জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়ছে আমাদের দেশের ওপর। প্রতি বছর কোনো না কোনো দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ুগত কারণে আঘাত হানছে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস। এতে বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হচ্ছে বিস্তীর্ণ জনপদ। দেখা দিচ্ছে সুপেয় পানির সংকটসহ নানা সমস্যা।
মানুষ দীর্ঘদিন ধরে প্রতিকূল পরিবেশে ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে এলেও একটি সময় তারা অন্যত্র স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হচ্ছে। এর ফলে তাদের দৈনন্দিন জীবনে তৈরি হচ্ছে নতুন সংকট। প্রতি বছর জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আঘাত হানা দুর্যোগে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে সে অনুযায়ী বরাদ্দ আসছে না জলবায়ু মোকাবিলায়। অন্যদিকে জলবায়ু অর্থায়ন প্রশমন ও অভিযোজন খাতে সমানভাবে বণ্টন না হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার নানামুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও কোনো সমাধান মিলছে না।
জলবায়ু তহবিলের অর্থে যেসব প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনে কোনো পরিবর্তন আনছে না। বিগত দিনে আমরা দেখেছি, জলবায়ু তহবিলের অর্থ দিয়ে সড়কবাতি স্থাপন, পার্ক তৈরি, পুকুরের ঘাট বাঁধানোসহ নানা ধরনের কাজ করা হয়েছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিপন্ন মানুষের সহায়তায় বা তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে কোনো কাজে আসছে না। এ জন্য জলবায়ু তহবিলের অর্থ পরিকল্পিতভাবে জলবায়ু ভুক্তভোগীদের জন্য ব্যয় করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্তরা যাতে পুনরায় স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরতে পারে সেসব দিকে খেয়াল রেখে প্রকল্প হাতে নিতে হবে।
পৃথিবীর ধনী এবং বড় বড় রাষ্ট্রগুলো নিজস্ব শিল্প ও অর্থনীতি শক্তিশালী করতে অধিক পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ করছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বা বিলাসিতাপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য যে কার্বন বা ফুয়েল ব্যবহার করে তার সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে যেসব দেশের ওপর তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া সবচেয়ে বেশি দায়ী। একটি পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীর সমগ্র নির্গমনের এক-চতুর্থাংশই আসছে চীন থেকে।
প্রতি বছর চীন মোট ১১ হাজার ৫৩৫ মেগা টন কার্বন নির্গমন করে। কিন্তু দেখা গেছে, বছরের পর বছর জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন কাঠামো কনভেনশনের সদস্য দেশগুলোর বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলনে বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য দায়ী দেশগুলো নানাভাবে নিজেদের দায় এড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য অর্থাৎ অতিরিক্ত মাত্রায় কার্বন নির্গমনের ফলে পৃথিবীর যেসব রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে না। আর কখনো দিলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অনেক কম। আবার এসব ধনী রাষ্ট্র অনেক সময় ক্ষতিপূরণের নামে উচ্চ সুদে ঋণ দিচ্ছে। যে ঋণ দরিদ্র দেশগুলোর জন্য একটি বড় বোঝা তৈরি করছে। এতে অনেক দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের তথ্য মতে, জলবায়ু ও পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। সেখানে ১-২ বিলিয়ন ডলার আনতেই বেশ বেগ পেতে হয়। সুতরাং সহজেই বোঝা যাচ্ছে, প্রয়োজনের তুলনায় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় যে অর্থ আসে তা খুবই সামান্য। আবার এই সামান্য অর্থ থেকে যদি অন্য প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় তা হলে নিশ্চয় তা ভুক্তভোগীদের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। বিগত দিনে যে কাজ বারবার হয়ে আসছে। যার জন্য ভুক্তভোগী মানুষের পুনর্বাসন বা জীবনমানের উন্নয়ন হয়নি। তাই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, জলবায়ু তহবিলের টাকায় অধিকাংশ প্রকল্প দেওয়া হয়েছে দেশের বিভিন্ন জেলার পৌরসভাগুলোকে। পৌর এলাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা, রাস্তার সৌন্দর্যবর্ধনে নানা পরিকল্পনা, পাবলিক টয়লেট নির্মাণসহ সড়ক সংস্কারের কাজে এই টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। দেশের অনেক জায়গায় এই তহবিলের টাকা দিয়ে পার্ক নির্মাণের খবরও পত্রপত্রিকার পাতায় উঠে এসেছে। অথচ জলবায়ু অভিযোজন নামে বাস্তবায়ন করা এসব প্রকল্পে যারা জলবায়ু ভুক্তভোগী তারা কোনো সুফল পাচ্ছে না। আমরা দেখেছি, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূল বা উত্তরের চরাঞ্চলে সমস্যা-সংকটের শেষ নেই।
দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে সুপেয় পানির তীব্র সংকট ভুগছে। বছরের পর বছর চলে গেলেও তাদের সুপেয় পানির জন্য যেসব পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে তা যথেষ্ট নয়। তাদের দীর্ঘদিনের দাবি টেকসই বেড়িবাঁধ, যেখানে সরকারের দুটি মেগা প্রকল্প চলমান থাকলেও বাস্তবায়নে রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। কাজও চলছে ধীরগতিতে। এ ছাড়া বিগত কয়েক বছর ধরে সলুইসগেট অকেজো হয়ে পড়ায় উপকূলীয় জনপদে বছরের অর্ধেক সময়জুড়ে তৈরি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হওয়া জনপদের অনেক পরিবার বাস্তুভিটা হারিয়ে উদ্বাস্তু হচ্ছে।
তাদের পুনর্বাসনেও সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। এদিকে জলবায়ু ভুক্তভোগী মানুষের দীর্ঘদিনের এসব সমস্যা নিরসন না করে জলবায়ু তহবিলের টাকা চলে যাচ্ছে অন্যান্য প্রকল্পে। যেহেতু জলবায়ু তহবিলটি গঠন করা হয়েছিল অভিযোজনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে, সেহেতু সরকারের উচিত হবে সিংহভাগ বরাদ্দ এই খাতে দেওয়া। বেড়িবাঁধ নির্মাণ, সুপেয় পানি নিশ্চিত, লবণসহিষ্ণু ফসলের বীজ উৎপাদন, ভাসমান সবজি চাষের মতো প্রকল্প হাতে নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জীবনমান উন্নয়নে সাহায্য করা। কারণ জলবায়ু তহবিলের অর্থ যদি যথোপযুক্তভাবে ব্যয় করা না হয় তা হলে উপকূলের মানুষের জীবন-জীবিকা মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়বে।
আর এর নেতিবাচক প্রভাব আমাদের দেশের অর্থনীতির ওপর এসেও পড়বে। আমরা আশা রাখি, সরকার জলবায়ু ভুক্তভোগীদের কথা মাথায় রেখে আগামীতে প্রকল্প হাতে নেবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর বরাদ্দকৃত টাকা প্রশমন ও অভিযোজন খাতে সমানভাবে বণ্টন করার বিষয়ে আরও সচেতন হবে। যেখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। পাশাপাশি পরিকল্পনা গ্রহণের সময় জলবায়ু তহবিলের টাকা যাতে জলবায়ু সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে ঠিকমতো বরাদ্দ দেওয়া হয় সে বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।