দেশে স্বাস্থ্যসেবার মান কখনোই খুব একটা উন্নত ছিল না। বিভিন্ন সময়ে কিছু কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যসেবার মানকে খুব একটা উন্নত করতে পারেনি। দুর্নীতি, সক্ষমতার ঘাটতি, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং নিম্নমানের চিকিৎসা শিক্ষাব্যবস্থা স্বাস্থ্য খাতের জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে উঠেছে। গতকাল শনিবার এ বিষয়ে পত্রিকান্তরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
জানা যায়, স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন গত সোমবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে আরো অনেক সমস্যার সঙ্গে সেবা ব্যবস্থাপনার ২০টি দুর্বল দিক তুলে ধরা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা খাতকে এগিয়ে নিতে হলে এই দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠা অত্যন্ত জরুরি।
দেশের বেশির ভাগ মানুষ সেবার জন্য ভিড় করে সরকারি হাসপাতালগুলোতে।
কিন্তু এই হাসপাতালগুলোতে সমন্বিত পরিকল্পনা, তদারকি, ধারাবাহিকতা ও ব্যবস্থাপনার অভাব প্রকট। তার ওপর চলে দলবাজি। স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন যেসব দুর্বল দিক চিহ্নিত করেছে, এর মধ্যে একটি হলো সেবা প্রদানকারীর স্বল্পতা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ মোতাবেক এসডিজি-৩ (সর্বজনীন স্বাস্থ্য কাভারেজ) অর্জনে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ২০২৫ সালে ৩১.৫ জন এবং ২০৩০ সালে ৪৪.৫ জন সেবা প্রদানকারী থাকার কথা।
অথচ বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজারে কর্মরত আছেন মাত্র ১১.৭০ জন। সরকারি স্বাস্থ্য খাতে প্রথম থেকে ২০তম গ্রেড পর্যন্ত অনুমোদিত পদ দুই লাখ ৩৬ হাজার ৮২৮টি। এর মধ্যে কর্মরত আছেন এক লাখ ৭৩ হাজার ২৬১ জন। মোট ৬৩ হাজার ৫৭১টি পদ শূন্য রয়েছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে জনস্বাস্থ্য এবং ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত দক্ষ জনবল প্রায় অনুপস্থিত।
স্থানীয় পর্যায়ে কমিউনিটির যথাযথ অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়নের অভাব রয়েছে। উপজেলা এবং কমিউনিটিভিত্তিক ব্যবস্থাপনা কমিটি তৈরি করা হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব কমিটিকে কোনো দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় না এবং স্থানীয় স্বাস্থ্য সেবাদানকারীদের মধ্যে কোনো জবাবদিহি তৈরি হয় না।
স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী অবকাঠামোগত দুর্বলতা; ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা; উপকরণের অভাব; ওষুধ, সেবা ও উপকরণের অহেতুক উচ্চমূল্য; ভুল সিদ্ধান্ত তথা অগ্রগণ্যতা ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের অভাব; সেবা প্রদানকারীদের সময় ও সেবাকাজে পরিপূর্ণ আত্মনিয়োগের অভাব; প্রশংসনীয় সেবার জন্য পুরস্কার এবং অসন্তোষ উদ্রেককারী সেবা প্রদানের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা না থাকা ইত্যাদি এই খাতের অগ্রগতিতে বাধা হচ্ছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের সময়মতো বদলি, পদোন্নতি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না করা; উচ্চশিক্ষিত জনস্বাস্থ্যবিদদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো সুবিধা না দেওয়া; জনগণের মধ্যে তথ্য প্রচারে দুর্বলতা; সেবা প্রদানকারীদের পরিপূর্ণ দলের অভাব; স্বাস্থ্য প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা; সেবা কাজে সুচারু পদ্ধতি অনুসরণের অভাব; রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষাগারের দুর্বলতা; আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব, এসব পরিচালনায় দক্ষতার অভাব এবং দক্ষ সেবা প্রদানকারীর স্বল্পতা; সংরক্ষণ ও মেরামতে দীর্ঘসূত্রতা; ক্রয় ও সংগ্রহ কাজে অপরাধপ্রবণতা; স্বাস্থ্যসেবা কাজে দালাল ও ওষুধ কম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ ইত্যাদিও এই খাতের অন্যতম দুর্বলতা।
জলবায়ু পরিবর্তন, জীবনযাত্রার ধরনসহ নানা কারণে রোগব্যাধির প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে। এমন অবস্থায় স্বাস্থ্যসেবার মান আরো উন্নত হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। আমরা আশা করি, বিদ্যমান অব্যবস্থাপনা দূর করে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সরকার দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেবে।