শয়তানের নিশ্বাসে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন একশ্রেণির সহজ-সরল মানুষ। অপরাধী চক্রের সদস্যরা যখন যে নির্দেশ দেয়, ভুক্তভোগী ব্যক্তি একান্ত অনুগত হয়ে সেটাই করতে থাকেন। ফলে শুধু টাকা বা মুঠোফোন নয়, কেউ কেউ আরও মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। খবরের কাগজের কাছে এ বাস্তবতা তুলে ধরেছেন একাধিক ভুক্তভোগী। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, চিহ্নিত অপরাধী চক্র ‘স্কোপোলামিন’ জাতীয় একধরনের কেমিক্যালের ব্যবহার করছে টার্গেট করা ব্যক্তির ওপর।
এরপর তার কাছ থেকে টাকা, মোবাইল ফোন, ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডসহ সবকিছু হাতিয়ে নিচ্ছে। ভুক্তভোগীদের করুণ গল্প শুনলে কারও কারও মনে হতে পারে কোনো কাল্পনিক ঘটনা। কিন্তু না। বাস্তবে এমন ঘটনাই ঘটছে আমাদের চারপাশে।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুক্তভোগী এক শিক্ষক জানান, তিনিও এ চক্রের কবলে পড়েন। চক্রটি মূলত পেশাদার ছিনতাইকারী। তারা শয়তানের নিশ্বাস বা বিশেষ ধরনের কেমিক্যাল স্প্রে, চেতনানাশকসহ নানা উপকরণ ব্যবহার করে অপকর্ম চালায়। তার ওপর এসব উপকরণ বা স্প্রে প্রয়োগের সুযোগ না পেয়ে তারা ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে। তিনি মামলা করায় চিহ্নিত ওই ছিনতাইকারীরা তাকে হুমকি দেয়; এমনকি তার বাসার সামনেও কয়েক দিন ধরে মহড়া দেয়। এ রকম অনেক ভুক্তভোগী রয়েছেন, যারা রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এ ধরনের চক্রের কবলে পড়েছেন।
কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রে একজন চিকিৎসক জানান, স্কোপোলামিন সাধারণত মানুষের নাকের চার থেকে ছয় ইঞ্চি কাছাকাছি এলেই নিশ্বাসের আওতায় চলে আসে। নিশ্বাসের সঙ্গে এটি গ্রহণ করলে মাত্র ১০ মিনিট বা তারও আগে প্রভাব শুরু হয়ে যায়। স্মরণশক্তি বা মস্তিষ্ক তখন স্বাভাবিক বা সচেতনভাবে কাজ করতে পারে না। পরে আক্রান্ত ব্যক্তি স্বাভাবিক হতে এক থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি সময় লাগে। তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, ২০২৩ সালের ২৩ আগস্ট দেশে প্রথমবারের মতো স্কোপোলামিন বা ডেভিলস ব্রেথ বিষয়টি সবার সামনে আসে। বিশ্লেষকদের তথ্যমতে, স্কোপোলামিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোতে ব্যবহারের নজির আছে। তখন এর ব্যবহার হতো লিকুইড হিসেবে। ইনজেকশনের মাধ্যমে সেটি শরীরে প্রবেশ করানো হতো। বর্তমানে মেক্সিকোর কিছু মাদক চক্র এটি উৎপাদন করে বিভিন্ন দেশে পাচার করে থাকে বলে জানা যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শেখ জহির রায়হান বলেন, ধুতরা ফুল বা ফল থেকে স্কোপোমালিন তৈরি করা হতো। তবে এখন সেভাবে আর চিকিৎসা ক্ষেত্রে এটির ব্যবহার হয় না। বরং আরও অনেক উন্নত ও ভালো মানের ওষুধে ব্যবহৃত হয়। স্কোপোলামিন বা ডেভিলস ব্রেথ বর্তমানে মাদক হিসেবে বিভিন্ন চক্রের মাধ্যমে পাচার হয়ে অপরাধীদের হাতে চলে যাচ্ছে।
ডেভিলস ব্রেথ বা শয়তানের নিশ্বাস এখন ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকা ছাড়াও দেশের আনাচে-কানাচে। এটি ছিনতাইকারী ও প্রতারক চক্রের মধ্যে বেশি ব্যবহৃত হয়। শয়তানের নিশ্বাসের প্রভাব শারীরিক ও মানসিকভাবেও পড়ে। এতে করে সাধারণ মানুষ যেকোনো সময় এ চক্রের হাতের পুতুলে পরিণত হন। অনেক সময় মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। তাই এ চক্রকে চিহ্নিত করে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশের কোথাও এ ধরনের অপতৎপরতার অভিযোগ পেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। সাধারণ মানুষকেও এ ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। আশা করছি, সরকার শয়তানের নিশ্বাস থেকে বাঁচতে জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দেবে এবং অপরাধীদের খুঁজে বের করে শাস্তি নিশ্চিত করবে।