শনিবার ২৬ জুলাই ২০২৫
১১ শ্রাবণ ১৪৩২
প্রশিক্ষণ বিমান চলাচল, নিরাপত্তা এবং বাস্তবতা
ড. সুলতান মাহমুদ রানা
প্রকাশ: শনিবার, ২৬ জুলাই, ২০২৫, ১:৪৩ এএম আপডেট: ২৬.০৭.২০২৫ ২:০৪ এএম |

 প্রশিক্ষণ বিমান চলাচল, নিরাপত্তা এবং বাস্তবতা

গত ২১ জুলাই উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে প্রশিক্ষণরত একটি যুদ্ধবিমান এসে আছড়ে পড়ে। এতে মুহূর্তেই হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল দেশের মধ্যে নামকরা একটি স্কুল। প্রাণোচ্ছল, হাসিখুশি, কচিকাঁচা মুখগুলোর কলকাকলিতে মুখর থাকত এ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। আজ সেখানে সহপাঠী, বাবা-মা, শিক্ষক ও স্বজনদের বুকফাটা কান্না। গণমাধ্যমে উত্তরার এ দুর্ঘটনা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে।
অনেক দাবিও উত্থাপিত হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, যে মডেলের বিমান উৎপাদক দেশ চীনসহ অনেক দেশেই আর ব্যবহার করা হয় না, তেমন একটি যুদ্ধবিমান কেন ঢাকার আকাশে ওড়ানো হলো? মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেছে। তার মধ্যে আছে- নিহতদের নামসহ সঠিক তথ্য প্রকাশ, আহতদের সম্পূর্ণ ও নির্ভুল তালিকা প্রকাশ, ক্ষতিপূরণ প্রদান, ঝুঁকিপূর্ণ ও পুরোনো বিমান প্রশিক্ষণে ব্যবহার না করা।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি কখনো ভেবে দেখেছে যে, প্রশিক্ষণ বিমান চালানোর সময়, স্থান এবং পরিস্থিতির মানদণ্ড কী? বাংলাদেশে কি কোনো সময় এসব মেনে চলা হয়। শুধু এ ক্ষেত্রেই নয়, অসংখ্য ঘটনা বাংলাদেশে অনবরত ঘটে চলেছে, যার প্রতিকার নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কখনোই ভাবে না। একটি ঘটনা ঘটার পর কিছু দিন খুব হইচই চলে, তার পর আরও একটি ঘটনা এসে সেটি চিরতরে মুছে ফেলে। 
২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার একটি প্রশিক্ষণ ফ্লাইট একটি স্কুলের পাশে বিধ্বস্ত হয়েছিল। এর ফলে স্কুল বন্ধ ঘোষণা করতে হয় এবং স্থানীয় নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ভারতের পাটনা ও হায়দ্রাবাদেও জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণ ফ্লাইট পরিচালনার বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণ বারবার প্রতিবাদ করেছে। পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে ২০১৯ সালে একটি সামরিক প্রশিক্ষণ বিমান জনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিধ্বস্ত হলে ১৮ জন মারা যান, যার মধ্যে ১২ জন ছিলেন সাধারণ নাগরিক। এসব দুর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, শুধু প্রশিক্ষণের স্বার্থে জনজীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। যার একটি বড় প্রমাণ পেলাম সম্প্রতি মাইলস্টোন কলেজের ঘটনায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, কিছু বেসরকারি বিমান প্রশিক্ষণ একাডেমি শহরতলি বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-সংলগ্ন এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। নিরাপত্তা প্রটোকল যথাযথভাবে মানা হয় না, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের কোনো নীতিমালা কার্যকর নেই, জরুরি অবতরণের উপযোগী স্থান নির্ধারণ করা হয় না, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে সিমুলেটর ট্রেনিং ছাড়াই ফ্লাইট পরিচালিত হয়। এ থেকে বোঝা যায়, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণে আমাদের বেশ পিছিয়ে থাকা এবং নিরাপত্তাকে অনেক সময় উপেক্ষা করা হয়।
আধুনিক বিশ্বের বেসামরিক ও সামরিক বিমানচালনা ব্যবস্থায় প্রশিক্ষণ বিমানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যৎ পাইলটদের হাতে-কলমে দক্ষ করে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণ বিমান ব্যবহার একটি অপরিহার্য প্রক্রিয়া। তবে এ প্রক্রিয়াটি কেবলমাত্র উড্ডয়ন ও অবতরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি একটি জটিল ও বহুস্তর বিশিষ্ট ব্যবস্থা, যেখানে প্রযুক্তি, পরিকল্পনা, নিরাপত্তা, জনস্বার্থ ও পরিবেশ- সবকিছুই সমান গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিকভাবে উন্নত দেশগুলো এ ব্যবস্থায় যথাযথ পরিকল্পনা ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা অনুসরণ করলেও অনেক উন্নয়নশীল দেশে এখনো পর্যন্ত এর যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি। বিশেষ করে জনবহুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-সংলগ্ন এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমান চলাচলের যে ঝুঁকি ও বাস্তবতা রয়েছে, তা আমাদের মনোযোগ দাবি করে।
আন্তর্জাতিকভাবে প্রশিক্ষণ বিমান চলাচলের জন্য নির্দিষ্ট ও নিয়ন্ত্রিত আকাশসীমা ব্যবহার করা হয়, যাকে বলা হয় উবংরমহধঃবফ ঞৎধরহরহম অৎবধ (উঞঅ) এসব এলাকা সাধারণত হয় কম জনবসতিপূর্ণ, উন্মুক্ত ও ভৌগলিকভাবে নিরাপদ অঞ্চল। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ঋঅঅ) দ্বারা নির্ধারিত ঈষধংং উ ও ঈষধংং ঊ ধরৎংঢ়ধপব-এ প্রশিক্ষণ বিমান চলাচল হয়, যেখানে বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রণ কক্ষের (অঞঈ) সরাসরি সমন্বয় থাকে। ইউরোপে যেমন ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডসে প্রশিক্ষণ বিমান সাধারণত নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ করিডর ব্যবহার করে, যা জনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়ায় আঞ্চলিক বা গ্রামীণ অঞ্চলে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যেখানে ন্যূনতম জনবসতি থাকে এবং শব্দ বা দুর্ঘটনার সম্ভাব্য প্রভাব সীমিত থাকে।
এ ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নিরাপত্তা। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, প্রশিক্ষণ বিমান চলাচলের জন্য কিছু মৌলিক নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক। প্রথমত, প্রতিটি ফ্লাইটের জন্য অবশ্যই অঞঈ-এর অনুমতি ও নির্দেশনা অনুসরণ করতে হয়। প্রশিক্ষণ চলাকালীন প্রশিক্ষণরত পাইলটদের সঙ্গে অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক অবশ্যই উপস্থিত থাকেন এবং পুরো সময় ফ্লাইটটি মনিটর করা হয়। দ্বিতীয়ত, ঘড়রংব অনধঃবসবহঃ চৎড়পবফঁৎবং অনুসরণ করে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যাতে স্থানীয় জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। তৃতীয়ত, প্রতিটি ফ্লাইট রুটের মধ্যে জরুরি অবতরণের জন্য উপযুক্ত স্থান নির্ধারণ করা থাকে, যাকে ঊসবৎমবহপু খধহফরহম ঝঃৎরঢ় বা ঝধভব তড়হব বলা হয়। চতুর্থত, আবহাওয়া পরিস্থিতি, দৃষ্টিসীমা ও বাতাসের গতিবেগ পর্যবেক্ষণ করে ফ্লাইট পরিচালিত হয় এবং রাতের সময় ফ্লাইট সাধারণত সীমিত পরিসরে হয়। পঞ্চমত, অধিকাংশ দেশেই প্রশিক্ষণ বিমানে উড্ডয়ন করার আগে সিমুলেটর ভিত্তিক কমপক্ষে ২০-৫০ ঘণ্টার প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর ফলে পাইলট প্রাথমিক ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে কার্যকরভাবে আকাশে ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারে।
এখন প্রশ্ন আসে, জনবহুল এলাকা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-সংলগ্ন আকাশসীমায় প্রশিক্ষণ বিমান চলাচলের বাস্তবতা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত বা নিরাপদ? বাস্তবতা হলো, উন্নয়নশীল দেশের শহরাঞ্চলে জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বসতবাড়ি- সবকিছু একে অপরের কাছাকাছি অবস্থান করে। ফলে এ এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমান চলাচল করলে যে ঝুঁকিগুলো সৃষ্টি হয়, তা একাধিক মাত্রায় প্রভাব ফেলে। প্রথমত, শব্দদূষণের ফলে শিক্ষার্থীদের শ্রবণশক্তি ও মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে, যা তাদের মানসিক ও শিক্ষাগত পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
 দ্বিতীয়ত, দুর্ঘটনা ঘটলে তা ভয়াবহ প্রাণহানির কারণ হতে পারে। ইতিহাসে অনেক প্রশিক্ষণ বিমানের দুর্ঘটনা রয়েছে, যেখানে জনবহুল এলাকায় বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিরীহ নাগরিক নিহত হয়েছেন। তৃতীয়ত, এ ধরনের দুর্ঘটনা হলে বিমা, দায়ভার নির্ধারণ এবং ক্ষতিপূরণ প্রদানে জটিলতা সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটলে তার সামাজিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত গভীর হয়।
উন্নত বিশ্বের অভিজ্ঞতা ও নিরাপত্তা মানদণ্ড থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো যদি প্রশিক্ষণ বিমানব্যবস্থাকে জনস্বার্থ ও প্রযুক্তিগত দিক বিবেচনায় সুসংগঠিত করে, তাহলে একদিকে যেমন দক্ষ পাইলট তৈরি সম্ভব হবে, অন্যদিকে জনজীবনও থাকবে নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন। আকাশপথে সক্ষমতা গড়তে হলে আকাশপথকে সবার জন্য নিরাপদ করে তুলতে হবে- এটাই সময়ের দাবি।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়












http://www.comillarkagoj.com/ad/1752266977.jpg
সর্বশেষ সংবাদ
কুমিল্লার গৌরীপুরে ২৩ মামলার আসামি মামুনকে কুপিয়ে হত্যা
সরকার পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ স্পষ্ট করছে: ভিপি নুর
কুমিল্লার বিভিন্ন আসনেগণ অধিকার পরিষদের প্রার্থী ঘোষণা
কর্ণফুলী সৈয়দ আহমেদ শপিং মল এর পাইলিং কার্যক্রম শুভ উদ্বোধন অনুষ্ঠিত
ঝোপের ভিতরে যুবকের মরদেহ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লার গৌরীপুরে ২৩ মামলার আসামি মামুনকে কুপিয়ে হত্যা
তারেক রহমান আগামীর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী
বাঁচানো গেল না মাহাতাবকে
কুমিল্লার বিভিন্ন আসনেগণ অধিকার পরিষদের প্রার্থী ঘোষণা
সাংবাদিকদের সুরক্ষার দাবিতে ইউরো-বাংলা প্রেসক্লাবে ফ্রান্সের ৭ দফা প্রস্তাবনা শীর্ষক আলোচনা সভা
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২