বিমান আর
যুদ্ধবিমান-দেখতে অনেক মিল আছে। কাজে একেবারে আলাদা। একটির জন্ম মানুষের
দ্রুত গমনাগমনের প্রয়োজনে, অপরটির ধ্বংস ও কর্তৃত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে।
কিন্তু দুটিই এসেছে বিজ্ঞানের আবিষ্কার। এ এক অদ্ভুত সহাবস্থান-যেখানে একই
প্রযুক্তি আমাদের স্বপ্নকে ডানা দেয়, আবার একই প্রযুক্তি আমাদের কফিনেও
পেরেক ঠুকে। মানবসভ্যতার এই বিপরীতমুখী অভিযাত্রা একদিকে আমাদের অভিভূত
করে, আবার অন্যদিকে প্রশ্ন জাগায়-আমরা আসলে কোন দিকে যাচ্ছি?
মানুষ এক
সময় আকাশে উড়তে চেয়েছিল শুধু স্বপ্নের টানে, আকাশ ছোঁয়ার আনন্দে। কিন্তু
এখন সেই আকাশের দিকেই তাকিয়ে মানুষ ভয় পায়-না জানি কখন বোমা পড়ে, কখন ড্রোন
হামলা হয়। একশ বছর আগে রাইট ব্রাদার্স উড়াল দিয়েছিলেন এক উদ্দীপনাময়
চেষ্টায়। আজ ওই পথেই ছুটে চলে স্টিলের ভয়ঙ্কর পাখি, যা মুহূর্তেই মুছে দিতে
পারে একটি শহর-বন্দর-গ্রাম, এমনকি গোটা একটি জনপদকেও।
তাহলে আমরা কি
প্রযুক্তিকে দোষ দেব? না, প্রযুক্তি কখনোই দোষী নয়। দোষ আমাদের প্রয়োগে,
উদ্দেশ্যে এবং মানবিক বিবেচনায়। বিজ্ঞান তার পথ অনুসরণ করে। সে সৃষ্টি করে,
কিন্তু কী সৃষ্টি করবে-সেটা ঠিক করে মানুষ। আমরা চাইলে আকাশে ফুল ফোটাতে
পারি, আবার চাইলে ফেলে দিতে পারি আগুনের গোলা। বিষয়টা তাই সদিচ্ছার,
মূল্যবোধের এবং নিয়ন্ত্রণের।
কিন্তু আমরা কি আসলে নিয়ন্ত্রণে আছি?
আধুনিক সভ্যতার পরিহাস হলো-যে দেশগুলো সভ্যতার বুলি কপচায়, গণতন্ত্রের
প্রতীক সাজে, মানবাধিকারের বুলি ছড়ায়, তারাই অস্ত্র তৈরিতে সবচেয়ে ব্যস্ত,
তারাই সামরিক খরচে শীর্ষে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ইসরায়েল, এমনকি
ইউরোপের শান্তির মুখোশ পরা দেশগুলোও যুদ্ধের ব্যস্ত বাজারে নিজেদের
অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। কোথাও না কোথাও যুদ্ধ থাকতেই হবে, যেন অস্ত্রের
ব্যবসা চলে। যুদ্ধের এই অনিবার্যতা যেন আধুনিক সভ্যতার স্থায়ী উপাদান হয়ে
দাঁড়িয়েছে।
এই যে বৈপরীত্য-মানবতা বনাম মুনাফা-এখানেই আমাদের সবচেয়ে বড়
সংকট। যারা মানবাধিকার নিয়ে চিৎকার করেন, তারাই আবার অস্ত্র রপ্তানি করে
শরণার্থী সৃষ্টির মূলে থাকেন। এক হাতে খাদ্য সহায়তা, অন্য হাতে ট্যাংকের
চাবি। একদিকে শান্তির সংলাপ, অন্যদিকে গোপন অস্ত্রচুক্তি। যেন ‘সভ্যতা’
একটি দ্বিমুখী মুখোশ, যেখানে একপাশে সহানুভূতি, অন্যপাশে স্বার্থান্ধতা।
তাহলে
আমরা কি অসহায়? না, একদমই না। ইতিহাস বলে, মানবতাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে।
হিটলার পারেনি, মুসোলিনি পারেনি, পারমাণবিক ছায়ার ভয় থেকেও মানুষ বেরিয়ে
এসেছে। যখনই ধ্বংস বেশি হয়েছে, তখনই মানুষ নতুন করে সৃষ্টি করতে শিখেছে।
হিরোশিমার ধ্বংসস্তূপ থেকে নতুন প্রজন্ম উঠে এসেছে; যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনাম
আবার গেয়ে উঠেছে জীবনের গান। আফ্রিকার গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত শিশুরা আজ
বিশ্বসংগীতের প্রতিভা হয়ে উঠছে।
সৃষ্টি ও ধ্বংস-এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব
চিরকালীন। কিন্তু আমরা কোনদিকে যাব, তা নির্ভর করে আমাদের বেছে নেওয়ার
ক্ষমতার ওপর। আমরা যদি মানবতার দিকে দাঁড়াই, তবে বিজ্ঞানের প্রতিটি
আবিষ্কার আশীর্বাদ হবে। আর যদি ক্ষমতার লালসা আমাদের চালিত করে, তবে
বিজ্ঞানই আমাদের সমাধির ফলক হয়ে উঠবে।
আজকের পৃথিবীতে তাই সবচেয়ে
প্রয়োজন-প্রযুক্তি নয়, মনুষ্যত্ব। সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নয়, বরং
সবচেয়ে বড় সহানুভূতির ক্ষমতা। বিমান তখনই মানুষকে সত্যিকারভাবে উড়তে
শেখাবে, যখন তার ডানায় থাকবে দয়া, শান্তি ও সম্ভাবনার ছাপ।
একটি বিমান ও
একটি যুদ্ধবিমান-দুটোই বিজ্ঞানের চূড়ান্ত আবিষ্কার। কিন্তু উদ্দেশ্যে,
ব্যবহারে, নীতিতে-এরা দুই ভিন্ন পৃথিবীর প্রতিনিধি। একটি মানুষকে নিয়ে যায়
গন্তব্যে, আরেকটি ছুড়ে দেয় মৃত্যু ও ধ্বংসে। অথচ দুটোরই ভিত্তি একই-উড়তে
শেখা। বিজ্ঞান মানুষকে আকাশে ওড়ার ক্ষমতা দিয়েছে, আবার সেই আকাশই আজ বোমার
ছায়ায় ঘনঘন আঁধার হয়ে ওঠে।
এই বিরোধ যেন আমাদের সভ্যতার চেহারায় খোদাই
করা। আমরা সৃষ্টি করি, আবার ধ্বংস করি। এক হাত দিয়ে দিই, আরেক হাত দিয়ে
কেড়ে নিই। বিজ্ঞানের হাত ধরে আমরা উন্নতির পথে ছুটি, আর ওই পথেই ফেলে আসি
বারুদের গন্ধ, আগুনের রেখা। প্রশ্ন হলো-এই সমীকরণে সৃষ্টির পাল্লা ভারী, না
ধ্বংসের?
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ২০২৪ সালের
তথ্য অনুসারে, বিশ্বে প্রতিদিন সামরিক খাতে গড়ে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার খরচ
হচ্ছে। ২০২৩ সালে বৈশ্বিক সামরিক ব্যয় ছিল প্রায় ২.৪৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন
ডলার। এই ব্যয়ের একটি বড় অংশ যায় বিমান প্রতিরক্ষা, যুদ্ধবিমান নির্মাণ,
ড্রোন প্রযুক্তি ও বায়ুসেনা ঘাঁটি সম্প্রসারণে। উদাহরণস্বরূপ, এফ-৩৫
যুদ্ধবিমান তৈরিতে প্রতি ইউনিট খরচ হয় ৮০-১০০ মিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্র
একাই প্রতিবছর ৭০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি সামরিক খাতে ব্যয় করে। বিশ্বে
বর্তমানে ৪০টির বেশি দেশ নিজেদের বায়ুসেনায় উন্নত যুদ্ধবিমান যুক্ত করেছে।
এই তথ্যগুলো দেখায়-যুদ্ধ প্রস্তুতি এখন শুধু প্রতিরক্ষা নয়, একটি ব্যবসায়িক
মডেল। এটি যত বড় হয়, মানবতার ভবিষ্যৎ ততই অনিশ্চিত হয়।
সবচেয়ে
আশ্চর্যের বিষয় হলো, যারা যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলে, তারাই যুদ্ধের সরঞ্জাম
সরবরাহ করে। ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, অস্ত্র রপ্তানিতে শীর্ষ পাঁচটি দেশ
হলো যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, চীন ও জার্মানি। বিশ্বের মোট অস্ত্র
রপ্তানির ৭৫ শতাংশের বেশি সরবরাহ করে এরা। এরা একদিকে জাতিসংঘে শান্তি
প্রস্তাব তোলে, অন্যদিকে গোপনে বা প্রকাশ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে অস্ত্র
পাঠায়। আমরা দেখি সিরিয়া, ইয়েমেন, ফিলিস্তিন, সুদান, ইউক্রেইন বা
আফগানিস্তান-যেখানে যুদ্ধের মূল হোতা স্থানীয় ক্ষমতালোভী গোষ্ঠী হলেও,
অস্ত্র ও রসদের জোগান আসে ‘সভ্য’ বিশ্ব থেকেই।
১৯০৩ সালে রাইট ব্রাদার্স
যখন পৃথিবীর প্রথম বিমান উড়ালেন, তখন মানুষের স্বপ্ন ছিল-দূরত্বকে জয় করা।
কয়েক ঘণ্টায় এক দেশ থেকে আরেক দেশে পৌঁছানোর অসাধারণ সম্ভাবনা। বিমানের
এই অগ্রগতি বদলে দিয়েছে পৃথিবীর মানচিত্র, ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন ও মানব
সংযোগের ধারা। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে বিশ্বজুড়ে ১ লাখ ২০ হাজার বিমান ওড়ে,
পরিবহন করে প্রায় ১০ কোটি যাত্রী। কিন্তু সেই বিমান প্রযুক্তিই আজ ব্যবহৃত
হয় মিসাইল ছুঁড়তে, বোমা বর্ষণে, ড্রোন হামলায়, রাডার-পর্যবেক্ষণ ও
ইলেকট্রনিক যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে। বিশেষত, ড্রোন যুদ্ধ এখন পৃথিবীর নতুন
বাস্তবতা। যুদ্ধক্ষেত্রে সেনা না পাঠিয়েই শত্রু ধ্বংস করার কৌশল। কিন্তু
সমস্যা হলো-ড্রোন প্রযুক্তি এখন এত সহজলভ্য যে জঙ্গি গোষ্ঠী, মাদক কার্টেল,
এমনকি ব্যক্তিগতভাবে সন্ত্রাসীরাও এটি কিনে নিচ্ছে।
আন্তর্জাতিকভাবে
‘মানবাধিকার রক্ষার’ নাম করে অনেক দেশ সামরিক হস্তক্ষেপ করে। অথচ সেই দেশের
নিকট অস্ত্র রপ্তানি করে আবার নিজেরাই আগুনে ঘি ঢালে। ইউক্রেইন সংকটে
যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো দেশগুলো ‘গণতন্ত্র রক্ষার’ কথা বলে অস্ত্র পাঠাচ্ছে,
অথচ এর প্রতিক্রিয়ায় যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হচ্ছে, হাজার হাজার মানুষ শরণার্থী
হচ্ছে। ফিলিস্তিনের শিশুদের চোখের জ্বলায় আমরা কাঁদি, কিন্তু ওই বোমা ফেলার
প্রযুক্তি কোথা থেকে আসছে-সেটি দেখার চোখ আমাদের তৈরি হয়নি।
আরেকদিকে,
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে আবার একই দেশগুলো আবার ত্রাণ পাঠায়-‘সোশ্যাল
রেসপন্সিবিলিটি’ দেখানোর জন্য। এক হাতে বোমা, অন্য হাতে রুটি-এই দ্বৈত
চরিত্র বিশ্ব রাজনীতির বড় সংকট। আমরা শুধু অভিযোগ করেই কি চুপ থাকব? না।
কয়েকটি বাস্তব করণীয় রয়েছে, যা নাগরিক, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক কাঠামোর
মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
বিজ্ঞানের সঙ্গে নৈতিকতা, অস্ত্রের সঙ্গে
বিবেক, প্রযুক্তির সঙ্গে মানবতা-এই সমন্বয় না হলে শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে
যায়। বিমান প্রযুক্তিকে যুদ্ধের কাজে নয়, বেসামরিক কাজে ব্যবহার বাড়াতে
হবে। পরিবেশবান্ধব উড়ান, স্বয়ংক্রিয় এয়ার-ট্যাক্সি বা চিকিৎসা সামগ্রী
পৌঁছে দেওয়ার ড্রোন-এই ধরনের সৃষ্টিশীল প্রকল্পে বিনিয়োগ বাড়িয়ে মানুষকে
বোঝাতে হবে, বিমান মানেই ধ্বংস নয়।
নাগরিক হিসেবে আমাদেরও দায়িত্ব নিতে
হবে। আমাদের করের টাকা কোথায় যায়, যুদ্ধবিমান কেনা হচ্ছে কি না, কাদের কাছে
অস্ত্র বিক্রি হচ্ছে-এই প্রশ্নগুলো তোলা আমাদের অধিকার। জনগণের চাপে অতীতে
অনেক অন্যায় থামানো গেছে, ভবিষ্যতেও তা সম্ভব।
বিজ্ঞান চিরকাল
দ্বৈত-অস্ত্রও বানায়, ওষুধও তৈরি করে। যুদ্ধবিমানও দেয়, কিন্তু একই
প্রযুক্তি আবার জীবন বাঁচানোর জন্য মেডিকেল এভিয়েশন তৈরি করে। আমরা কোন পথে
যাব-তা নির্ভর করে আমাদের মানসিকতার ওপর। আমাদের এখন করণীয় কী হতে পারে?
আমাদের
প্রথমেই ভাবতে হবে-আমরা আমাদের সন্তানদের কী শেখাচ্ছি? মোদ্দা কথা, আমাদের
চিন্তার পথ বদলাতে হবে। বিমানে চড়ার মানে শুধু বিলাসিতা নয়, সেটি যেন
যোগাযোগ, সহানুভূতি, সংস্কৃতি বিনিময়ের মাধ্যম হয়। আর যুদ্ধবিমান যেন
জাদুঘরের এক নিদর্শন হয়ে পড়ে থাকে-প্রযুক্তির সেই অধ্যায়, যেটা আমরা
অতিক্রম করে এসেছি। আজকের বিশ্ব যেখানে যুদ্ধের গন্ধে টইটম্বুর, সেখানে
প্রতিটি বিবেকবান মানুষের কাজ হলো শান্তির পক্ষে অবস্থান নেওয়া।
বিমান
মানুষকে শিখিয়েছে মাটির সীমা পেরিয়ে কিভাবে আকাশে পৌঁছানো যায়। এখন আমাদের
কাজ হলো অস্ত্রের সীমা পেরিয়ে মানবতার দিকে ফিরে তাকানো। আমরা যদি পারি,
তবে বিজ্ঞান আমাদের মুক্তি দেবে। আর যদি না পারি, তবে এই একই বিজ্ঞান
আমাদের নিজেদের তৈরি কবরে চিরশান্তিতে শয্যা নিতে সহায়তা করবে।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, কলামিস্ট।