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনে কমিশন প্রস্তুত
৮-১৫ডিসেম্বরের মধ্যে যেকোন দিনতফসিল
তফসিল ঘোষণার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পোস্টারনা সরালে ব্যবস্থা
তুরস্কের দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কুবির সমঝোতা স্মারক চুক্তি
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
জীবনের বাকি সময়টা নেতাকর্মীদের সঙ্গেই থাকতে চাই-হাজী ইয়াছিন
হৃদয়বান মানুষ হতে বই পড়ার বিকল্প নেই : ড. নেয়ামত উল্লাহ ভূঁইয়া
অর্থের চাইতে মানুষের আস্থা আমার কাছে অনেক বড় : হাসনাত আব্দুল্লাহ
খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় মুরাদনগরে কায়কোবাদের ৫০০ বার কুরআন খতম
ইস্টার্ন মেডিকেল কলেজ কুমিল্লায় বেগম খালেদা জিয়াররোগ মুক্তিতে কোরআন খতম ও দোয়া
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২