
তুমি চলে গেলে দোঁয়াশগন্ধি মাটির গভীরে।
বৃহৎ ছাতিম গাছটির স্নিগ্ধ-কোমল ছায়ার নিচে। আঁধো আঁধো জোছনার আলোতে আমাদের
সবটুকু ভালোবাসা ছাতিম ফুলের কাছে জমা দিয়ে দিয়েছি। ছাতিম ফুলের এই অদৃশ্য
সুগন্ধি ছড়িয়ে থাকুক মায়ায় জড়ানো তোমার শরীর জুড়ে। তুমি শুয়ে আছো স্নেহময়ী
দাদা-দাদুর শায়িত স্তব্দ মাটির জোড়া কবর থেকে খানিক দূরে।
মানুষের
জীবনচক্রে শৈশব-কৈশোর-যৌবন পেড়িয়ে বার্ধক্যের অভিজ্ঞতা শেষে ঠাঁই হয় কবরের
নিঃস্তব্দ মাটির গহ্বরে। তুমিতো শৈশব কৈশোরের স্নিগ্ধ-কোমল সৌন্দর্য
ক্রমাগতভাবে টেনে নিয়ে, ভরা যৌবনের কুসুম-কোমলে পৌঁছতে না পৌঁছতে তোমার সকল
স্বপ্ন, সকল সংকল্প মৃত্যুর কাছে সঁপে দিয়ে দিলে। যেমনটি কালবৈশাখী ঝরের
কবলে পড়ে নিদোর্ষ সারস বকের ছানার মৃত্যুর মতো করে।
তোমার চোখের দিকে
যখনই তাকাতাম চোখে এক দূরন্ত কিশোর খেলা করত। চোখের এই উত্তাপ আলোড়িত
করেছিল আমাদের পরিবারের সর্ব হৃদয়ে। তোমার এই চলে যাওয়া আমাদেরকে ভীষণ্ন
করে তুলেছে। পারিবারিক সজীবতাকে নীরব করে তুলেছে, যেন কেউ কোথাও নেই।
এইতো
সেদিন তোমার দাদা-দাদুর নামে (অঋ) ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আয়োজিত ইফতার পূর্ব
আলোচনা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের আপ্যায়নে খসে পড়া হাতের কোমল জায়গাটি
আঁড়াল করে নিজেকে বিলিয়ে দিলে। সন্ধ্যার অন্ধকারে চাঁদের নরম আলো মুখে
মেখে প্রিয় বকুল গাছটার নিচে নীরবে দাঁড়িয়ে কী কথা মনে মনে ভেবেছিলে? আর
বলা হলো না। তোমার অপ্রকাশিত কথামালা আর কোনোদিনই প্রকাশিত হবে না।
নাঈম তোমার সাথে আমার আবাসিক দূরত্ব ছিল। কিন্তু হৃদয়ের সংযোগ ছিল
সার্বক্ষণিক। হৃদয় গলিত না হলে চোখের জমাটবদ্ধ নোনা বরফজল গলে না। চৈত্রের
তপ্ত দুপুরের মতো করে তোমার বিগত হওয়ার শোক, হৃদয় গলিয়ে চোখের জমাটজল
গলে-গলে বেয়ে চলেছে বিষণ্ন-মাটির শরীরে।
তোমার অভাববোধ আমাদের কল্পনার
কাঠামো ভেঙে দিয়েছে। ভেঙে দিয়েছে অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের সামাজিক বন্ধন।
বাঙালি মুসলমান গত হলে মরহুম হয়ে যায়। তুমিও এই ব্যতিক্রমকে অতিক্রম করতে
পারোনি। কারণ বাঙালি মুসলমান জন্ম নেয় মরহুম হওয়ার জন্য-ই। বাঙালি
মুসলমানের জীবন শেষে মরহুমের তালিকায় যুক্ত হয়। এটা চিরকালের রীতি।
তোমার
নামের সাথে মরহুম যোগ করে যখন এলাকার সরল জনপদের প্রিয় মানুষদেরকে ধরাজ
গলায় শব্দযন্ত্রের সাহায্যে ক্রমাগতভাবে আহ্বান হতে লাগল-মরহুম নামে, তা
আপাতত আশা করিনি নাঈম। মাটি খুঁড়লে জলবের হয়, হৃদয় খুঁড়লে কি বের হয় সেদিন
তা মানুষের চোখে দেখেছি। কতকাল এইভাবে মানুষের চোখ দেখিনি। কিন্তু তোমার
চিরপ্রস্থানে দেখেছি মানুষের চোখ। জল করমচার মতো দুঃখের রঙ খেলেছিল মানুষের
মায়াভরা চোখে।
দুজনে মুখোমুখি- তুমি নীরবে ঘুমিয়ে আছো। আমি প্রবলতম হয়ে
আছি কিছু বলব প্রশান্তির আশায় আশায়। মাঝখানে আর কেউ নেই, কোনো কিছু নেই,
আঁড়াল নয়- আবডাল নয়, যেন সমস্ত কিছু বৈরী আমার। পালাবো কোথায়? দিক নেই,
সীমানা নেই, আছে শুধু তোমার নিস্তেজ দেহখানি নির্দেহী মেঝেতে পড়ে। সত্য
শুধু সত্যের শত্রুতা, বাকি সব মিথ্যে আমার জন্য।
তুমি চলে যাবে- এই
কথাটা এমন নির্মমভাবে সত্য হয়ে যাবে কে ভেবেছিল, কবে? এই তো সেদিন শেষবার
যখন তোমাকে আমার বাসায় দেখলাম, তোমার মুখে ছিল দুষ্টমিভরা সেই পরিচিত
মায়াবী হাসি। মুখে গড় গড় করে বলেছিলে ‘‘কাকু মাহি কই?’’ (মাহি আমার ছেলের
নাম)। যদি জানা থাকতো ও-ই আমার সাথে তোমার শেষ দেখা...। তবে কী ক্ষরণ হতো
জানি না।
গভীর অন্ধকার, যেন তুমি হারিয়ে গেছো। যেমনি হারিয়ে গেছে তোমার
দাদা-দাদু মহাকালের পথে। তুমিও তোমার দাদা- দাদুর মতো করে চলেগেছো মহাকালের
সরল পথে। স্বাক্ষী শুধু কাঠ বাদাম গাছটার ছায়াটা-ই। যার নিচে বড়ই কুসুম
জলে তোমার শেষ গোসল হয়েছিল।
নাঈম তুমি বড় দ্রুত চলে গেলে, কেমন
নিঃশব্দের হাহাকার করে। এ-কেমন চলে যাওয়া। শৈশবে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার
মতো করে। কী নিয়ে গেলে সঙ্গে করে? ভেতরে পুষে রাখা শুধু কি দুঃখগুলো নিয়ে?
নাকি আরো বেশি যন্ত্রণা ছিল তোমার জীবনে? তোমার যাপনে, স্বপ্নে।
তোমাকে
বুঝতে পারিনি বলে-জ্ঞাতে অজ্ঞাতে আহত করেছি, খুব সংবেদনশীল ছিলে, সহজে
রক্তাক্ত হতে, আবার হাসি দিয়ে ভুলে যেতে। এটা ছিল তোমার সহজাত প্রবৃত্তি।
কিন্তু কারণে-অকারণে যারা তোমাকে অনেকটা স্বভাব দোষে বৈরী আচরণ করেছে, তারা
জানে না তোমার শান্ত, নিরীহ ও বিনয়ী সরল স্বভাবের তোমার ভেতরে কেমন একটা
সুন্দর পরিপাটি মানুষ ছিল।
দুঃখগুলো নিয়ে গেছো। কিন্তু নিজেকে রেখে গেছো
অনেকভাবে। প্রকাশ্যে যতটা, সংগোপনে তার চেয়ে অনেক বেশি। জীবন ও মৃত্যুর এই
ঘোর রহস্য উন্মোচন করবে কে? আসলে সকল জীবিতেরা জীবিত নয়, আবার সকল মৃতেরাও
মৃত নয়। আমাদের স্মরণপাঠে অনিদিষ্টকাল তুমি অমর হয়ে থাকবে নাঈম।
তোমার
মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমারা যারা বেঁচে আছি, সবাইকে অপরাধী করে রেখে গেছো।
তুমিতো চলেগেছা অপরাধ করোনি বলে। নিরাপরাধ না হলে তুমি চলে যাবে কেন? সূর্য
উদিত হলে আবার অস্ত যায়। তোমার আগমন তো প্রভাতের সূর্যের মতো করে হয়েছিল।
আমরা
যারা তোমার স্বজন- কোনো বিসর্জনের মাধ্যমেও তো তোমাকে ফিরে পাবো না। ঐ যে
সন্ধ্যার অন্ধকারে আকাশ ঘুমায়। তুমিও বিশাল আকাশের মতো করে আগর নিঃশ^াসে
ঘুমিয়ে আছো। চির ঘুমের- চির শান্তির দেশে। তোমার পিতার লোমকুপ দিয়ে যে জল
গড়ায় তার নাম অশ্রু। ঘুমহীন চোখের জলে কতটা দুঃখ পোষে তা তোমার পিতার চোখে
দেখেছি।
তোমাকে নিয়ে কথা বলা, তোমার আড়ালে এটাও এক প্রকারের অপরাধ।
সংসারে নিষ্ঠুরতা আছে নাঈম, তা পদে পদে বহমান। যত ধরনের নিষ্টুরতা আছে, এর
মধ্যে নিকৃষ্টতর নিঃষ্ঠুরতা হচ্ছে মুমূর্ষু-মানুষের কাছে মাফ চাওয়া। তুমি
যখন ডান হাত হারিয়ে মুমূর্ষু ছিলে, বাঁচা- মরার মাঝখানে কাতরাচ্ছিলে, এই
দুঃসহ অনুভূতি ধারণ করে মাফ চাইতে পারিনি। তুমিতো সবকিছুই রেখে গেলে
জীবিতদের ভোগের- আনন্দের জন্য। এমন কি জমানো স্মৃতিটুকুও। যা তোমার শেষ
মূলধন ছিল। তোমার যে, প্রবল একটা ঘৃণা থাকবে সমাজের প্রতি, বন্ধু বান্ধবদের
প্রতি, স্বজনদের প্রতি, অভিমান থাকবে তোমাকে বিদায় করে দেবার জন্য। এর
চেয়ে নিষ্ঠুরতর কাজ কী হতে পারে আমি জানি না। তোমার বাবা-মায়ের জন্য আর কী
কী সান্ত্বনা আছে আমি এখনো উপলব্দি করতে পারিনি। শুধু জানি এতটুকু যে, তুমি
ছিলে তোমার পরিবারবর্গের কাছে আশার আলো। তুমি ছিলে স্বজনদের স্বজন, তুমি
ছিলে আপনজনদের আপনজন।
পৃথিবীতে সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হচ্ছে- কারো করুণার
পাত্র হওয়া। যেদিন সড়ক দুর্ঘটনায় সোনার মোহরের চেয়ে দামী-প্রিয় হাতটি
হারিয়ে ছিলে, সেদিন থেকে তোমার তরুণ কোমল মনে বাসা বেঁধেছিল যে, সর্বমহলের
অবহেলা, করুণা, আরও অনেক অনেক পীড়াদায়ক শব্দের সামাহারে ব্যথিত হওয়ার
দুঃস্বপ্নের কথা। ঘুমের ঘোর নেশায় অভিমান করে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলে।
সেখান থেকে কেউ কোনো দিন ফেরেনি। তুমিও ফিরবে না। এটা মহাকালের রীতি।
যখন
বুঝতে পারলাম কৃত্তিম হাত প্রতিস্থাপন সম্ভব নয়। তখন মনে হয়েছিল পায়ের
তলায় মাটি নেই। আমাদের আশ^াসে বিশ^াস করেছিলে তোমার চাওয়া পূরণ হবে। তোমার
চাওয়াটা পূরণ করতে পারিনি।
তোমাকে হাসিখুশি ছাড়া দেখেনি কেউ কখনো।
কিন্তু ডান হাত বিহীন সময়টায় ভীষণ বিপন্ন ছিলে তুমি। নাঈম-এমন বিপন্ন-
বিষণ্ন তোমাকে আরেকবার-ই দেখেছিলাম শুধু। তোমার সেজো কাকা-ইঞ্জিনিয়ার
নাজমূল হাসান খোকন সাহেবের অকাল মৃত্যুতে। ঘন বর্ষার মতো করে অঝোর ধারায়
চোখের জল তোমার তরুণ কোমল গাল বেয়ে রুপালী ধারায় টিপ টিপ করে ঝরেছিল।
শোকার্ত কান্নার শব্দে নিজেকে হাল্কা করতে চেয়েছিলে, না তুমি নিজেকে হাল্কা
করতে পারোনি।
কত রাত তুমি ঘুমের মধ্যে হঠাৎ জেগে উঠেছ। কিন্তু জীবনের
শেষ ঘুম থেকে আর জেগে উঠো নি। এ কেমন অভিমান, এ-কেমন ঘুমন্ত প্রকৃতির ভিতরে
নীরবে প্রস্থান। যেখানে চলে গেছো সেখানে কোনোও পথ নেই, দরজা নেই, জানালা
নেই, আলো নেই এমন কি নিঃশ^াসের গন্ধও নেই। নিঃস্তব্দ কবরের মাটির গভীরে
শুয়ে আছো ছাতিম ফুলের সুগন্ধি মেখে। নাঈম অপেক্ষায় থাকো বাবা, তোমার মতো
করে অথবা অন্য কোনোভাবে তোমার কাছে আসব।
কখনো ভাবতে পারিনি যে, ভেতরে
ভেতরে গোপনে সবার অগোচরে লেখা হচ্ছিল- তোমার মৃত্যু দন্ডাদেশ। তৈরী হচ্ছিল
ঘাতক, তোমার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেওয়ার জন্য। হ্যাঁ তোমার মৃত্যুদন্ডাদেশ
তামিল হয়েছে। তোমার মৃত্যু আরো অনেক মৃত্যুর মতোই, কেবল অভিযুক্ত করে গেল
বাংলাদেশের সড়ক ব্যবস্থাপনাকে। সেদিন ছিল ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, কুমিল্লা
শাসন গাছা বাস টার্মিনালের পেছনে আড়াইওড়া স্থানে সকাল ১০টায় ঘাতক
অটোরিক্সার মুখোমুখি সংর্ঘষের কবলে পড়ে ডান হাতটি হারালে। মাত্র ১ বছর ১
মাস ২৩ দিন পরে ফাঁসির হুকুমের মতো করে মৃত্যু দন্ডাদেশ কার্যকর হলো। এ-যেন
মহাকালের গহ্বরে পতিত হলে, অনন্ত কালের যাত্রী হয়ে।
সোনার বাংলা কলেজ
থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে এচঅ-৫ পেয়ে, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে
ব্যবস্থাপনা বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলে উচ্চতর ডিগ্রি লাভের
প্রত্যাশায়। তোমার স্বপ্ন, তোমার স্মৃতি সবটুকুই বিগত করে চলে গেলে না
ফেরার দেশে। এতো তাড়াতাড়ি অনন্ত ঘুমের দেশে চলে যাবে তা ভাবতে চোখে জলে
আসে। স্তব্দ হয়ে যায় সবটুকু। নির্বাক হয়ে যায় কণ্ঠনালী। তবুও আক্ষেপ জমে
আছে অনুভূতির জমানো স্মৃতিটুকুতে একটি কথা, সে কথাটি হচ্ছে, নাঈম তোমার
সাথে আমার বয়সের দূরত্ব ছিল। কিন্তু মনের মিল ছিল যথেষ্ঠ পরিমানে।
চিরায়ত
নিয়মে তুমি চলে গেলে, তোমার প্রিয় উঠনে আবার হয়তো ভরা পূর্ণিমার রাতে
একদিন নতুন চাঁদ উঠবে। যে অতীত ভয়ে-ভীষণ্নতায়-বিস্মৃতিতে এবং বেদনায়
বুকভারী হয়ে উঠেছিল, তা নতুন আলোয় স্পষ্ট হবে। নিদ্রাহীন চোখে জমা হয়ে
থাকবে তোমার সমস্ত স্মৃতিটুকু। তুমি ফিরে এসো ফুলের আসরে বাগানের নিস্তবতায়
ঘুমিয়ে পড়া শিশুর মতো করে।
লেখক: অধ্যাপক, কলাম লেখক ও প্রাবন্ধিক