কখনো কখনো বর্ণনাতীত এমন ঘটনা ঘটে, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। বুকের ওপর যেন পাষাণভার নেমে আসে। এ রকম মুহূর্তে মানুষের সব স্নায়ু শিথিল আর চিন্তনক্ষমতা লুপ্ত হয়ে যায়। সোমবার মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে যে দুর্ঘটনা ঘটল, তা ছিল স্মরণকালের দুঃসহ, নির্মম বড় দুর্ঘটনা। এ ঘটনায় সারা দেশের মানুষই শোকাহত।
ঘটনার সূত্রপাত গত পরশু দুপুর সোয়া ১টায়। পত্রিকান্তরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, অন্য দিনের মতো রাজধানী উত্তরার দিয়াবাড়ী মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষার্থীদের ক্লাস চলছিল। সবকিছু স্বাভাবিক। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছুটি হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাসায় ফেরার আকুলতা। স্কুলের বাইরে অভিভাবকরা অপেক্ষমাণ। হঠাৎ বিকট শব্দে স্কুল ভবনের ওপরে আছড়ে পড়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান- এফটি-৭ বিজিআই। মুহূর্তের মধ্যে বিমানটিতে আগুন ধরে যায়।
সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে; শ্রেণিকক্ষে ও স্কুল প্রাঙ্গণে। আকস্মিক এ ঘটনায় পুরো স্কুলে সৃষ্টি হয় বিভীষিকাময় পরিবেশ। যে স্কুল সব সময় থাকে কচিকাঁচাদের কলকাকলিতে মুখর, সেই স্কুলেই আর্তচিৎকার আর কান্নার রোল পড়ে যায়। আগুনের লেলিহান শিখায় ঝলসে যায় অসংখ্য শিশুর দেহ। যারা শারীরিকভাবে সক্ষম ছিল, পোড়া দেহ নিয়ে তারা আতঙ্কে-যন্ত্রণায় শ্রেণিকক্ষ থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে। উপস্থিত অভিভাবকরা উ™£ান্ত হয়ে খুঁজতে থাকেন তাদের প্রিয় সন্তানদের। মুহূর্তে এই খবর ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। দেশবাসী উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। সেই সঙ্গে টেলিভিশনের পর্দায় বা অনলাইনে চোখ রেখে প্রত্যক্ষ করেন হৃদয়বিদারক এ ঘটনা।
দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, আমরা কী দুর্ঘটনা এড়ানোর মতো সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি? যুদ্ধবিমানের প্রশিক্ষণের আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুসারে জনবহুল এলাকা এড়িয়ে প্রশিক্ষণ হওয়ার কথা। কিন্তু ঢাকার মতো পৃথিবীর শীর্ষ জনঘনত্বপূর্ণ মহানগরীর ওপর দিয়ে এ ধরনের প্রশিক্ষণ কতটা যৌক্তিক, সে সম্পর্কে প্রশ্ন থেকেই যায়।
দুর্ঘটনার মধ্য দিয়েই বিপর্যয়ের অবসান হয়নি। অন্য সংকট দেখা দিয়েছে। এখন মনোযোগ আহতদের দিকে। আহতদের বাঁচানোর জন্য সরকার ও সামরিক বাহিনী সর্বাত্মক শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে দেওয়া শোকবার্তায় বলেছেন সরকার দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের সব কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলার নির্দেশ দিয়েছেন। এই মুহূর্তে আরও কিছু করণীয় আছে।
আহত যারা, বিনামূল্যে তাদের সুচিকিৎসার যাবতীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সামান্য অবহেলাও মৃত্যুর কারণ হতে পারে; সেটা যাতে না হয়, সবাইকে মানবিক প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শিক্ষার্থীদের সারিয়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশে পাঠাতে হবে। বিদেশ থেকে চিকিৎসক নিয়ে এসে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ করণীয় হচ্ছে, নিহত প্রতিটি শিশুর পরিচয় খুঁজে বের করে তাদের দেহাবশেষ যতটুকু মিলবে তা অভিভাবকদের বুঝিয়ে দিতে হবে।
যাদের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি, তাদের সবার ডিএনএ পরীক্ষা করে পরিচয় শনাক্ত করা প্রয়োজন। এই উদ্যোগটি যাতে যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়, সে বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। খবরে দেখা গেছে, দুজন উপদেষ্টার উপস্থিতিতে নিহত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা এবং তাদের লাশ যথাযথভাবে হস্তান্তর নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছে। শুধু তাদের ক্ষোভ প্রশমনের জন্য নয়, প্রত্যেক অভিভাবক তার প্রিয় সন্তানের শেষ চিহ্নটুকু দেখার আর্তি জানাবেন, এটাই স্বাভাবিক। এ বিষয়ে তাই স্বচ্ছতা থাকা জরুরি বলে আমরা মনে করি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশে’র সেই বিপন্ন উচ্চারণকে স্মরণ করে এ ঘটনায় আমরা অভিভাবকদের উদ্দেশে গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করছি। তাদের মনে শান্তি আসুক, স্থিরতা আসুক, পরম করুণাময়ের কাছে এই প্রার্থনা।