মনুষ্যত্বের দুটি মৌল
বৈশিষ্ট্য, দুই মূল প্রবৃত্তি শিল্পকর্মে এসে মিলেছে। এদের ব্যাখ্যা করতে
গেলে একেবারে গোড়ার কথা দিয়ে শুরু করতে হয়।
জীব হিসেবে মানুষের এক বৈশিষ্ট্য, সে কারিগরি। তার দেবতাদের মধ্যে একজন হলেন বিশ্বকর্মা।
আত্মরক্ষার
জন্য অন্যান্য হিংস্র প্রাণীর আছে তীক্ষè দাঁত ও নখ, থাবার জোর, লাফানোর
শক্তি। এসব দিক থেকে মানুষের ক্ষমতা অতি সামান্য। এমনকি দ্রুত পলায়নের
শক্তিতেও সে অন্যান্য হিংস্র জন্তুর সমকক্ষ নয়। কিন্তু মানুষের আছে একটি
বিশেষ ক্ষমতা। সে নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী যন্ত্র অথবা উপকরণ নির্মাণ করে
নিতে পারে। এই দিয়ে মানুষ পুষিয়ে নিয়েছে জীব হিসেবে অনেক দুর্বলতা।
আত্মরক্ষার উপায় বাসস্থান, পরিবহন, কৃষি ও শিল্প, সবকিছুর পিছনেই আছে
কারিগরি কৌশল। আমাদের ভাষায় শিল্প শব্দটির দুটি অর্থ, যার একটির যোগ
প্রত্যক্ষভাবেই কারিগরির সঙ্গে।
অন্যান্য জীব প্রকৃতির কাছে থেকে
জন্মসূত্রে যা পেয়েছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট। মানুষের আছে উদ্ভাবনীয় শক্তি।
কারিগর মানুষ চলে সচেতন উদ্দেশ্য নিয়ে, পরিপার্শ্বকে সে ক্রমাগত সংশোধন করে
নিতে চায় নিজের পরিকল্পনা অনুসারে। এ কাজ করতে গিয়ে তাকে আয়ত্ত করতে হয়
নতুন কলা ও কৌশল। পরিপার্শ্বের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকেও সে নতুন করে গড়ে।
প্রকৃতির অপূর্ণতাকে সে মেনে নিতে চায় না। মানুষের নিজস্ব প্রয়োজনে চলে
প্রকৃতির সংশোধন ও সংযোজন। শিল্পের যোগ এই সংযোজনীয় প্রবৃত্তির সঙ্গে।
মানুষের
আরেক বৈশিষ্ট্য তার আত্মপ্রকাশের শক্তি, তার ভাষা। অন্যান্য জীবেরও এই
শক্তি আছে অল্প পরিমাণে। কিন্তু মানুষের সঙ্গে তার তুলনা হয় না।
জৈবিক
স্তর থেকেই আবারও কথাটা শুরু করা যাক। ভয়, ক্রোধ, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, যৌন
আকর্ষণ, এইসব জৈব ভাবের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। এই সবের ভিতর দিয়ে জীবনের
কিছু প্রয়োজন সিদ্ধ হয়। এক একটি বিশেষ ভাবের প্রকাশ বিশেষ ধরনের, তার যোগ
বিশেষ প্রয়োজনের সঙ্গে। খিদে পেলে শিশু কাঁদে, তাই দেখে মা স্তন্য দেন। বড়ো
হয়েও অভাবে পড়ে মানুষ বিলাপ করে, হয়তো তাতে অন্য মানুষের সহানুভূতি জাগে,
হয়তো সহায়তা লাভ হয়।
অর্থাৎ, ভাষা কাজ করে। স্বার্থ, প্রেম ও দ্বন্দ্ব
মিলিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক। এইসব আবেগের প্রকাশের ভিতর দিয়েই
সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের আত্মপ্রকাশ। এই শক্তিতে কখনো আমরা অপরকে কাছে
টানতে চাই, কখনো দূরে সরিয়ে দিই, কখনো কিছু মানুষকে কাছে টানি আর একই সঙ্গে
অন্য কিছু মানুষকে দূরে সরাই। আমাদের জৈব স্বার্থের সঙ্গে, জীবনের
প্রয়োজনের সঙ্গে, এই সব কাজের যোগ আছে। সব সময়ে যে শব্দ প্রয়োগ করতে হয় এমন
নয়। আকারে-ইঙ্গিতেও কাজ হয়।
শব্দকে আশ্রয় করে ভাব প্রকাশ করতে আমরা এতই
অভ্যস্ত যে অনেক সময় এই কাজটা আমাদের সচেতনভাবে করতে হয় না, আমরা যে
আত্মপ্রকাশ করছি এটা আমাদের খেয়ালের ভিতর থাকে না। আকারে-ইঙ্গিতে ভাব
প্রকাশ করতে গেলে আরও সচেতনভাবে সেটা করতে হয়। তখন তাকে আত্মপ্রকাশ বলে
চিনে নেওয়া সহজ। অন্তত দর্শকের দৃষ্টিতে তাই। এইখানে নাটকের শুরু।
কারিগরি
আর আত্মপ্রকাশ এই দুই এসে মিলেছে শিল্পে। বিশুদ্ধ শিল্পে কারিগরির চেয়ে
আত্মপ্রকাশের ভাবটাই প্রধান। তবে জৈব স্তর থেকে শিল্পের স্তরে পৌঁছানোর
পথে এইসব শব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটে।
গোড়ার কথায় আবারও ফিরে আসা যাক।
আত্মপ্রকাশের
জৈব উদ্দেশ্য এই, এতে কাজ হয়, অন্তত কাজ হবে বলে প্রত্যাশা থাকে। আমরা যখন
উদ্বিগ্ন হয়ে কিছু বলি তখন তাতে সাহায্যের প্রত্যাশা থাকে, হয়তো সাহায্য
পাওয়া যায়। আমার ছেলেটি হারিয়ে গেছে, একথা বলার পর প্রত্যাশা থাকে যে
আত্মীয়, বন্ধু ও প্রতিবেশীরা আমাকে সাহায্য করবে ছেলেটিকে খুঁজে বের করতে,
সাধারণত এই প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজও হয়।
কিন্তু এমন অনেক সময় আসে যখন
ওইরকম কোনো প্রত্যাশা ছাড়াই আমরা কথা ও আবেগ মিশ্রিত তবু প্রত্যাশাহীন কথা।
শুধু কথা বলেই কখনো মন ভারমুক্ত হয়। আমার প্রিয় বন্ধু মারা গেছে, একথা যখন
নানাভাবে ছোটো-বড়ো ঘটনার সঙ্গে যুক্ত করে বলি, তখন এমন কোনো প্রত্যাশাই
থাকে না যে শ্রোতারা সাহায্য করবে সেই বন্ধুকে ফিরিয়ে আনতে।
দুঃখী
মানুষ দুঃখের কথা বলছে। প্রেমাস্পদের সঙ্গে বিচ্ছেদের কথা। এই আর্ত-
নিবেদনের পিছনে একমাত্র প্রত্যাশা শ্রোতার সহানুভূতি, অন্য প্রত্যাশা নেই।
অর্থাৎ এই নিবেদনের ভিতর দিয়ে পরিপার্শ্বের কোনো পরিবর্তনই ঘটছে না, ফিরে
আসছে না প্রেমাস্পদ, ফিরে আসছে না প্রত্যক্ষত হারিয়ে যাওয়া কিছুই। তবু এই
বলা। বলার ভিতর দিয়ে মনের ভার নেমে যাচ্ছে। দুঃখে যখন কেউ পাষাণ মূর্তি হয়ে
থাকে তখন বন্ধু হিসেবে আমরা চিন্তিত হই। আমরা চাই, কিছু বলুক, কাঁদুক,
মনের ভাবটা কথার ভিতর দিয়ে, কান্নার ভিতর দিয়ে নেমে যাক।
সেই কথা, সেই
কান্না, যাতে পৃথিবীর কোনো পরিবর্তনই হচ্ছে না বাহ্যত, সমস্ত কারিগরি
উদ্দেশ্যের বাইরে যেটা, তাতে মন ভারমুক্ত হয় কেন? কীভাবে? যাতে কোনো
কার্যসিদ্ধি হচ্ছে না সেই আত্মপ্রকাশে কীসের স্বস্তি?
এর একটা নঞর্থক ব্যাখ্যা আছে, আর একটা সদর্থক।
যেটা
ভিতরের তাকে বাইর আনার একটা বেগ মানুষের ভিতর সঞ্চারিত হয় প্রাকৃতিক
প্রক্রিয়ায় জৈব উদ্দেশ্যে। বাইরে আনার পর সেই বেগটা প্রশমিত হয় প্রকৃতিরই
নিয়মে। এটা ঘটে দেহে ও মনে উভয় স্তরে। নিতান্ত দৈহিক স্তরের এর উদাহরণ
দেওয়া সহজ, যেটা ভিতরে জমে উঠেছে সেটাকে বের করে দিয়েই ভারমুক্তি।
মনের
ক্ষেত্রেও এই রকম একটা ব্যাপার ঘটে। মনে কথা জমে ওঠে, কথা বললেই
ভারমুক্তি। কোনো অভিজ্ঞতা, বিশেষত মনে দাগ কাটে এমন অভিজ্ঞতা, আমরা বাইরে
প্রকাশ করতে চাই। এর পিছনেও জৈব উদ্দেশ্য উপস্থিত। কিন্তু উদ্দেশ্যের
অপেক্ষা না রেখেই প্রক্রিয়াটা শুরু হয়ে যায়। এমনও হয় যে, একটা কথা প্রকাশ
না করাই উচিত, প্রকাশ করার বেগটা তবু দেহমনে সঞ্চারিত হতে থাকে। আমরা বলি,
‘কথাটা নিজের কাছেই রাখতে পারবি তো, না পেট ফুলে উঠবে!’ কারও সম্বন্ধে বলি,
ওর পেটে কথা থাকে না।
২
একটা গল্প আছে, অনেকেই জানেন। মানুষটাকে
বলা হয়েছিল একটি কথা কাউকে না জানাতে। বেচারা অবশেষে মাটিতে গর্ত করে সেই
গর্তে মুখ রেখেই কথা বলেছিল। এ যেন গলায় আঙুল দিয়ে বমি করে পেটের ভার লাঘব
করার মতো ব্যাপার।
প্রকাশ করে আমরা স্বস্তি পাই। স্নায়ুতে ও মনে যে
বেগটা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মতো জমে ওঠে, দেহমন থেকে সেটাকে নামিয়ে দিই।
প্রায় ভূত তাড়ানোর মতো ব্যাপর। নঞর্থক দিক থেকে ব্যাখ্যা এই।
কিন্তু
এটাই নয়। আত্মপ্রকাশের ভিতর দিয়ে একা মানুষ অনেকের সঙ্গে যুক্ত হয়। একে বলা
যেতে পারে, একাকিত্ব থেকে মুক্তি। বলা যেতে পারে যোগের আনন্দ। এটাই সদর্থক
ব্যাখ্যা।
অনেক সময় এই যোগের ভিতর দিয়ে ব্যবহারিক লাভ হয়। দশজনের
সহায়তায় কার্যসিদ্ধির কথা এখন বলা হচ্ছে না। এইরকম ব্যবহারিক লাভ যেখানে
নেই সেখানেও যোগের ভিতর দিয়ে মনের অভাব দূর হয়। ছোট ‘আমি’র সীমা ছাড়িয়ে যখন
একের মন দশের ভিতর প্রসারিত হয় তখন তাতেই একটা বন্ধনমুক্তি ঘটে, আনন্দ লাভ
হয়। নিতান্ত জৈব প্রয়োজনের বাইরেও আত্মপ্রকাশের অথবা আত্মিক প্রসারের একটা
আনন্দদায়িনী শক্তি আছে।
বস্তুত মানুষের ভিতর স্বাভাবিকভাবেই দুটি
বিপরীত ভাব লক্ষ করা যায়। ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা।’ মানুষের
ভিতর একটা সহজ প্রবৃত্তি আছে, সবকিছুর ভিতর নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়ার, ছোটো
আমিকে আরও বড়ো কিছুর ভিতর হারিয়ে ফেলার। কিন্তু আবার আছে একটা সাবধানী
বুদ্ধি, যেটা একই সঙ্গে আমাদের নিরাপত্তা এনে দেয় এবং অভ্যন্তর দেওয়ালের
ভিতর আবদ্ধ করে। সেই আবদ্ধতা ক্লেশ থেকে মুক্তি পাই, চিত্তকে যখন প্রসারিত
করি। সেটা সহজ আনন্দ।
আত্মপ্রকাশ যখন ঘটে জৈব স্তরে তখন সেটা প্রকৃতিজ
এবং অসচেতন। আমরা সচেতন সিদ্ধান্ত নিয়ে হাই তুলি না। তেমনি আমরা যখন ক্রোধে
ফেটে পড়ি অথবা কাউকে দেখে হঠাৎ খুশি হই, তখনও সেটা সচেতন সিদ্ধান্তের ফলে
নয়।
কিন্তু অভিনেতা যখন অভিনয় করেন সেটা সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েই
করেন। সেটা শিল্প। শিল্প এই অর্থে প্রকৃতিজ নয়, বরং প্রকৃতির অনুকরণ অথবা
প্রতিকরণ। সেটা সচেতন।
এই অনুকরণের ইচ্ছাটা আসে কেন? কী এর উদ্দেশ্য?
অসচেতন ভাষা যেমন আবেগ মিশ্রিত ভাষা, শিল্পের সচেতন অনুকরণও তেমনি আবেগ
মিশ্রিত অনুকরণ। এর পিছনে একটি মাত্র উদ্দেশ্য খুঁজতে যাওয়া ঠিক নয়। অনেক
কারণেই এটা ঘরে আর মানুষের চেতনার একাধিক স্তরে শিল্পকে আমরা পাই।
আমরা
যখন কোনো বস্তুর প্রতিকৃতি সৃষ্টি করি তখন যেন সেই বস্তুটিকেই, অর্থাৎ তার
প্রাণের আধারটিই সৃষ্টি করি। যে জিনিস আমরা সৃষ্টি করি তার উপর আমাদের
অল্পবেশি অধিকার প্রতিষ্ঠত হয়ে যায়। দূর থেকে যেটা আমাদের কাছে হয়তো ভয়ের
বস্ত হয়েছিল, সৃষ্টির ভিতর দিয়ে তারই উপর আমাদের কিছুটা অধিকার এসে যায় এবং
আমরা সেই পরিমাণে ভয়মুক্ত হই।
প্রতিকৃতির সঙ্গে মূল বস্তুর একরকম
অভিন্নতার কল্পনা মানুষের ভিতর স্বাভাবিক। এই কারণেই কোনো শ্রদ্ধেয় মানুষের
ছবিতে আমরা পদাঘাত করতে পারি না। ছবিটা আমাদের কল্পনায় শুধু একটা জড়বস্তু
হয়ে থাকে না, তাতে ব্যক্তিত্ব স্থাপিত হয়। কুশপুত্তলিকা দাহ করে আমরা যেন
মূল ব্যক্তিটিকেই বিনষ্ট করি। দেবীর মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে তাঁর
আরাধনা করি।
দূর থেকে যেটা আমাদের আবেগকে মথিত করে তার উপর কল্পনায় আমিত্বের অধিকার স্থাপন করা শিল্পসৃষ্টির এক মূল উদ্দেশ্য।
আবার
শিল্পী নিযুক্ত হতে পারেন সামাজিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটানোর সচেতন
উদ্দেশ্য নিয়ে। রাজনীতিক আন্দোলনের বক্তা বক্তৃতা দেন শ্রোতাদের মধ্যে এমন
একটা আবেগের হাওয়া সৃষ্টি করার জন্যই যেটা তাঁর দল অথবা দেশকে নিয়ে যাবে এক
অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে। সাহিত্যিকও তেমনি সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারেন,
শিল্পী আঁকতে পারেন ছবি কিংবা রচনা করতে পারেন গান ও নাটক, একটা বাস্তব
উদ্দেশ্য মনে রেখে। বাহ্য উদ্দেশ্যে আশ্রিত এইরকম শিল্প-সাহিত্যকে বলা হয়ে
থাকে প্রচারশিল্প অথবা প্রচারসাহিত্য। এ যুগের শিল্পে-সাহিত্যে এর স্থান
নগণ্য নয়। এর উদেদ্শ্য একটা বাস্তব লক্ষ্যে পৌঁছানো, একটা কাজ করিয়ে
নেওয়া, সামাজিক নীতি অথবা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন বুদ্ধি
থাকে, এখানেও সেই রকম। শিল্পীর অভিপ্রায় যদি প্রকাশ্যে অনুচ্চারিত থাকে তবু
শিল্পকর্মের বিশ্লেষণের ভিতর দিয়ে উদ্ঘাটিত হতে পারে তার সামাজিক ও
প্রায়োগিক তাৎপর্য।
বাস্তব বহির্মুখী লক্ষ্য আছে কাজেই প্রচারশিল্পের
বুদ্ধিগ্রাহ্য সহজ। তার চেয়ে বোঝা কঠিন, শিল্পের জন্য শিল্প। অথচ দুয়েরই
তুলনা আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি প্রকৃতিতে। আবেগের প্রাকৃত প্রকাশে একদিকে আছে
একটা জৈব উদ্দেশ্য, বাস্তব প্রত্যাশা। আবার অন্যদিকে আছে বাস্তব উদ্দেশ্যে
অতিরিক্ত আত্মপ্রকাশের নিজস্ব আনন্দ। অসচেতন প্রকৃতিতে আছে এই দ্বিত্ব। এই
দ্বৈত্যের প্রতিবিম্ব পাই সচেতন শিল্পের স্তরেও।
প্রকৃতি একটা অভ্যস্ত
উপায়, যে পথে জীবকে সে আকৃষ্ট করতে চায় সে পথে কিছু আনন্দ বিছিয়ে দেয়। পেলে
আমরা খাই তাতে খিদের কষ্ট মেটে। কিন্তু এটাই সব নয়। খাবার একটা উপরি
তৃপ্তিও আছে। বাঁচার জন্য খাওয়া, প্রকৃতির উদ্দেশ্যের ভিতর এটাই প্রাথমিক।
কিন্তু ওই যে উপরি তৃপ্তির কথা বলা হলো তারই টানে মানুষ জৈব প্রয়োজনকে
অতিক্রম করে খাদ্যবস্তুকে একটা শিল্প করে তোলে। শুধু বাঁচার জন্য আর খাওয়া
নয় তখন, খাবার আনন্দের জন্যই খাওয়া।
শিল্প ব্যাপারটাও ঐরকম। শিল্পীর
আত্মপ্রকাশ শুধু সামাজিক বাস্তব প্রয়োজনে নয়। বিশুদ্ধ শিল্পে আছে একটা
স্বাশ্রয়ী আনন্দের সন্ধান। শিল্পসৃষ্টির বিভিন্ন প্রেরণার ভিতর এটাকে
স্বীকার করে নিতে হয়।
কথাটা আরও একটু সাবধানে বলা যেতে পারে। প্রকাশের
আবেগ অনেক সময় শিল্পীর মনে ভূতের মতো চেপে বসে। প্রকাশটা সম্পূর্ণ না করা
পর্যন্ত তখন আর স্বস্তি নেই। যেমন কবিতার একটা লাইন হঠাৎ হয়তো মনের ভিতর
গুনগুনিয়ে উঠল, কবিতাটাকে সম্পূর্ণ না করা অবধি সেটা একটা উপদ্রবের মতো
থেকে যায়। শিল্পী তখন ব্যস্ত আনন্দের সন্ধানে নয়, মনের ভিতর এই যে একটা বেগ
সঞ্চারিত হলো সেটাকে মন থেকে মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত মন অস্থির। অবশ্য
এখানেও শিল্পকর্ম সম্পন্ন হওয়ার পর একটা বিশেষ তৃপ্তি আছে। কিন্তু ওই
তৃপ্তির প্রত্যাশায় কাজটা শুরু হয়েছিল এমন নাও হতে পারে।
শিল্পীর দিক
থেকে ব্যাপারটা এইরকম। কিন্তু শিল্পের ভোক্তাদের বেলায় একটু অন্যরকম।
শিল্পের ভোক্তারা সেই অস্থিরতার ভিতর দিয়ে যান না, যেমন যেতে হয় শিল্পীকে।
ভোক্তাদের কাছে রোগের তৃপ্তিটাই প্রধান। তারই প্রত্যাশায় তাঁরা পয়সা দিয়ে
শিল্পবস্তূ কিনতে প্রস্তুত। অবশ্য অন্য কারণও থাকতে পারে। তবু ধরে নিতে হয়,
অন্য ভাষায় একে বলা যেতে পারে, শিল্পের জন্য শিল্প। অর্থাৎ শিল্পের বাইরে
তার অন্য উদ্দেশ্য নেই।
যাঁরা সাধু তাঁরা এতে সন্তুষ্ট হবেন না।
প্রচারধর্মী শিল্প-সাহিত্যে যাঁরা বিশ্বাসী তাঁরাও নন। এই দুয়ের চোখেই,
যদিও ভিন্ন ভিন্ন কারণে, শিল্পের জন্য শিল্প ব্যাপারটা একটা বিলাস।
সাধু
বলবেন, ভোগের অন্বেষণটা প্রধান হলে বিপদ। জীবনের লক্ষ্য সেটা হতে পারে না।
লক্ষ্য হবে, চিত্তশুদ্ধি এবং সমাজে হিত। প্রচারধর্মী সাহিত্যের প্রবক্তা
বলবেন, সমাজের নীতি এবং ব্যবস্থার পরিবর্তনটাই আসল কথা। সাহিত্যের প্রবক্তা
বলবেন, সম্ভব, কিন্তু যদি কোনো সাহিত্যকর্ম এদিক থেকে সার্থক না হয় তবে
তার মূল্য কমই। ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ কাগজের ফুলের মতোই জীবন থেকে, জীবনের
গভীরতর সমস্যা থেকে বিচ্ছিন্ন।
৩
আগেই দেখেছি, আত্মপ্রকাশের ফলে মন
ভারমুক্ত হয়। জৈব অথবা প্রাকৃত স্তরে এটা ঘটে স্বাভাবিকভাবে। শিল্পে একটা
নির্মিত আবেগকে নিষ্কাশন করা হয়, এতেই ভারমুক্তি ঘটে। কেউ হয়তো শিল্পের
সমর্থনে বলবেন, এই তো চিত্তশুদ্ধি। কিন্তু সাধুর অভিযোগ এত সহজে খণ্ডন করা
যাবে না।
সাধু যে চিত্তশুদ্ধির কথা বলেন সেটা চিত্তের আরও স্থায়ী
পরিবর্তন, স্থায়ী শুদ্ধতা। শিল্প উপভোগের ভিতর দিয়ে সেই রকম স্থায়ী শুদ্ধতা
কি আসে? জৈব স্তরে এটা ঘটে না একথা আমরা জানি। ক্রোধ প্রকাশের ভিতর দিয়ে
সাময়িকভাবে হয়তো রাগটা পড়ে যায়, যেমন খেলে খিদে মেটে। কিন্তু খিদে যেমন
আবার ফিরে আসে, ক্রোধও তেমনি। এতে প্রকৃতির কোনো স্থায়ী পরিবর্তন ঘটে না।
শিল্পের বেলায় কী বলব?
সেখানে ব্যাপারটা আরও একটু জটিল। জৈব আত্মপ্রকাশের সঙ্গে শিল্পের একটা মূল পার্থক্য এবার আরও একটু ভালোভাবে খেয়াল করে দেখতে হবে।
প্রত্যেকটি
মূলভাবের একটা নিজস্ব রূপ আছে। যেমন ক্রুদ্ধ মুখ ও কণ্ঠস্বর একরকম, ভীত
অথবা প্রীত মুখ ও কণ্ঠস্বর অন্যরকম। জৈব স্তরে মানুষ যখন ক্রোধ অথবা প্রীতি
প্রকাশ করে তখন সেই ভাবের বিশেষ চেহারা নিয়ে সে সচেতনভাবে চিন্তা করে না,
আপনি সেটা এসে যায়।
কিন্তু শিল্পী সৃষ্টি করেন সচেতনভাবে তাকে সচেতন সাধনার ভিতর দিয়ে রূপ সৃষ্টি করতে হয়।
সংগীতের
কথা ধরা যাক। এদেশের শিল্পীরা দীর্ঘ আর পরীক্ষানিরীক্ষার ভিতর দিয়ে
জেনেছেন বিভিন্ন রাগরাগিণীর বিশেষ রূপ, বিভিন্ন ভাব কিংবা মেজাজের সঙ্গে
এদের সম্পর্ক। ছবির বেলাতেও ঐরকম ব্যাপার আছে। লাল আর সবুজের ভিতর দিয়ে একই
মেজাজ প্রকাশ পায় না। নৃত্যের মতোই চিত্রেরও বিভিন্ন রেখার আছে বিভিন্ন
ব্যঞ্জনা। কামরুল হাসান বস্তুর প্রাণছন্দের কথা বলেছেন। বিভিন্ন আবেগে
দেহের ছন্দের তারতম্য ঘটে। এইরকম আরও নানা উদাহরণ দেওয়া যায়। কিন্তু তার
প্রয়োজন নেই। মূল কথাটা এই, শিল্পীকে সচেতন নিষ্ঠার সঙ্গে রূপের সন্ধান
করতে হয়।
এজন্য প্রয়োজন ভাব ও বস্তুকে একটু দূর থেকে দেখা। তবেই তার
বিশেষ রূপটি সচেতনভাবে লক্ষ করা যায়, ঘনিষ্ঠভাবে চিনে নেওয়া যায়। এই যে
একটু দূরত্ব সৃষ্টি করে দাঁড়ানো, ভালোবেসে দূর থেকে দেখা, যেমন ছবি তুলতে
গিয়ে একটু দূরে দাঁড়াতে হয়, এরই ফলে জৈব আবেগের সঙ্গে শিল্পজ আবেগের একটা
মৌল প্রভেদ হয়ে যায়।
দূরত্বের ফলে যে জৈব ভাবের একটা পরিবর্তন ঘটে, এটা
অবশ্য জীবনের কিছু সাধারণ অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়েই স্পষ্ট। যেমন, ‘স্মৃতির
পটে জীবনের ছবি’র আস্বাদ ভিন্ন, চরিত্র ভিন্ন। ছেলেবেলাকার কিছু তাৎক্ষণিক
অভিজ্ঞতা, সেই মুহূর্তে যেটা আমাদের উত্তেজিত করেছিল, কালের দূরত্ব পেরিয়ে
স্মৃতির ভিতর দিয়ে যখন ফিরে আসে তখন তাতে আর সেই উত্তেজনা নেই। অথচ তাতে
একটা সত্য ও সৌন্দর্য আছে। এরই সঙ্গে যোগ শিল্পীর অভিজ্ঞতার।
বিদ্বেষ
যেমন প্রেমেরই এক আহত রূপ, আমাদের বহু জৈব আবেগের পিছনে তেমনি আছে জৈব তাকে
অতিক্রম করে যাওয়ার একটা অন্ধ আকুলতা। দূরত্ব রক্ষা করে তাকালে তবে সেটা
চোখে পড়ে। সব শিল্পেই এটা সমানভাবে ঘটে এমন নয়। তবু শিল্পের স্বভাবের ভিতরই
আছে তার সম্ভাবনা। শিল্পীর অভিজ্ঞতাকে ব্রহ্মস্বাদের সহোদর বলা হয়েছে।
অভিন্ন নয়, তবু সহোদর। একে আমরা চিত্তশুদ্ধি বলব কি না সে প্রশ্ন আপাতত
তোলা থাক। কিন্তু জৈব অভিজ্ঞতা থেকে শিল্পবোধ ভিন্ন বস্তু, একথা মেনে নিতেই
হয়।
সব শিল্প মহৎ শিল্প নয়। তবে শিল্পের কিছু সামান্য লক্ষণ আছে।
মানুষের মনে সাধারণ নানা বিরোধী কিংবা বেখাপ ভাবের বিশৃঙ্খলা চলে। শিল্পে
রূপদান করতে গিয়ে ছোটো-বড়ো বিবিধ কিংবা ভাবকে প্রধান ভাবের অধীনে আনতে হয়।
সেই প্রধান ভাবের সঙ্গে অংশের সামঞ্জস্য রক্ষা করে তবেই রূপ নির্বাচন
সম্ভব। এই সামঞ্জস্যবিধান করতে গিয়ে শিল্পী হয়ে ওঠেন স্রষ্টা।
যেমন
শিল্পী তেমনি সমঝদার ভোক্তা, পাঠক অথবা শ্রোতাও আর নিছক প্রাকৃত স্তরের
মানুষ থাকেন না। সংগীতের কথাই আবার ধরা যাক, বিশেষত উচ্চাঙ্গ সংগীত। সমঝদার
শ্রোতা জৈব আবেগে আপ্লুত হন না। বিশেষ ভাবে অথবা মেজাজা, বিশেষ রাগরাগিণী,
যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলা হলো কি না, শিল্পীর নিজস্বতা কোথায় কীভাবে প্রকাশ
পেল, এইসব শ্রোতার সূক্ষ্ম বিচারের ভিতর এসে যায়। এরই সঙ্গে মিলিত হয়ে। তবে
আসে আবেগ। কাব্য অথবা সাহিত্যবিচারেও ছন্দ, শব্দচয়ন, চরিত্রচিত্রণ,
সমগ্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য, এইসব ভাবনার ভিতর রাখতে হয়। তা নইলে শিল্প অথবা
সাহিত্যের মূল্যায়ন যথার্থ হয় না। অর্থাৎ শিল্পীই হোন আর শিল্পের ভোক্তাই
হোন, একজন দরদি বিচারক তাঁর ভিতর থাকেন, নয়তো সেটাকে শিল্পবিচার বলা যায়
না।
বাস্তব দৃষ্টিতে দেখতে গেলে সমাজে পরিবর্তন ঘটানোর কাজে
শিল্প-সাহিত্যের প্রভাব সত্যি কতটা? পরিবর্তন ঘটে নানা শক্তির সংঘাতের ভিতর
দিয়ে। যুদ্ধ ও আর্থিক সংকট, বিভিন্ন জাতির উত্থান ও পতন, বিজ্ঞানের নবনব
যুগান্তকারী উদ্ভাবন, এই সবের ভিতর দিয়ে সমাজ ও ইতিহাস কীভাবে বদলে চলে
আমরা তা দেখছি চোখের সামনেই। মানুষের মন ও সমাজ নিয়ে নতুন চিন্তার প্রভাবও
লক্ষ করা গেছে আমাদের যুগে। সাহিত্যের ক্রান্তিকারী ভূমিকাকে কখনো কখনো অতি
বড়ো করে ভাবা হয়েছে, সেটা সম্ভবত কল্পনাবিলাশ। বিশেষ বিশেষ সামাজিক
প্রশ্নে সাহিত্যের প্রভাব স্বীকার্য। কিন্তু সমাজের সামগ্রিক পরিবর্তনের
কারণ খুঁজতে হবে অন্যত্র। আর সাহিত্য যখন রাজনীতির পতাকার নিচে এসে দাঁড়ায়
তখন চারদিকে চাঞ্চল্য নিঃসন্দেহে বাড়ে; কিন্তু সমাজের দুঃখ তাতে কমে কি না,
মনুষ্যত্বের গৌরব বাড়ে কি না, সে বিষয়ে মনের পার্থক্য আছে।
৪
মানুষের
কিছু মৌল দুঃখের কেন্দ্রে আছে প্রেম ও মৃত্যু। বিজ্ঞানের আশীর্বাদে
মানুষের আয়ু বাড়বে, দারিদ্র্যের বীভৎসতা আশা করা যায় ক্রমে দূর হবে। কিন্তু
এমন কোনো ব্যবস্থা নেই যাতে সেইসব মানুষেরা চিরজীবী হবে– যাদের আমরা
ভালোবাসি। মৃত্যু আছে, অতএব বিরহ আছে। মৃত্যু প্রেমাস্পদেরই নয়, মৃত্যু হয়
প্রেমেরও। এমন ব্যবস্থা নেই যাতে প্রেমকে নিশ্চিতভাবে মৃত্যুর হাত থেকে
রক্ষা করা যাবে। আজকের উত্তপ্ত আবেগ, উষ্ণ প্রেম, একদিন ধীরে ধীরে শীতল হয়ে
যায়, মৃতদেহের শীতলতার চেয়েও সেটা ভীষণ হতে পারে। সব প্রেম একই কালে
মৃত্যুর দুয়াবে এসে পৌঁছয় না। একটি মৃত প্রেমের শিয়রে বসে থাকে
স্বান্ত্বনাহীন কোনো প্রেমিক। এই রিক্ততার মরুভূমি বিস্তৃত হয়েই চলেছে।
মানুষের
মন প্রসারিত হয় শুধু অন্য মানুষের দিকেই নয়। মানুষ ভালোবাসতে চায় জীবনকে।
অথচ পৃথিবী চলে তার নিজের নিয়মে মানুষের ভালোবাসার দাবির সঙ্গে যার মিল হয়
না। এই মুহূর্তে পৃথিবী স্নিগ্ধ, পরমুহূর্তে সে হিংস্র অথবা উদাসীন।
আন্দোলন করে হৃদয়ের ক্ষত দূর করা যায় না।
এইসব অনিশ্চয়তার পরিচয় পেয়ে
মানুষ কখনো খুব সতর্ক হয়ে যায়। কিন্তু তাতেও সমস্যার শেষ হয় না। সতর্ক হওয়া
মানেই প্রেমকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া। সেই প্রেমহীন জীবন, বিস্বাদ
জীবনকে সতর্কভাবে রক্ষা করারও মানে হয় না।
সতর্কতায় মুক্তি নেই,
আত্মবিস্মরণেও সর্বনাশ ঠেকানো যায় না। জীবনের বর্ণ-গন্ধ-মনোহরতা রক্ষা করার
আশায় পৃথিবীকে আমরা প্রাণপণে ভালোবাসি, ‘বসুধার মৃত্তিকার পাত্র’ ভরে
আকণ্ঠ পান করি মদিরা। সেই ভালোবাসাই আবার আমাদের ঠেলে দেয় নৈরাশ্যের দিকে।
আমরা সাবধানী হয়ে উঠি। তখন আমাদের জীবনের মূল থেকে সাবধানতাই রস শুষে নেয়।
সতর্কতা
আর আত্মবিস্মৃতি নিয়ে এই যে অস্তিত্বের উভয়সংকট, সংগীত অথবা সাহিত্য এ
থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারে না। তবু শিল্পের দরদি উচ্চারণে একটা
সান্ত্বনা আছে। আামাদের ব্যর্থ সাধনের কথা অন্তঃস্থিত এক উচ্চতর সত্তার
কাছে নিবেদনের মধ্যেই আছে কিছু সান্ত্বনা। সাহিত্যের একমাত্র কাজ নয়, এমনকি
প্রধান কাজও হয়তো নয়, নীতিপ্রচার কিংবা বাইরে কোনো পরিবর্তনসাধন। কোলাহলের
বাইরে দেখি সাহিত্যের একটি স্থায়ী আসন। প্রেমের মুগ্ধতা আর নৈরাশ্যের
প্রান্তে দাঁড়িয়ে সংকটের রূপময় চিত্রণ কিংবা উচ্চারণের ভিতর দিয়ে শিল্প
রেখে যায় মনুষ্যত্বের এক বিপন্ন মহিমার চিরন্তন স্বাক্ষর।
বিশুদ্ধ শিল্পের মূল তাই অন্য এক বাস্তবতায়। তার রসের শেষ নেই। মানুষের মুগ্ধ লোচন আর অশ্রান্ত রোদনের মতোই সে অন্তহীন।
চিত্তশুদ্ধি নিয়ে যে প্রশ্নটা তোলা ছিল আবার সেখানে ফিরে আসা যাক।
মোক্ষ
অর্থে বিশ্বের সঙ্গে একাত্মতা। কখনো কখনো এমন একটা তন্ময়তার বোধ আমরা লাভ
করি যেখানে হিংসা, ক্রোধ, ভয়– এইসব জৈব আবেগের ছায়া নেই। ক্ষণস্থায়ী হলেও
এই বোধই আমাদের কাছে মোক্ষের ইঙ্গিত এনে দেয়।
বিশ্বের সঙ্গে একাত্মতা
অনুভবের মুহূর্তে আমাদের কোনো অভাববোধ থাকে না। এমনকি সেই অনুভবকে প্রকাশ
করার চিন্তাও তখন থাকে না। প্রত্যাবর্তনের কোনো মুহূর্তে হয়তো সেই পলাতক
অনুভবটিকে আমরা শিল্পের ভিতর বাঁধার কথা চিন্তা করি।
সেই বোধ থেকে
প্রত্যাবর্তন ঘটে নানা পথে। সাধারণ মানুষ শুধু একটি অস্পষ্ট স্মৃতি নিয়ে
সংসারে ফিরে আসে। কিছু অসাধারণ মানুষ ফিরে আসেন করুণার পথে, সংসারে নিজেদের
নিযুক্ত করেন সেবার কাজে।
শিল্পীমাত্রেরই এই অভিজ্ঞতা লাভ হয় এমন নয়।
কারও হয়, কারও হয় না। কারও জীবনে এটা প্রধান অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে, কারও থাকে
না। শিল্পী অভিজ্ঞতার যে স্তরেই থাকুন না কেন, তাঁর প্রধান লক্ষণ হলো, তিনি
সেই স্তরের ভাবকে রূপদান করতে আগ্রহী হন। রূপের প্রতি এই আগ্রহই শিল্পীর
স্বধর্ম।
সাধুর আগ্রহ মোক্ষের প্রতি। মোক্ষানুভূতি থেকে প্রত্যাবর্তনের
পথে সাধু যদি মানুষের সেবার জন্য সংসারে প্রবেশ করেন তবেই তাঁকে
পরিপূর্ণভাবে ধার্মিক বলা যায়। ধর্ম আর মোক্ষ এক বস্তু নয়। মোক্ষের সঙ্গে
সেবাধর্মের যোগ স্থাপিত না হলে সেটা পরিপূর্ণ ধর্ম নয়।
আগেই দেখেছি, ভয়,
ক্রোধ ইত্যাদি জৈব আবেগ থেকে মুক্ত মোক্ষানুভূতি। একেই বলা সম্ভব
চিত্তশুদ্ধি। এই চিত্তশুদ্ধি সাধু রক্ষা করতে চান যথাসাধ্য। সাধুও শিল্পী
হতে পারেন। কিন্তু সাধুকে শিল্পী হতে হবে এমন নয়। চিত্তশুদ্ধি কিন্তু সাধুর
জন্য চাই। সাধুত্বের এটা এক স্থির লক্ষ্য। শিল্পীর এটা স্থির লক্ষ্য না
হতেই পারে।
সাধারণ মানুষ এই পার্থক্য স্বীকার করে নিয়েছে। শিল্পীর কাছ
থেকে সাধারণের এই প্রত্যাশা নেই যে তিনি ত্যাগী হবেন। কোনো সাধু সম্বন্ধে
যদি শোনা যায় যে তিনি লোভী তবে আমরা তাঁর সাধুত্ব সম্বন্ধেই প্রশ্ন তুলি।
সাধু বলে আর তাঁকে স্বীকার করি না। কোনো ওস্তাদ গায়ক অথবা অভিনেতা অথবা কবি
সম্বন্ধে যদি শোনা যায়, তাঁর চরিত্রের দুর্বলতা আছে, তবে আমরা অচিরাৎ এই
সিদ্ধান্তে আসি না যে তিনি আসলে শিল্পী নন।
শিল্পী যদিও কিছু দূরত্ব
রক্ষা করে নিরীক্ষণ করেন, সেই ভাবের বিশেষ রূপটি আবিষ্কার করার উদ্দেশ্যে
যদিও এর ভিতর দিয়ে জৈব আবেগের কিছু ঊর্ধ্বে তিনি ওঠেন সাময়িকভাবে, তবু তাঁর
জন্য জৈবভাবে প্রত্যাবর্তনের পথ রুদ্ধ নয়। বস্তুত শিল্পী যে ভাবটি প্রকাশ
করেন, তিনি একই সঙ্গে তাতে অংশত আবদ্ধ এবং অংশত তা থেকে মুক্ত। যে সাংসারিক
আবেগের উপকরণ নিয়ে শিল্পী তাঁর সৃষ্টি কাজে নিযুক্ত সেই উপকরণ যদি তাঁকে
মুগ্ধ করে তবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
সাধুর কাছে সেটাই ভয়ের কথা
শিল্পীর পথ সাধুকে হয়তো কখনো আকর্ষণ করে তবু সে সম্বন্ধে তিনি সতর্ক গৌতম
বুদ্ধ এবং হজরত মোহম্মদ (সা.) চিত্র এবং সংগীত সম্বন্ধে সতর্ক ছিলেন।
সাধু
হওয়ার বিপদ এই, তিনি সংসার থেকে সরে যেতে পারেন। শিল্পী সংসারে আবদ্ধ হয়ে
যেতে পারেন, ‘হাসির মায়ামৃগীয় পিছে’ নয়ন নীরে ভাসার খেলটাই তাঁকে পেয়ে বসতে
পারে। তবে সাধু সংসার ত্যাগ করবেনই এমন কোনো কথা নেই। শিল্পী সংসারে আসক্ত
হবেন এমনও কথা নেই।