প্রকৃতির নিয়মে রাত্রির নিঃসীম অন্ধকার ভেদ করে রৌদ্রকরোজ্জ্বল ভোর আসে। প্রভাতের এমন স্নিগ্ধ সৌন্দর্য-কোমল আলোর অভিসারী ছিলেন মাহেরীন চৌধুরী। মনোবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ফ্রয়েবেলস কথিত শিশু বাগানের মালি ছিলেন মাহেরীন চৌধুরী। যিনি নিজের জীবন নিঃশেষ করে মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের অপাপবিদ্ধ ২০টি শিশুসন্তানের জীবন রক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। জীবনের মায়াকে তুচ্ছ মনে করে, মরণের ভয়ে ভীত না হয়ে তিনি ত্যাগ ও তিতিক্ষায় যেন জননী সাহসিকা। নিজের জীবন উৎসর্গ করে প্রমাণ করেছেন, তিনি শুধু তার দুটি সন্তানের মা নন, মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের আগুনে দগ্ধ ২০টি সন্তানসহ অগণিত শিশুর মায়াবতী জননী। আজ তিনি মরেও অমর। মনীষী মার্সি স্টিল বলেছেন, ‘প্রকৃত বীরেরা কখনোই মরে না।’ মাহেরীন চৌধুরী তেমনি প্রকৃত একজন বীর, যিনি মরেও অমর হয়ে রইলেন।
২১ জুলাই সোমবার দুপুর ১টা ১৮ মিনিট। আফতাবনগর, মোহাম্মদপুর, গাজীপুর এবং উত্তরার বিভিন্ন ক্যাম্পাসের প্রায় ৫০টি ভবনের মধ্যে দিয়াবাড়ীর মাইলস্টোন অ্যান্ড কলেজে হঠাৎ করেই বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণে নিয়োজিত একটি যুদ্ধবিমান যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে আঘাত হানল। বিমানটি বিধ্বস্ত হলো। সঙ্গে সঙ্গে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। সেই সময় স্কুলটিতে ছুটির ঘণ্টা বাজার সময় ছিল। সময়টা ছিল দুর্ভাগ্যের কালো মেঘ ঘনিয়া আসার সময়। সেই ঘনকালো দুঃসময়ে শ্রেণিকক্ষে এবং স্কুল চৌহদ্দিতে দাউ দাউ করে আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলে উঠল। কিংকর্তব্যবিমূঢ়কোমলমতি শিক্ষার্থীরা আগুনের গোলায় নিমজ্জিত হতে থাকল।
রাজউক কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ কর্নেল নূরুন্নবী প্রতিষ্ঠিত মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের দিয়াবাড়ী শাখার সমন্বয়কের দায়িত্বে নিয়োজিত স্থানীয় প্রশাসক মাহেরীন চৌধুরী তখন নিজের জীবনের মায়া না করে, নিজের সন্তানের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সব শিশুর মা হয়ে তাদের উদ্ধারে নিজেকে নিয়োজিত করলেন। তখন তার নিজের শরীরেরও আশি শতাংশ পুড়ে গেছে। আপাদমস্তক আগুনে ঝলসানো। কিন্তু তিনি নিজের স্বামীর, দুটি সন্তানের দিকে এবং নিজের জীবন রক্ষার দিকে একবারও তাকালেন না। আত্মোৎসর্গকৃত বীরের মতো আগুনের ফুলকির মধ্য থেকে একে একে ২০টি শিশুকে উদ্ধার করলেন। এ সময়ে ফোনে তার স্বামী মনসুর আলী হেলাল তাকে নিজের জীবন বিপন্ন না করে নিরাপদে আশ্রয়ে যাওয়ার সানুনয় অনুরোধ করলেন। কিন্তু তিনি তার স্বামীর কথা শুনলেন না।
বললেন, ‘আতঙ্কগ্রস্ত মাইলস্টোনের শিশুসন্তানরাও আমার সন্তানের মতো। তাদের আসন্ন এ বিপদে রেখে কীভাবে আমি নিজের জীবন রক্ষায় নিরাপদে স্থান ত্যাগ করি।’ সেই ঘন দুর্যোগকালে স্বামীর বারংবার অনুরোধকে উপেক্ষা করে মায়ের চেয়েও অধিক মমতাময়ী শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরী একে একে আগুনে দগ্ধ সন্তানতুল্য ২০টি শিশুসন্তানকে বের করে আনলেন। কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন যুদ্ধবিমানটি বিস্ফোরিত হলো, তখন তার আঘাতে বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলেন তিনি।
তার নিথর দেহ বার্ন ইনস্টিটিউটে নেওয়া হলো। জীবনসঙ্গী মনসুর আলী হেলাল বার্ন ইনস্টিটিউটে উপস্থিত হলেন। বার্ন ইউনিটের উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বললেন, ‘আমি বারবার ফোনে অনুরোধ করেছিলাম নিরাপদ স্থানে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমার স্ত্রী আমার কথা শুনল না। সে ফোনে বলল, আসলে ওরাও তো আমার ছোট্ট বাচ্চা। ওদের বিপদে ফেলে আমি কি আমার জীবন রক্ষায় ব্যস্ত হতে পারি।’
আসলে এই ছোট্ট একটি বাক্য- ‘ওরাও তো আমার বাচ্চা’- এরই মধ্যে মহামহিম মাহেরীন চৌধুরী নিবেদিতপ্রাণ ও আত্মোৎসর্গকারী জীবনের মৌল দর্শন নিহিত।
উৎকণ্ঠিত স্বামী মনসুর হেলাল কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে হাসপাতালে বিছানায় শায়িত থাকা অবস্থায় তার দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল, ডান হাতটা শক্ত করে ধরো। কিন্তু আত্মত্যাগী মাহেরীন চৌধুরীর সারা শরীর তখন দগ্ধ। কোথাও হাত রাখার জো নেই। অঝোর কান্নায় স্বামী যখন জিজ্ঞেস করলেন, কেন এমন করলে, নিজের জীবন বিপন্ন করে অন্যদের জীবন রক্ষায় এগিয়ে গেলে? উত্তরে শুধু মৃত্যুশয্যায় শায়িত স্ত্রী মাহেরীন বললেন, ওরাও তো আমার সন্তান। চোখের সামনে বাচ্চাগুলো জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত ছিল। ওদের রেখে কীভাবে আমি চলে আসি? আমার সামনে আমার বাচ্চারা পুড়ে মারা যাচ্ছে। আমি কীভাবে সরে যেতে পারি? লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার আগেই জীবনসঙ্গী মনসুর আলী হেলালের হাতটা বুকের মধ্যে নিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে তোমার আর দেখা হবে না। এরপর ভেন্টিলেশনে নেওয়ার এক থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যেই তিনি কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলেন। রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন সর্বত্যাগী এই বীর রমণী মাহেরীন চৌধুরী (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
সাদা কাপড়ে মুখ ঢেকে দিয়ে স্বামী মনসুর আলী হেলাল কান্নাভেজা কণ্ঠে বললেন, আমার দুটি ছোট বাচ্চা। তাদের রেখে মাহেরীন চিরতরে চলে গেল। মৃত্যুশয্যায় আমি বলেছিলাম, তুমি তোমার বাচ্চাদের এতিম করে ফেললে। উত্তরে সে বলেছিল, ওরাও তো আমার বাচ্চা ছিল। আসলে স্কুলের সব বাচ্চাকে নিজের বাচ্চা বলে মনে করার মধ্যেই মাহেরীন চৌধুরীর হৃদয়ের বিশালতার প্রমাণ মেলে। এভাবে পরের তরে জীবন দিয়ে মাহেরীন চৌধুরী মায়েদের জন্য ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত এক অনুসরণীয় মা হয়ে রইলেন।
আসলে মাহেরীন চৌধুরী ছিলেন শিক্ষিকদের জন্য অবশ্য অনুকরণীয় শিক্ষিকা। শিক্ষক সমাজের আলোকবর্তিকা। জাতির মেরুদণ্ড শক্ত-পোক্ত করার এক অতুলনীয় মানবী। ফ্রোয়েবেলস কথিত শিশু বাগানের মালি। কবি গোলাম মোস্তফা কথিত বিশ্বজগতের ফুলবাগিচার মালি। আসলে তিনি তার শিশু শিক্ষার্থীদের জীবনের সর্বাঙ্গীণ পরিচর্যার এবং সর্বজনীন চাহিদার সযত্ন দায়িত্বটুকু নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন। নিজস্ব নম্র-মধুর আচরণ তাকে অন্য এক উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছিল। বহুমাত্রিক মানবিক বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক অনন্য বিশেষ গুণের অধিকারী একজন শিক্ষক তিনি। চিত্তের প্রসারতা ও সহিষ্ণুতা বিধানের দক্ষতা তাকে সেরাদের সেরা শিক্ষকে পরিণত করেছিল। মানবায়িত মহৎ জীবনই তার মূল মন্ত্র ছিল। দৃঢ় মানসিকতা, সাহসিকতা, সহজ জীবন ও মহৎ ভাবনা তার জীবনাদর্শ ছিল।
নিরপেক্ষ ও উদার চিত্ত, মহানুভবতা আর সংবেদনশীলতা তার হৃদয়ে সর্বদা সক্রিয় ছিল। শিক্ষাবিদ ও মনীষী রুশোর বর্ণনা অনুযায়ী তিনি ছিলেন কোমলমতি শিক্ষার্থীদের একান্ত আপনজন এবং খেলার সাথি।
শিক্ষার্থীদের জীবনবিকাশ তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল। ত্যাগে তিনি ছিলেন তুলনারোহিত। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে নিজের জীবন আকাতরে বিলিয়ে দিয়ে তিনি ত্যাগের সর্বোচ্চ নজির স্থাপন করে গেলেন।
মহৎ মানবী মাহেরীন চৌধুরী ১৯৮৩ সালে নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলার বগুলানারী গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মহিতুর রহমান চৌধুরী, মায়ের নাম সাবেরা চৌধুরী। মহিতুর রহমান চৌধুরী ছিলেন শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আপন খালাতো ভাই। দাদি রওশনারা বেগম ছিলেন শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মা মরহুম জাহানারা খাতুনের আপন বোন। এত বড় জমিদার ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নিয়ে ভাবে-অনুভবে কোনো অহংবোধ ছিল না তার। নিপাট সরল ও সাদা মনের অমায়িক মানুষ ছিলেন তিনি।
দুই বোনের মধ্যে বড় ছিলেন মাহেরীন চৌধুরী। তিনি শাইনপুকুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। এরপর সরকারি তিতুমীর কলেজের ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতক সম্মান এবং মানারত ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৭ বছর তিনি মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। ২০০৬ সালে তিনি সেখানে যোগদান করেন। প্রথম এক বছর শিক্ষকতা করার পর বিয়ের কারণে তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে দেন। কিন্তু শিক্ষকতাকে তিনি যে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছেন তা কি তিনি ছাড়তে পারেন? তাই এক বছর বিরতি দিয়ে আবার মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে যোগদান করেন। মৃত্যু অবধি তিনি সেখানেই কর্মরত ছিলেন।
সদ্য এসএসসি পাস জ্যেষ্ঠ পুত্র রহীদ মিয়াদ চৌধুরী এবং নবম শ্রেণিতে অধ্যায়নরত কনিষ্ঠ পুত্র আদিল রহীদ মাহিব চৌধুরী নামের দুই পুত্রসন্তান রেখে গেছেন তিনি। জীবনসঙ্গী মনসুর আলী হেলাল একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক। মায়ের এমন দৃষ্টান্তযোগ্য উৎসর্গীকৃত জীবন সম্পর্কে বলতে গিয়ে জ্যেষ্ঠ পুত্র রহীদ চৌধুরী এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘আমরা গর্বিত! আমাদের মা নিজের জীবন তুচ্ছ মনে করে অন্যদের জীবন বাঁচিয়েছেন।’
বস্তুত শুধু রহীদ নয়, গোটা দেশ এবং জাতি মাহেরীন চৌধুরীর এই আত্মত্যাগের জন্য গর্বিত।
কিন্তু পরিতাপের বিষয়, যে মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে তিনি ১৭টি বছর সেবা দিয়েছেন, সেই নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষিকার অকালমৃত্যুতে স্কুল ও কলেজের পক্ষ থেকে শোকের প্রকাশ তেমন দেখা যায়নি। নিজ গ্রামের জানাজায়ও স্কুল কর্তৃপক্ষের কোনো ভাষ্য পাওয়া যায়নি। সরকারের তেমন গভীর মনোযোগ এ ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়নি। অথচ তিনি মানবিকতার যে দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন তা স্বার্থান্ধ দুনিয়ায় নজিরবিহীন। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে সম্মানিত করা হলে ভবিষ্যতে তিনি আমাদের মহৎপ্রাণ আদর্শ মানুষ হিসেবে অনেকের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন।
অনেকটা সাদামাঠাভাবে উত্তরার দিয়াবাড়ীর ১৩ নম্বর সেক্টরে প্রথম জানাজা শেষে গত ২২ জুলাই বিকেল ৪টায় মাহেরীন চৌধুরীর নির্বাক, নিথর, নিষ্প্রাণ মরদেহ তার নিজের প্রতিষ্ঠিত স্কুল ও কলেজের মাঠে যখন নেওয়া হয়। এই সময় নীলফামারী জেলার জলঢাকায় হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। এখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে মা-বাবার কবরের পাশে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
মাহেরীন চৌধুরী এক মৃত্যুহীন প্রাণ বয়ে এনেছিলেন। তার দেহগত মৃত্যু ঘটলেও আসলে নিষ্পাপ ২০টি জীবন রক্ষা করে চির অমর হয়ে রইলেন আমাদের মাঝে। আসলে তার মৃত্যু নেই। তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী।
প্রকৃত অর্থেই মাহেরীন চৌধুরী সর্বোচ্চ ত্যাগ ও মহিমার যে নিদর্শন রেখে গেলেন বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষ তাকে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় হৃদয়ের মণিকোঠায় চির জাগরুক রাখবে। স্মরণের আবরণে মরণের মহিমা দান করবে। তিনি মানুষের মনোবীণায় ঝংকার তুলবেন। আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে এবং ভক্তিভরে তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।
লেখক: অধ্যাপক ও সাবেক পরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, ঢাকা