জুলাই-আগস্ট
গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে নতুন ধারার রাজনীতির পক্ষে এবং
স্বেচ্ছাচারী শাসনের বিরুদ্ধে প্রবল জন আকাক্সক্ষা তৈরি হয়েছে। সে আকাংখাকে
বাস্তবে রূপদানের জন্য গঠিত হয়েছে জাতীয় ঐক্যমত কমিশন। বাস্তবায়ন পদ্ধতি
নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও এ কমিশন ইতোমধ্যে বেশ কিছু সংস্কার প্রস্তাব সম্বলিত
জুলাই সনদ চূড়ান্ত করার পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এ সনদে জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষে
পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের কথা বলা হলেও নিম্নকক্ষের নির্বাচনে প্রচলিত
এফপিটিপি পদ্ধতির বিধানই রয়ে গেছে। কিন্তু সম্প্রতি জমায়েতে ইসলামিসহ কিছু
দল নিম্ন কক্ষেও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দাবি করেছে। অন্যদিকে বিএনপিসহ
কিছু দল আবার এর বিরোধিতা করছে। পিআর বা সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনি ব্যবস্থা
দেশে ঐক্যের পরিবর্তে বিভক্তিমূলক সমাজ এবং অস্থিতিশীল সরকার সৃষ্টির কারণ
হয়ে উঠতে পারে কিনা তা ভেবে দেখতে সব রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি আহ্বান
জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এছাড়া এই নির্বাচনি
ব্যবস্থার আড়ালে দেশের রাজনীতিতে সবার অগোচরে আবার পরাজিত অপশক্তির
পুনর্বাসনের পথ সুগম করে দেওয়া হচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি। অন্যদিকে পিআর
পদ্ধতি ছাড়া জনগণ কোনো নির্বাচন মেনে নেবে না বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ
জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান। তাঁর মতে, দেশের অধিকাংশ মানুষ
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায় এবং এ পদ্ধতির মাধ্যমেই সবার প্রতিনিধিত্ব
নিশ্চিত হয়। এমতাবস্থায়, পিআর পদ্ধতি সাম্প্রতিক রাজনৈতিক আলোচনা ও
বিতর্কের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে যে
পদ্ধতিটি চালু আছে তা পরিচিত ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ নামে। এই পদ্ধতিতে
কোন একটি নির্বাচনি এলাকায় প্রার্থীদের মধ্যে যিনি সর্বোচ্চ ভোট পান,
তিনিই নির্বাচিত হন। বাংলাদেশে জাতীয় সংসদসহ অধিকাংশ নির্বাচনে দীর্ঘদিন
ধরে এই পদ্ধতিটি চর্চিত হয়ে আসছে। অন্যদিকে, পিআর অর্থাৎ প্রপোরশনাল
রিপ্রেজেনটেশন পদ্ধতি হলো সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা। এই
পদ্ধতিতে আসনভিত্তিক কোনো প্রার্থী থাকেন না। ভোটাররা ভোট দেন দলীয়
প্রতীকে। একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে সংসদে তাদের আসন সংখ্যা
নির্ধারিত হবে।
১৮৯৯ সালে বেলজিয়ামে সর্বপ্রথম পিআর পদ্ধতি প্রবর্তিত
হয়। বর্তমানে বিশ্বের ১৭০টি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মধ্যে প্রায় ৯১টি দেশে
এরূপ নির্বাচনব্যবস্থা প্রচলিত। এ অঞ্চলে নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় পিআর চালু
রয়েছে। আবার অনেক জায়গায় এ দুটি পদ্ধতির মিশ্র ব্যবস্থাও চালু আছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলনীতিতে এক হলেও একেক দেশের ‘পিআর’ পদ্ধতি একেক রকম।
এই পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যক্তি-প্রার্থীদের মধ্যে হয় না, নির্বাচন হয়
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। খুব সহজবোধ্যভাবে বলতে গেলে, এই পদ্ধতির নির্বাচনে
যে দল মোট প্রদত্ত ভোটের মধ্যে যত শতাংশ ভোট পাবে, সেই অনুপাতে সংসদেও তত
ভাগ আসন পাবে। যেমন- বাংলাদেশের ৩০০ আসনের সংসদে ১ শতাংশ ভোট পাওয়া দল ৩টি
আসন পাবে। ১০ শতাংশ ভোট পেলে আসন পাবে ৩০টি।
অনেকে পিআর পদ্ধতির পক্ষে
নানা যুক্তি উপস্থাপন করলেও বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
সামনে নিয়ে চিন্তা করলে এ পদ্ধিতিকে মোটেও বাস্তবসম্মত মনে হবেনা।
বাংলাদেশে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন জাতীয় সংসদের ১৫১ সিট এবং পিআর
পদ্ধতিতে এ পরিমাণ সিটের জন্য কোন দলকে কমপক্ষে ৫০% ভোট পেতে হবে যা
বাস্তবে সম্ভব হবেনা। তখন সরকার গঠনের জন্য বড় দল বা জোটকে এক বা একাধিক
ছোট দলের কাছে ধর্না দিতে হবে। ছোট ছোট দলগুলো তখন হয়ে উঠবে গেম চেঞ্জার আর
এসুযোগে ছোট ছোট দলগুলো বড় দলগুলোকে জিম্মি করে তাদের উপর
ন্যায্য-অন্যায্য নানা আবদার চাপিয়ে দিতে পারে। যেমন- (ইসরাইলে নেতানিয়াহুর
সরকার টিকে আছে ছোট ছোট কিছু উগ্রবাদী ইহুদী দলের সমর্থনে এবং নেতানিয়াহু
নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার স্বার্থে এসব ছোট ছোট দলগুলোর চাপে গাজাসহ পুরো
ফিলিস্তিন জুড়ে নির্বিচার গণহত্যা চালাচ্ছে।) এরূপ পরিস্থিতিতে পার্লামেন্ট
হবে ঝুলন্ত এবং সরকার হবে দুর্বল, ক্ষণস্থায়ী। সকালের প্রধানমন্ত্রী
বিকেলে হয়ে যেতে পারেন বিরোধী দলীয় নেতা। নেপালের মত ঘন ঘন সরকার পরিবর্তিত
হবে। এতে করে সবচেয়ে হুমকির সম্মুখীন হবে রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা ও
সার্বভৌমত্ব। ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে বাংলাদেশ এমনিতেই শক্তিশালী
রাষ্ট্রগূলোর কূনজরে আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন সহ বিভিন্ন শক্তির
পরষ্পর বিরোধী স্বার্থের হুমকিতে আছে দেশ। প্রতিবেশী শক্তিশালী রাষ্ট্রটিও
চায় বাংলাদেশকে সবসময় তার পদাবনত করে রাখতে। পিআর পদ্ধতির বাস্তবতায়
সরকার, রাষ্ট্র দুর্বল ও অস্থিতিশীল হলে তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করা অনেক
সহজ হয়ে যাবে।
পিআর পদ্ধতিতে টাকার খেলা কয়েকগুণ বেড়ে যেতে পারে।
কেননা, প্রচলিত নির্বাচনে দলগুলো অর্থের বিনিময়ে বা সম্পদশালীদের নমিনেশন
দিলেও তাদেরকে প্রার্থীর জনপ্রিয়তার দিকটিকে অধিক গুরুত্ব দিতে হয়।
জনপ্রিয়তা ছাড়া শুধু টাকার মাধ্যমে প্রচলিত পদ্ধতির নির্বাচনে জয়ী হওয়া
সম্ভব হয়না। যেমন, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনে আমরা অনেক শিল্পপতি, টাকার
কুমিরকে পরাজিত হতে দেখেছি। বস্তুতঃ পিআর পদ্ধতিতেই অর্থকড়ির প্রভাব বেশি
হবে। যেহেতু, এ পদ্ধতির নির্বাচনে ভোটের পার্সেন্টিজ গুরুত্বপূর্ণ তাই অধিক
ভোট পাওয়ার জন্য প্রতিটি দলকে প্রত্যেকটি আসনে সমান তালে টাকা খরচ করতে
হবে। এমনকি যে আসনে তাদের সমর্থন সবচেয়ে বেশী সেখানেও তাদেরকে ভোটের হার
বাড়ানোর জন্য প্রচুর টাকা খরচ করতে হবে। সবচেয়ে আশংকার বিষয় হলো,
নির্বাচনের পর দলের প্রাপ্ত আসন সংখ্যা যখন নিশ্চিত হয়ে যাবে তখন দেশের বড়
বড় শিল্পপতি, ধনকুবেররা বস্তা বস্তা টাকা দিয়ে দলের কাছ থেকে এমপি পদ কিনে
ফেলতে পারে। সেক্ষেত্রে, দলগুলো রীতিমতো এমপি পদ বেচা কেনার সুপার শপে
পরিণত হতে পারে। বর্তমান পদ্ধতিতে যাদের এমপি হওয়া সম্ভব নয়, তারাও তখন
নানাভাবে ম্যানেজ করে এমপি পদ বাগিয়ে ফেলবে। পিআর পদ্ধতিতে ভোটাররা ভোট
দিবে দলকে, ব্যাক্তিকে না। আর এ সুযোগে বিজয়ী দল বা দলের নেতা তার পছন্দের
নেতাদের বা আত্মীয়স্বজনকেও এমপি বানানোর সুযোগ পেয়ে যাবে। এক্ষেত্রে জাতীয়
সংসদ হয়ে যেতে পারে অযোগ্য, অথর্ব, বিত্তশালী আর আত্মীয় স্বজনের মিলন মেলা।
এমনকি দলীয় এমপিদের তালিকা ভোটের আগে দেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা এ
প্রবণতার তেমন পরিবর্তন ঘটাবেনা।
দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির
বাস্তবতায় পিআর পদ্ধতিতেও কেন্দ্র দখলের সম্ভাবনা একটুও কমবে বলে মনে হয়না।
পিআর পদ্ধতিতে ভোটের পার্সেন্টিজ অনুযায়ী আসন বরাদ্দ হবে বিধায় সব দলই
চাইবে কেন্দ্র দখল, জোর জবরদস্তি বা কারচুপির মাধ্যমে অধিক সংখ্যক ভোট
নিশ্চিত করতে। অনেক আসনে এমপি পদের নিশ্চিত দাবীদার বা সম্ভাব্য মন্ত্রীর
মতো কিছু নেতা থাকে। বর্তমান বাস্তবতায় তারা তাদের পদ পদবী ধরে রাখার লক্ষে
আগের মতোই কেন্দ্র দখল বা নির্বাচনকে প্রভাবীত করার চেষ্টা করবে। আবার,
নির্বাচনে আসন প্রতি ভোট প্রাপ্তির হারের উপর যেহেতু স্থানীয় নেতার ভবিষ্যত
নির্ভরশীল সেহেতু রাজনৈতিক সংস্কৃতি অক্ষুণ্ন রেখে শুধুমাত্র পিআর
নির্বাচন কেন্দ্র দখল বা নির্বাচনি সন্ত্রাস কমানোর গ্যারান্টি হতে পারেনা।
এমন অনেক আসন আছে যেখানে দলীয় প্রার্থীর ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে তাকে
কেন্দ্র দখল করতে হয়না। কিন্তু এ পদ্ধতিতে ভোটের সংখ্যার গুরুত্বের কারণে
সেসব আসনেও ভোট কারচুপি বা কেন্দ্র দখল হতে পারে।
পিআর পদ্ধতিতে আসন
প্রাপ্তির সম্ভাবনার কারণে পান-বিড়ির দোকানের মতো নতুন নতুন রাজনৈতিক দল
খোলার প্রবণতা বেড়ে যাবে। সম্প্রতি নিবন্ধন পাওয়ার আশায় নির্বাচন কমিশনে শত
শত সাইনবোর্ডসর্বস্ব দলের আবেদনের ঘটনা সেরকম ইংগিতই দেয়। বাংলাদেশের
বাস্তবতায় দেখা যায়, ছোট ছোট দলগুলোর ভূমিকা রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক
স্থিতিশীলতায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক। কেননা, এ জাতীয় দলগুলো গড়ে উঠে
মূলতঃ নানারকম সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তি ও ধান্দাবাজির আশায়।
কোন একটি আসনে
একটি দল ঐ আসনের ৮০% ভোট পেলেও পিআর পদ্ধতির জটিলতার কারণে সেখানে এমপি
হতে পারেন এমন দল থেকে যারা হয়তো ঐ আসনে ১০% ভোটও পায়নি। এক্ষেত্রে ঐ আসনের
কয়েক লাখ ভোটারের ভোট ও আকাক্সক্ষা কার্যত মূল্যহীন হয়ে পড়ে।
পিআর
পদ্ধতিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নেই। ফলে প্রচলিত পদ্ধতিতে
রাজনৈতিক দলের বাইরে থাকা যোগ্যতা সম্পন্ন ও জনপ্রিয় ব্যক্তিদের নির্বাচিত
হওয়ার সুযোগ থাকলেও পিআর পদ্ধতিতে সে সুযোগ নেই।
সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি
যেহেতু ছোট ছোট দলগুলোকেও আসন প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দেয়, সেহেতু এ পদ্ধতির
কারণে অঞ্চল ভিত্তিক, সম্প্রদায় ভিত্তিক, বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং ধর্ম ভিত্তিক
রাজনৈতিক দলের সংখ্যা বেড়ে যাবে যা রাষ্ট্রীয় ঐক্য, সংহতি ও অখণ্ডতার
প্রতি হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।
পিআর একটি জটিল পদ্ধতি। এর সাফল্যের
জন্য উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতি অত্যাবশ্যক। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক
সংস্কৃতি বেশ নিম্নমানের ও বিরোধপূর্ণ। অধিকাংশ জনগণ এখানে অশিক্ষিত এবং
রাজনৈতিকভাবে অসচেতন। সেই সাথে রয়েছে নেতাদের ঘনঘন দলবদলের প্রবণতা,
গণতান্ত্রিক চর্চার ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের অভাব। এমন নিম্নমানের রাজনৈতিক
সংস্কৃতিতে এ পদ্ধতির সাফল্যের সম্ভাবনা কম বরং এ পদ্ধতি দেশে
অস্থিতিশীলতা, অনিশ্চয়তা ও অরাজকতা আরো বাড়িয়ে দিবে।
পিআর পদ্ধতিতে
ভোটাররা ভোট দিবে দলকে, ব্যাক্তিকে না। ফলে এ পদ্ধতি দলীয় বা দলের নেতার
স্বেচ্ছাচারিতা বাড়িয়ে দিতে পারে। ভোটের পর দলীয় নেতা সম্পূর্ণ নিজের
ইচ্ছায় এমপি পদ বিলানোর সুযোগ পেয়ে যাবেন।
প্রচলিত পদ্ধতিতে
এলাকাভিত্তিক জনপ্রিয় অনেক নেতা বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে এলাকার প্রতিনিত্বের
সুযোগ পেয়ে থাকেন। কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে এ ধরণের বিপুল জনপ্রিয় নেতাদের
জনপ্রতিনিধি হওয়ার গ্যারান্টি নেই। এ পদ্ধতিতে তাই অনেক সময় স্থানীয় জনগণের
আকাক্সক্ষা ও মতামত উপেক্ষিত থেকে যেতে পারে।
পিআর পদ্ধতির জটিলতার
কারণে একটি আসনের এমপি হয়ে যেতে পারেন অন্য আসনের কেঊ। ফলে ঐ আসনের জনগণের
সাথে তাদের এমপির কোন যোগসূত্র বা সম্পর্ক থাকবেনা। এমপিগণ হবেন
জনবিচ্ছিন্ন এবং জনগণের প্রতি তখন তাদের কোন কমিটমেন্ট বা দায়বদ্ধতা
থাকবেনা। ফলে সংশ্লিষ্ট সংসদীয় আসনে এলাকাবাসীর স্বার্থ কীভাবে রক্ষিত হবে
সে প্রশ্ন কিংবা সংশয়ের জায়গাও আছে।
আনুপাতিক পদ্ধতিতে খুব অল্প ভোট
পাওয়া ছোট ছোট দলও সংসদে চলে যাবে, যা সংসদকে খণ্ডিত ও অতিরিক্ত রাজনৈতিক
বিভাজনে বিভক্ত ও অকার্যকর করে দিতে পারে। এ পদ্ধতির নির্বাচনে গঠিত সংসদ ও
সরকার দ্রুত কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেনা। ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন বা
অনিশ্চয়তার কারণে সরকারের নীতি ও কাজের ধারাবাহিকতা নষ্ট হবে, দীর্ঘমেয়াদী
পরিকল্পনা গ্রহণ হবে অসম্ভব।
যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মডেল হলেও দেশ দুটিতে পিআর পদ্ধতি নেই। মূলতঃ
ইউরোপের উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির দেশগুলোতেই এ পদ্ধতির প্রচলন বেশি।
সেখানকার অধিকাংশ দেশে আংশিক পিআর পদ্ধতি বিদ্যমান এবং তাদের অভিজ্ঞতা
মোটামোটি ভালো। আমাদের পার্শ্ববর্তী নেপাল ও শ্রীলংকায় আংশিক পিআর পদ্ধতি
থাকলেও এদের অভিজ্ঞতা সূখকর নয়। নেপালে গত ১৪ বছরে প্রায় ১৫ বার সরকারের
পরিবর্তন হয়েছে। অনেকের মতে এ দূরাবস্থার অন্যতম কারণ পিআর পদ্ধতি এবং নতুন
সংবিধানের দুর্বলতা। আনুপাতিক ব্যবস্থা চালুর পর নেপালে জাতিগত ও অঞ্চল
ভিত্তিক ছোট ছোট দলের ব্যাপক উত্থান ঘটেছে। ১৯৪৬ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ৪৭
বছরে ইতালিতে প্রায় ৫০ বার সরকার পরিবর্তিত হয়েছে মূলত পিআর পদ্ধতির কারণে।
ফলে ১৯৯৩ সালে সেখানে গণভোটের মাধ্যমে পিআর পদ্ধতিকে প্রায় বাতিল করে দিয়ে
অধিকাংশ আসনে ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতির পুনপ্রবর্তন করা হয়।
ইসরায়েলে পিআর পদ্ধতির ফলে প্রায়শই ছোট ছোট দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যা
সরকার গঠনে জোট নির্ভরতা বাড়ায়। এর ফলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়।
২০১৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ইসরায়েলে পাঁচবার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত
হয়েছে। এ পদ্ধতির ফলে সৃষ্ট জোট নির্ভরতা সেখানে নেতানিয়াহু সরকারকে
ফিলিস্তিন জুড়ে নিষ্ঠুর গণহত্যায় বাধ্য করেছে।
বিভিন্ন দেশের বাস্তব
অভিজ্ঞতা ও বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বিবেচনায় নিলে পিআর
পদ্ধতিকে এখানে মোটেও বাস্তবসম্মত মনে হয়না। উচ্চ কক্ষের কার্যকারিতায় এ
পদ্ধতি সহায়ক হলেও নিম্ন কক্ষে এটা হতে পারে আত্মঘাতী, বিপর্যয়কর। হটাৎ করে
এ পদ্ধতি নিয়ে বিভিন্ন দলের মরিয়া প্রচেষ্টা দেখে তাই দেশপ্রেমিক,
চিন্তাশীল নাগরিকদের মনে সন্দেহের উদ্রেক হওয়াটাই স্বভাবিক। বাংলাদেশে পিআর
পদ্ধতি চালু হলে যে সংসদ গঠিত হবে তা হয়ে যেতে পারে একটা বিশাল বিয়ে বাড়ীর
মতো যেখানে মূল দাওয়াতী মেহমানের চেয়ে বরের চাচাতো ভাইয়ের শ্যালকের বন্ধুর
সংখ্যা বেশি। গণতন্ত্রে সকল দলকে প্রতিনিধিত্ব দেয়ার চিন্তা মহৎ হলেও তা
যদি মূল উদ্দেশ্যকেই ব্যাহত করে, অচলাবস্থা তৈরি করে তবে তা কখনো
বাস্তবসম্মত চিন্তা হতে পারেনা। গণতন্ত্রের নিমন্ত্রণে সবাইকে আনতে গিয়ে
যদি মূল আয়োজনটাই পন্ড হয়ে যায়, তাহলে সে নিমন্ত্রণের আর গুরুত্ব থাকল
কোথায়। সুতরাং পিআর নয় রাষ্ট্র সংস্কারে সবার আগে প্রয়োজন শাসক ও শাসিতের
মানসিকতার সংস্কার, রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুণগত পরিবর্তন এবং রাষ্ট্রীয়
গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিকিকরণ। নির্দিষ্ট সময় পর পর একটি
সত্যিকারের বাধাহীন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই হতে পারে শাসক- শাসিতের
মানসিকতা ও বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিবাচক পরিবর্তনের কার্যকর
গ্যারান্টি।
লেখক- প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান
কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড সরকারি মডেল কলেজ