উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে খেলাপি ঋণের
পরিমাণ। এতে করে দেশের ব্যাংক খাতে নৈরাজ্য পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ
ব্যাংক গত রবিবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ
করেছে। এর আগে খেলাপি ঋণের ডিসেম্বরভিত্তিক তথ্য সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে
প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। এ সময় তিনি
বলেছিলেন, খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি ভালোর দিকে যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের
সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিন মাসের ব্যবধানে বা ডিসেম্বরের তুলনায়
মার্চে খেলাপি ঋণ বেড়েছে পৌনে ১ লাখ কোটি টাকা। আর এক বছরের হিসাবে বেড়েছে ২
লাখ ৩৮ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার
৭৬৫ কোটি টাকা। যা মার্চের শেষে বেড়ে হয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা।
অর্থাৎ তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। এর আগে গত বছরের
সেপ্টেম্বরের শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। বিগত
সরকারের সময় খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য আড়াল করে তা কমিয়ে রাখা হতো।
অর্থনীতিবিদরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করে আসছিলেন, তৎকালীন সরকারের আমলে
ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ নেওয়ার নামে লুটতরাজ করা হয়েছে। গত বছরের
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করে।
খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে কম দেখাতে নেওয়া হয়েছিল একের পর এক নীতি।
সরকার
পরিবর্তনের পর এই নীতি থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সংশ্লিষ্টরা
বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের ব্যাংকগুলো থেকে গত দেড় দশকে
অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে যেসব ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, তার বেশির ভাগই এখন আর
ফেরত দিচ্ছে না। এর প্রভাবে সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব ব্যাংকেরই খেলাপি ঋণ
অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এতদিন খেলাপি ঋণের তথ্য লুকিয়ে রাখার যে প্রবণতা
ছিল, এখন সেটা নেই। ফলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশিত হচ্ছে। এতে
আগামীতে খেলাপি ঋণের হার আরও বাড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এতে
সার্বিকভাবে সংকটে পড়বে দেশের ব্যাংক খাত তথা পুরো অর্থনীতি।
খেলাপি ঋণ
বাড়ার কারণ সম্পর্কে বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার তথ্যের
স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের জন্য কাজ করছে। এ কারণে এমন কোনো তথ্যই গোপন করা
হচ্ছে না। বড় গ্রুপগুলোর মধ্যে যারা পলাতক এবং আটক, তাদের ঋণগুলোই এখন
খেলাপি হচ্ছে। বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্যের সার্বিক পরিস্থিতিও খুব একটা ভালো
নয়। ফলে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধিও প্রতিনিয়ত কমছে। অর্থাৎ নতুন ঋণ
বিতরণ হচ্ছে কম, খেলাপি হচ্ছে বেশি। এটি জুন প্রান্তিকে আরও বাড়তে পারে।
তবে এরপর থেকে কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠন
হচ্ছে, তারা এসব ঋণ কিনে নিতে পারে। এতে ধীরে ধীরে কমে আসবে খেলাপি ঋণ।
ঋণখেলাপির নিয়ম আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কারণেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে। যেসব
ঋণ নবায়ন করা হয়, তার অনেক আদায় হচ্ছে না। অনিয়মের কারণে অনেক ঋণ খেলাপি
করে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতেই খেলাপি ঋণ বাড়ছে।
বর্তমান
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ব্যাংক বা আর্থিক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে
আনতে কাজ করে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে দেশের মন্থর অর্থনীতিকে যাতে আরও
গতিশীল করা যায়, সে জন্যস্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের ওপর জোর দিচ্ছে সরকার। ঋণের
সঠিক তথ্য সামনে আনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এটি
আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের একটি ইতিবাচক দিক। আশা করছি, সরকার
দেশের সার্বিক অর্থনীতি চাঙা রাখতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে কার্যকর
ভূমিকা পালন করবে।